‘খান মার্কেট গ্যাং’! ‘ঘুসপেটিয়া’র পর দেশের মুসলিমদের নতুন তকমা মোদির
Lok Sabha Election 2024: লোকসভা ভোটের আগে মোদির সবচেয়ে বেশি আক্রমণ করেছেন সংখ্যালঘুদের। আর বিরোধী দলদের আক্রমণের মোড়কে বেশিরভাগ সময়েই লঘুগুরু মাত্রা হারিয়েছেন মোদি।
লোকসভা নির্বাচন ২০২৪। তৃতীয় বার দিল্লির তখ্ত দখল করতে পারবে মোদি সরকার। সেই ভাগ্য নির্ধারণ হবে আগামী ৪ জুন। তবে এবারের লোকসভা ভোটের প্রচারে যেন একটু বেশিই লাগামছাড়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কখনও তিনি নিজেকে দাবি করছেন ঈশ্বরের 'অবতার', কখনও আবার নিজেকে দেখাচ্ছেন 'মেসেঞ্জার অব গড' হিসেবে। লোকসভা ভোটের আগে মোদির সবচেয়ে বেশি আক্রমণ করেছেন সংখ্যালঘুদের। আর বিরোধী দলদের আক্রমণের মোড়কে বেশিরভাগ সময়েই লঘুগুরু মাত্রা হারিয়েছেন মোদি।
একদিন আগেই কলকাতা হাইকোর্টের রায়ে বাতিল হয়ে গিয়েছে তৃণমূল সরকারের আমলের প্রায় ৫ লক্ষ ওবিসি সার্টিফিকেট। সেই নিয়ে ভোটের আগে সরগরম রাজ্য রাজনীতি। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই তৃণমূল সুপ্রিমো তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে জোর আক্রমণ শানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। মমতাকে আক্রমণ করতে গিয়ে কার্যত ফের সংখ্যালঘুদের আক্রমণের পথেই হেঁটেছেন তিনি। একটি প্রচার জনসভায় মোদিকে বলতে শোনা যায়, "কলকাতা হাইকোর্ট তাঁর ওবিসি রায়ের মাধ্যমে কার্যত ইন্ডিয়া জোটের মুখে জোরালো এক থাপ্পর কষিয়েছে।" ২০১০ সালের পরবর্তীকালে রাজ্যের দেওয়া সমস্ত ওবিসি সার্টিফিকেট অবৈধ বলে জানিয়ে দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। মোদির মতে, এটা হয়েছে কারণ পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই ওবিসি সার্টিফিকেট বেছে বেছে মুসলিমদেরই দিয়েছে। মুসলিম ভোটব্যাঙ্কের কথা চিন্তা করেই এ কাজ করেছে রাজ্য সরকার।
আরও পড়ুন: ‘মুসলিম বন্ধুদের মধ্যেই বড় হয়েছি!’ মনোনয়ন জমা দিয়েই কেন পাল্টি মোদির?
না, এখানেই শেষ নয়। মোদির কুকথার জের এখানেই শেষ হয়নি। বরং আরও এক ধাপ সুর চড়িয়ে তিনি বলেন, "আজ আদালত সজোরে চড় কষিয়েছে। এই খান মার্কেট গ্যাং পাপের অংশীদার। তাদের দাবি, এ দেশের সম্পদের উপর প্রথম অধিকার এ দেশের মুসলিমদের। তারা একের পর এক সরকারি জমি ওয়াকফ বোর্ডের হাতে তুলে দিয়েছে। আর তার বদলে চেয়েছে ভোট। এই সব লোকেরা দেশের বাজেটের ১৫ শতাংশ সংরক্ষণ চায় সংখ্যালঘুদের জন্য। ধর্মের ভিত্তিতে সরকারি টেন্ডার, ব্যাঙ্কের লোন পর্যন্ত দিতে চায় এরা।" নাম না করেই মমতা সরকার এবং সংখ্যালঘুদের আক্রমণ করে যান মোদি। সিএএ-র বিরোধিতা এমনকী তিন তলাকের বিরোধিতাও আসলে ভোটব্যাঙ্কের দিকে চেয়ে বলে কটাক্ষ করেন মোদি। তাঁর দাবি, এ কারণেই 'ইন্ডিয়া' জোট তৈরি করা হয়েছে।
প্রতিবারই মোদির আক্রমণের নিশানায় থেকেছেন এ দেশের মুসলিমরা। কখনও তিনি তাঁদের 'ঘুসপেটিয়া' বলেছেন, কখনও বেশি সন্তান উৎপাদকারী বলে দেগে দিয়েছেন। এবার তাঁর নতুন লব্জ্য 'খান মার্কেট গ্যাং'। কী এই খান মার্কেট গ্যাং। দক্ষিণ দিল্লির একটি বিখ্যাত বাজার রয়েছে, যা খান মার্কেট নামে খ্যাত। দেশের মুসলিমদের আক্রমণ করতে এবার সেই খান মার্কেটের প্রসঙ্গ তুলে এনেছেন মোদি। মেরুকরণের রাজনীতির বীজ বুনতে বুনতে মোদি আসলে গুলিয়ে ফেলেছেন, ওবিসি বলতে শুধু মুসলিমদের বোঝায় না। আরও নানা পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ও পড়ে সেই শ্রেণিতে। মোদি এই ধরনের কথা বলে শুধু দেশের সংখ্যালঘুদের নয়, তাঁদেরও অপমান করেছেন নতুন করে।
