একটা দুটো নয়, সিত্রাং প্রাণ নিল বাংলাদেশের ৩৪ জনের, মৃত‍্যুমিছিলের দায় কার?

Sitrang Cyclone Update: ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভা‌বে ব‌রিশা‌লে প্রায় সাড়ে তিন হাজার ঘরবা‌ড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হ‌য়ে‌ছে বলে জানা যাচ্ছে। এর ম‌ধ্যে সবচেয়ে বে‌শি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হিজলা উপ‌জেলায়।

কালীপুজো, দীপাবলির আনন্দে কি জল ঢালবে ঘুর্ণিঝড় সিত্রাং? গত কয়েকদিন ধরে এই প্রশ্নটাই ঘোরাফেরা করছিল আপামর বাঙালির মনে। পশ্চিমবঙ্গে সেরকম প্রভাব ফেলতে পারেনি সিত্রাং। তবে এপার বাংলা ঘূর্ণিঝড়ের দাপট থেকে বেঁচে গেলেও প্রবল ধ্বংসলীলার সম্মুখীন হয়েছে ওপার বাংলা। পূর্বাভাস মতো, সোমবার রাতে বাংলাদেশের উপকূলে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং। এখনও পর্যন্ত সেখান থেকে যা ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে তা বীভৎস। সোমবার সকালে আলিপুর আবহাওয়া দফতরের তরফে জানানো হয়, ভারতীয় সময় রাত সাড়ে ন'টা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে সিত্রাং বাংলাদেশের বরিশালের কাছে তিনকোণা এবং সান দ্বীপের মধ্যবর্তী অঞ্চলে ল্যান্ডফল করবে। হয়ও তাই। আছড়ে পড়ার সময় এই ঘূর্ণিঝড়ের বেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ৯০ থেকে ১০০ কিমি। রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ সিত্রাংয়ের অবস্থান ছিল ঢাকা থেকে ৪০ কিমি পূর্বে, আগরতলা থেকে ৫০ কিমি দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং বাংলাদেশের বরিশাল থেকে ১২০ কিমি উত্তর-উত্তর-পূর্বে। সোমবার মাঝরাতেই বাংলাদেশের উপকূলবর্তী অঞ্চলে আছড়ে পড়েছিল শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং, আর তার জেরে বড় বিপর্যয়ের মুখে ওপার বাংলা।

প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, দক্ষিণ বাংলাদেশের খেপুপাড়ার কাছে স্থলভাগে ল্যান্ডফলের পর থেকে সেখানে বৃষ্টির পরিমাণ আরও বাড়িয়েছে এই ঘূর্ণিঝড়। এই ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ওপার বাংলায় বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ব্যাপকহারে নষ্ট হয়েছে বাড়িঘর এবং ফসল। গাছ পড়ে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সর্বশেষ প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে কমপক্ষে ৩৫। ১৪টি জেলা থেকে আসছে প্রাণহানির খবর। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটেছে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে। সেখানে মৃত ১৪। মৃতদের মধ্যে ১০ জন নারী, ৪ জন শিশু। সবচেয়ে বেশি ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে গাছচাপায়। এখনও পর্যন্ত দেওয়াল চাপা পড়ে এবং বাড়ি ধসে পড়ে ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃতদের মধ্যে কুমিল্লায় ৩, ভোলায় ২, সিরাজগঞ্জে ২ এবং নড়াইল এবং বরগুনায় ১ জন করে মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। প্রায় ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা তাণ্ডব চালানোর পরে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং গতকাল অর্থাৎ মঙ্গলবার রাতেই বাংলাদেশের সীমা অতিক্রম করে বলে জানা গিয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা করে বহু মানুষ এবং গবাদি পশুকে আগেই সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে আগে থেকেই এদিন খুলনা, বরিশাল এবং চট্টগ্রামের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের নির্দেশ আগে থেকেই দেওয়া হয়েছিল।

সিত্রাংয়ের ধ্বংসলীলা

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভা‌বে ব‌রিশা‌লে প্রায় সাড়ে তিন হাজার ঘরবা‌ড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হ‌য়ে‌ছে বলে জানা যাচ্ছে। এর ম‌ধ্যে সবচেয়ে বে‌শি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হিজলা উপ‌জেলায়। বরিশালে এখনও বৃষ্টি অব্যাহত। ওই শহরের অধিকাংশ জায়গায় এখনও জলের তলায়। টানা প্রবল বৃষ্টি, উঁচু জোয়ারের পাশাপাশি দিনভর ঝোড়ো হাওয়ায় রীতিমতো বিপর্যস্ত জনজীবন। বরিশালে প্রায় বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গিয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। বরিশালের আবহাওয়া দফতর থেকে সরাসরি জানানো হচ্ছে, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বৃষ্টিপাত আরও দু’দিন অব্যাহত থাকতে পারে। এর প্রভাবে বরিশালের উপকূলবর্তী, চর ও নিম্নাঞ্চলগুলোয় প্লাবনের আশঙ্কা রয়েছে। সেখানে জলস্তর ৫ থেকে ৮ ফুট পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে যা নিঃসন্দেহে দুশ্চিন্তার।

