হারানো যৌন উদ্দীপনা থেকে দৃষ্টিশক্তি ফেরাতে পারে সাপের বিষে তৈরি ওয়াইন!

ভিয়েতনামের সংস্কৃতিতে যেহেতু সাপ, ‘তাপ’ কিম্বা ‘ পুরুষত্বের প্রতীক’ হিসাবে কল্পিত হয়ে থাকে - তাই পুরুষালি যে কোনো সমস্যার সমাধান হিসাবে স্নেক হোয়াইন একটি স্বনামধন্য কামোদ্দীপক হিসাবে বিশেষ জনপ্রিয়।

সাপের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক খানিক ঠাকুমার ঝুলির গল্পের মতো – কখনো মজার আবার কখনো বা ভয়ের। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ যেমন জীবিকা নির্বাহের কারণে সাপকে বশ মানিয়েছে, আবার ঠিক সেইভাবেই সাপের ছোবল প্রাণ কেড়েছে বহু মানুষের। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু এই সম্পর্ক আরো গভীর হয়েছে। একদিন যে সাপের বিষ মানুষের প্রাণ কাড়ত, ক্রমে তা রূপ নিল মানুষের প্রাণদানকারী ওষুধে আর সাপের বিষের এই গুণাগুণ থেকেই একসময় জন্ম নিল স্নেক ওয়াইন।

ইতিহাস বলছে, আজ থেকে বহু বছর আগে এই স্নেক ওয়াইন চিন দেশের পশ্চিমে ঝো রাজবংশে (৭৭১ খ্রীস্টপূর্বাব্দ) চিকিৎসাক্ষেত্রে ব্যবহৃত হত । এমনকী ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দ এর মধ্যে সংকলিত ‘শেন নং বেন কাও জিং’ নামে একটি চিকিৎসা বিষয়ক বইতে এই সাপের ঔষধির কথাও উল্লেখ করা আছে। সাপের বিভিন্ন অঙ্গ – প্রত্যঙ্গ কীভাবে চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতে পারে, সেই বিষয়েও বিশদে বর্ণিত হয়েছে লি শিজেনের লেখা ‘গাংমু’ নামক বইতে। শুধু চিন দেশেই নয়, অতীত সময়ে গ্রিস দেশেও প্লাসেন্টাসের চিকিৎসায় স্নেক ওয়াইনের ব্যবহার করা হত। ব্রাজিলে আবার বিষাক্ত পোকামাকড়ের কামড় বা বাতের ব্যথা অথবা পুরুষত্বহীনতার ওষুধ হিসাবে সাপের ব্যবহার করা হয়। তবে এক্ষেত্রে সাপকে ওয়াইন নয় আখের রসে দীর্ঘদিন চুবিয়ে রাখা হয়। অনেকেই, এই স্নেক হোয়াইন বাত, কুষ্ঠ, ফ্লু, চুল পড়া, শুষ্ক ত্বক, জ্বর কিম্বা মাইগ্রেনের ব্যাথার মত সমস্যাগুলিতে ওষুধের ন্যায় কাজ করে থাকে বলে মনে করেন। শুধু তাই নয়, দৃষ্টি ক্ষমতা বাড়াতেও স্নেক হোয়াইনের গুরুত্ব অপরিসীম বলে অনেকে মনে করেন। ভিয়েতনামের সংস্কৃতিতে যেহেতু সাপ, ‘তাপ’ কিম্বা ‘ পুরুষত্বের প্রতীক’ হিসাবে কল্পিত হয়ে থাকে - তাই পুরুষালি যে কোনো সমস্যার সমাধান হিসাবে স্নেক হোয়াইন একটি স্বনামধন্য কামোদ্দীপক
হিসাবে বিশেষ জনপ্রিয়।

কোথায় পাওয়া যায় এই স্নেক ওয়াইন?