এই সব দৃশ্য অবশ্য এই লোকসভা ভোটের বাজারে জলভাত হয়ে গিয়েছে এত দিনে। কিছুদিন আগেই কংগ্রেসকে আক্রমণ করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে সাধারণ মানুষের সোনাদানা, মঙ্গলসূত্র ছিনিয়ে নিয়ে 'ঘুসপেটিয়া'দের মধ্যে বিলিয়ে দেবে। কখনও আবার কংগ্রেসকে আক্রমণ করে তিনি বলেছেন, রামমন্দিরে বাবরি-তালা ঝোলাতে চায় বিরোধী দল। এই বছরই মহাধূমধাম করে অযোধ্যায় রামমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছে গেরুয়া শিবির। আর সেই মন্দিরের প্রতিটা ইট, কাঠ, পাথর যে গাথা হয়েছে ২০২৪ লোকসভা ভোটের কথা মাথায় রেখে, তাতে সন্দেহ নেই। এই ভোটি বিজেপি সরকারের যে সব চেয়ে বড় ভরসার জায়গা ছিল হিন্দুভোট, আর গোড়া থেকে সে দিকে তাকিয়েই সমস্ত কর্মসূচী, অনুষ্ঠান, পরিকল্পনা সাজিয়েছিল গেরুয়া শিবির। সেই রামমন্দির প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে কিন্তু লুকিয়ে রয়েছে ভারতবর্ষের ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়। ১৯৯২ সালে অযোধ্যার মোঘল সময়কার বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দিয়েছিল উগ্রবাদী বিজেপি ও আরএসএস নেতৃত্ব। হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। দেশ জুড়ে ছড়িয়েছিল হিংসা। বিজেপি শাসনে সুপ্রিম কোর্টের রায় শেষপর্যন্ত অবশ্য গিয়েছিল রামমন্দিরের পক্ষেই। বাবরির ধ্বংসস্তূপের উপরেই গড়ে ওঠে আজকের রামমন্দির। সে জন্যই কি মোদির মতো নেতাকে সবসময় তাড়া করে ফেরে বাবরি ইস্যুর ভূত। নাহলে জনসভায় দাঁড়িয়ে কেন বলেন মোদি, কংগ্রেস চায় রামমন্দিরে বাবরি তালা ফেলতে। ভোটের মুখে মুখে এসব বলে অবশ্য নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন মোদি। জানিয়েছিলেন, তিনি এমন কিছু আদৌ বলতে চাননি।
আরও পড়ুন: ২০০৩-২০২৪: যে ভাবে বারবার মুসলিম-ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগ উঠেছে নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে
কিন্তু ভোটের উত্তাপ বোধহয় নাড়িয়ে দিচ্ছে পোড় খাওয়া রাজনীতিক ও দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকেও। সে কারণেই যে কথা তিনি একবার অস্বীকার করেছেন, অন্য একটি সভায় গিয়ে ফের সে কথাই বলে বসছেন বারবার। নিন্দুকরা বলেন, মোদি আসলে মিথ্যা বলতে বলতে খেই হারাচ্ছেন। ফলে এক মিথ্যা বারবার ক্লান্ত ভাবে আউড়ে যাচ্ছেন মোদি। সম্প্রতি মোদির একনিষ্ঠ এক বিজেপি নেতা বলে বসেন, খোদ জগন্নাথ দেব নাকি মোদির ভক্ত। সেই নিয়ে জোর বিতর্ক হয় দেশ জুড়ে। কিছুদিন পরেই শোনা গেল, মোদি নিজেই নিজেকে ভগবানের অবতার বলে দাবি করছেন। তাঁকে দিয়ে খোদ ঈশ্বর এত সব কাজকর্ম করিয়ে নেন বলে ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতি চওড়া করেছেন। যে নেতা নিজের দেবত্ব নিয়ে এমন অকুণ্ঠ, এমন সরব, তাঁর ভক্তরা যে তাঁকে জগন্নাথেরও উপরে বলে ভাববেন তাতে আর আশ্চর্য কী! কিছুদিন আগে বারাণসীতে মনোনয়ন জমা দেওয়ার পরেই নিজের ছোটবেলার মুসলিম সংস্পর্শ, ছোটবেলায় মুসলিম পড়শিদের সঙ্গে কাটানো স্মৃতির কথা বলে ভোটবাক্স নিশ্চিত করতে লেগেপড়ে ছিলেন। হবে না-ই বা কেন। বারাণসীর ১৪ শতাংশ যে মুসলিম ভোট। অথচ তার রেশ কাটতে না কাটতেই ফের মুসলিমদের বিরুদ্ধে কুকথা বলতে পিছু হঠলেন না মোদি। ঘুসপেটিয়া, বহু সন্তানের জন্মদানকারী থেকে এবার তাঁদের নতুন উপাধি হল 'খান মার্কেট গ্যাং'! প্রশ্ন জাগে, মেরুকরণ, হিন্দুত্ববাদের এই ভয়াবহ রাজনীতি করে আদৌ লোকসভা ভোটের ভবনদী পার হতে পারবেন খোদ ভগবানের অবতার নরেন্দ্র মোদি? সে প্রশ্নের উত্তর মিলতে আর মাত্র কয়েকটা দিন।