বরিশালে বিপুল জলস্ফীতি

বরিশালের তুলনায় কম হলেও চট্টগ্রাম এবং ঢাকার পরিস্থিতিও বেশ চিন্তার। বহু রাস্তায় এখনও পড়ে রয়েছে গাছ। বহু জায়গায় জমে জল। ঢাকা এবং চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকা এখনও বিদ্যুৎহীন। বর্তমানে চট্টগ্রাম এবং ঢাকার প্রায় ৮০ লক্ষ বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই। সব মিলিয়ে প্রায় ১০ হাজার বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত। ১০ লক্ষ মানুষ ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তবে তাঁদের মধ্যে এখন অধিকাংশই অবশ্য বাড়ি ফিরে গেলেও দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।

বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে খুলনা, বরিশাল এবং চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। উপকূলবর্তী জেলাগুলির নদীতে জলস্ফীতি ঘটেছে ব্যাপক। যখন তখন প্লাবন দেখা দিতে পারে। বাংলাদেশের আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড় অতিক্রম করার সময় উপকূলবর্তী এলাকায় ঝড়ের বেগ ছিল ঘণ্টায় ৮০ থেকে ১০০ কিলোমিটার। বরিশাল, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার বিমানবন্দরে সোমবার বিকেল থেকে বিমান ওঠানামা বন্ধ করে দেওয়া হয়। বন্ধ রাখা হয় ফেরি ও নৌকো চলাচল। বেশির ভাগ এলাকা এখনও বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন।

সিত্রাংয়ের প্রভাবে জলমগ্ন ঢাকা

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাব বেশি পড়েছে বাংলাদেশের ১৩টি জেলায়। যেসব জেলায় ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব পড়েছে তার মধ্যে রয়েছে, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা, ঝালকাঠি, ভোলা, পটুয়াখালি, লক্ষ্মীপুর, চাঁজপুর, নোয়াখালি, ফেনি ও বরিশাল। তবে এইসব জেলায় আগে থেকে সতর্কতা জারি করার পাশাপাশি বহু মানুষকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এখনও বিস্তীর্ণ এলাকায় গাছ পড়ে থাকায় উদ্ধারকার্য বারবার ব্যাহত হচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। খুব কষ্ট করে মোবাইলে যোগাযোগ করা যাচ্ছে একে অপরের সঙ্গে। নেটওয়ার্ক প্রায় নেই বললেই চলে। শোনা যাচ্ছে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হওয়ার পর থেকে সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ছিল এই সিত্রাং। বাংলাদেশের সরকারের তরফে যথাসাধ্য চেষ্টা করা হচ্ছে মানুষজনকে ঘরে ফেরানোর এবং গৃহহারাদের সাময়িক একটা ব্যবস্থা করে দেওয়ার। একজন উচ্চপদস্থ সরকারি আমলা জানিয়েছেন তাদের কাছে এখনও সঠিক ক্ষয়ক্ষতির সম্পূর্ণ রিপোর্ট এসে পৌঁছয়নি। ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত রিপোর্ট হাতে এলে ক্ষতিপূরণের ঘোষণা করতে পারে সে দেশের সরকার।

ক্রমাগত বৃষ্টি হচ্ছে অসমে

রবিবার এবং সোমবার সিত্রাংয়ের কারণে কলকাতা এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে হালকা বৃষ্টিপাত দেখা গিয়েছিল। তবে বর্তমানে বাংলাদেশে আছড়ে পড়ার কারণে ভারী বৃষ্টিপাত দেখা গিয়েছে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। গতকাল বিকেল থেকে আজ ভোর পর্যন্ত ভারী বৃষ্টি দেখা গিয়েছে অসম, অরুণাচল প্রদেশ, মেঘালয়, মিজোরাম এবং ত্রিপুরায়। আইএমডির রিপোর্ট অনুযায়ী, মেঘালয় এবং বাংলাদেশ সীমান্ত অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ের কারণে একটি নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছে। ফলত বুধবার সন্ধেবেলা পর্যন্ত বৃষ্টিপাত চলতে পারে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন জায়গায়। অসম, ত্রিপুরা, মেঘালয়ের কিছু অঞ্চলে ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটার বেগে বইতে পারে ঝড়ো হাওয়া। অরুণাচল প্রদেশের হাওয়ার গতিবেগ থাকতে পারে ৪০ কিলোমিটারের আশেপাশে। তবে আবহাওয়াবিদদের মতে, বুধবারের পর ভারতবর্ষে এই ঘূর্ণিঝড়ের আর প্রভাব সেরকম দেখা যাবে না।

More Articles