প্রাচীনকালে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এই ওয়াইনের ব্যাপক প্রচলন থাকলেও, বর্তমানে এশিয়ার কম্বোডিয়া, চিন, জাপান, কোরিয়া, লাওস, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনামে এই ওয়াইনের বিশেষ চল রয়েছে। ভিয়েতনামের যে কোনো বাজারের রাস্তা ধরে হাঁটলেই দেখা মেলে সারি সারি কাঁচের বোতলে সাজিয়ে রাখা স্নেক ওয়াইনের। বর্তমানে অবশ্য স্নেক হোয়াইন চিকিৎসাক্ষেত্রে নয় বরং বাণিজ্যিক ক্ষেত্রেই বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ইউরোপ কিম্বা আমেরিকায় এই পানীয় কিন্তু একেবারেই বেআইনি, তবে ভারতের গোয়াতে দেখা মিললেও মিলতে পারে এই ওয়াইনের।

কীভাবে তৈরি করা হয় এই স্নেক ওয়াইন?

মূলত দুটি পদ্ধতিতে এই স্নেক ওয়াইন তৈরি করা হয়। প্রথম পদ্ধতি অনুযায়ী, আস্ত বড়ো একটা সাপকে রাইস ওয়াইনের অথবা শস্য নির্মিত কোন হোয়াইনের বোতলে চুবিয়ে দেওয়া হয়। এইক্ষেত্রে মৃত সাপের ব্যবহার যেমন করা হয়ে থাকে, তেমনই আবার কখনো কখনো জীবিত সাপকেই ঢুকিয়ে দেওয়া হয় ওয়াইনের জারে। কয়েকমাস এই অবস্থাতেই রেখে দেওয়ার পর নিজে থেকেই প্রস্তুত হয়ে যায় এই স্নেক হোয়াইন। এখন আপনার মনে হতেই পারে, বিষাক্ত সাপের ব্যবহারও কি করা হয়ে থাকে এই ওয়াইন প্রস্তুতিতে? হ্যাঁ, ওয়াইন প্রস্তুতকারকরা কিন্তু সাপ নির্বাচনের ক্ষেত্রে কোনো বাচবিচার করেন না। তবে, ওয়াইনে উপস্থিত ইথানল যে কোনো বিষধর সাপের বিষ বিনাশে সম্পূর্ণভাবে সক্ষম হওয়ায় সেক্ষেত্রে চিন্তার কোন কারণ বিশেষ নেই। অনেকসময় আবার স্বাদ বৃদ্ধির উদ্দেশে সাপের সঙ্গে কিছু পোকা মাকড়কেও চুবিয়ে দেওয়া হয় সেই একই জারে এবং দুর্গন্ধ কাটানোর উদ্দেশে যোগ করা হয় বিশেষ কিছু মশলা এবং বেরি জাতীয় কিছু ফল।

আরও পড়ুন-ছেলে নিহত হাতির হানায়, সাপের সঙ্গে বাস! ‘জঙ্গলের মা’ কেমন আছেন?

এই পদ্ধতিতে যেহেতু জারে আটকে থাকা সাপগুলি বেশিভাগ ক্ষেত্রেই কুণ্ডলী পাকানো অবস্থাতেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে তাই, এই জারগুলি দূর থেকে দেখতেও লাগে ভারি সুন্দর। তবে এই পদ্ধতিতে স্নেক ওয়াইন বানানোর ক্ষেত্রে সাপের প্রাণঘাতী আক্রমণের মুখেও পরেছেন অনেকেই। যদি সাপটি সম্পূর্ণভাবে ওয়াইনে নিমজ্জিত না হয়ে থাকে, তাহলে সে কয়েকমাস অবধি প্রাণে টিকে যায়। ২০১৩ সালে চিনের হেইলংজিয়াং-এর এক মহিলা এই আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। তিনি অবশ্য বাতের ব্যাথা থেকে মুক্তির আশায় বাড়িতেই এই হোয়াইন প্রস্তুত করতে গেছিলেন কিন্তু প্রায় তিনমাস পরে যখন তিনি হোয়াইন জারের ঢাকনা খোলেন, তখন জারে বন্দি সাপটি তাঁকে ছোবল মারে। অধিকাংশক্ষেত্রে এই পদ্ধতির অনুসরণ করা হয়ে থাকে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আবার জীবিত সাপকে হত্যা করে সঙ্গে সঙ্গেই তার রক্ত এবং পিত্ত মিশিয়ে দেওয়া হয় হুইস্কি কিম্বা অন্য কোন মদ্য পানীয়তে।

স্নেক ওয়াইনের বিড়ম্বনা

পুরনো সংস্কারের বশে যেসব তথাকথিত ওষুধগুলো সচরাচর আমরা আজকের দিনেও ব্যবহার করে থাকি, একটু খেয়াল করলেই দেখা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা কোনো উদ্ভিদ কিম্বা কোন প্রাণীর দেহাবশেষ দ্বারাই নির্মিত। বলাবাহুল্য, এইরূপ ওষুধে ব্যবহৃত প্রাণীদের মধ্যে শীর্ষস্থানে অবস্থান করছে সরীসৃপ প্রজাতি। গণনা করে দেখা গেছে, সারা বিশ্ব জুড়ে এইসব ঐতিহ্যবাহী ওষুধের খাতিরে কমবেশি প্রায় ২৮৪ ধরনের সরীসৃপ প্রজাতির হত্যা করা হয়ে থাকে, যার মধ্যে ১৮২ টি প্রজাতি ‘ইন্টারন্যশনাল ইউনিয়ন ফর কনসারভেশন অব ন্যেচার’ এর লাল তালিকায় অবস্থান করছে - অর্থাৎ এই প্রজাতির সরীসৃপরা বর্তমানে বিলুপ্ত প্রায় প্রাণীতে পরিণত হয়েছে। একথা একেবারেই অনস্বীকার্য যে, প্রাচীনকাল থেকে যেসমস্ত আয়ুর্বেদিক ওষুধ ব্যবহৃত হয়ে আসছে তা অনেকক্ষেত্রেই রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে চমকপ্রদ ফল দিতে সক্ষম। এমনকি আজকের দিনের অনেক ওষুধও সেইসব ওষুধকে অনুসরণ করেই প্রস্তুত করা হয়ে থাকে। যেমন, সাপের বিষের গুণাগুণ সম্পর্কে আমরা সকলেই কমবেশি অবগত। এই বিষ যেমন একদিকে নানান ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এবং ডায়াগনাস্টিক টুলের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তেমনই আবার অন্যদিকে এই বিষ থেকেই হাইপারটেনশন, হৃদরোগ কিম্বা থ্রম্বোসিসের মত রোগের ওষুধ প্রস্তুত করা হয়।

এইসব তো গেল, সাপের বিষের গুণাগুণের কথা। এখন প্রশ্ন হল, যদি ওয়াইনে উপস্থিত অ্যালকোহল সম্পূর্ণভাবে বিষকে বিনাশ করতে সক্ষম হয়, তবে সাপকে মাসের পর মাস ধরে ওয়াইন জারে চুবিয়ে রেখে প্রস্তুত করা স্নেক ওয়াইন কি আদৌ রোগ নিরাময়ে কোন ভূমিকা নিয়ে থাকে? এই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু বর্তমান চিকিৎসাশাস্ত্র একেবারেই জানে না। তবে এইভাবেই মানুষের শৌখিনতার কারণে যদি সাপ হত্যা করে ক্রমাগত স্নেক ওয়াইন প্রস্তুত করার এই প্রথা চলতেই থাকে, তবে ভবিষ্যতে সাপের বিষ থেকে নির্মিত ওষুধ কিনতে গিয়ে যে আমাদের মত সাধারণ মানুষদের রীতিমতো হিমশিম খেতে হবে, একথা মনে হয় ইতিমধ্যেই সকলে বুঝতে পারছি। বলে রাখা ভালো, অতিরিক্ত মুনাফায় লোভে কিন্তু অনেক সময় কোবরা সাপের বদলে ওয়াইনে অন্যান্য সাপের ব্যবহারও করে থাকে ওয়াইন বিক্রেতারা।

More Articles