নড়ে উঠল পাতা, ধেয়ে এল ট্রেন! যেভাবে পর্দায় এল বিশ্বের প্রথম সিনেমা
World's First Movie Camera: ১৮৮৬-এর নভেম্বরের এক হাড় কনকনে সকালে এডিসন ডেকে পাঠালেন ডিকসনকে, তাঁকে দায়িত্ব দিলেন এডিসনের ফোনোগ্রাফের আওয়াজের সঙ্গে জ্যুট্রোপের ছবিকে মেলানো যায় কী না।
ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর লেল্যান্ড স্ট্যানফোর্ড একাধারে ছিলেন রেসুড়ে আর ঘোড়ার ব্যবসায়ী। ১৮৭২ সালে ফ্রেডরিক ম্যাকক্রোলিশ নামে এক বন্ধুর সঙ্গে তাঁর তর্ক বাধে। একটা ঘোড়া যখন লাফাতে লাফাতে ছোটে, সেই সময় কখনও কি ঘোড়ার চারটি পা-ই শূন্যে থাকে? স্ট্যানফোর্ড বললেন, ‘হ্যাঁ’। ম্যাকক্রোলিশ বললেন, ‘না’। বাজি ধরা হল। স্ট্যানফোর্ডের অনুরোধে এডওয়ার্ড মুব্রিজ নামে এক ক্যামেরাম্যান এই প্রমাণের দায়িত্ব নিলেন। তখনকার ক্যামেরা ছিল বেশ অনুন্নত। বহুবার ক্যালিফোর্নিয়ার স্যাকরামান্টো ঘোড়দৌড়ের মাঠে তাঁর তেপায়া ক্যামেরা নিয়ে গিয়েও সফল হলেন না মুব্রিজ। এদিকে এক খুনের মামলায় মুব্রিজের পাঁচ বছর জেল হল। এতে শাপে বর হল। জেলে বসে স্ট্যানফোর্ড আইজাক নামের এক ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে আলোচনা করলেন কীভাবে কী করা যায়। আর ওদিকে ক্যামেরাও উন্নত হয়েছে অনেকটা। মুব্রিজ জেল থেকে ছাড়া পাবার পর ১৮৭৮ সালের ১৫ জুন গালো অল্টো নামে এক স্টেডিয়ামে ছবি তোলার ব্যবস্থা হল। ঘোড়দৌড়ের পথের ধারে চল্লিশ ফুট অন্তর একটি করে ক্যামেরা বসালেন মুব্রিজ। চল্লিশ ফুট, কারণ স্ট্যানফোর্ডের ঘোড়া সেকেন্ডে চল্লিশ ফুট গ্যালপ করে। মোট বারোটা ক্যামেরা বসানো হল। প্রতিটার সঙ্গে একটি করে সুতো, ছুটন্ত ঘোড়া এক একটি সুতোতে টান দিলেই ছবি উঠে যাবে। আইজাক বানালেন বিশেষ ধরনের শাটার।
যথারীতি ছবি উঠল, স্ট্যানফোর্ডের খরচা হল প্রায় চল্লিশ হাজার ডলার। দেখা গেল, সত্যিই ঘোড়ার চারটি পা শূন্যে থাকে। ঘোড়ার এই ছবির কথা কানে এল ফরাসি বিজ্ঞানী মেসোনিয়ের কানে। তিনি জ্যুট্রোপে এই ঘোড়ার ছবি ব্যবহার করতেই ছুটন্ত ঘোড়া যেন জীবন্ত হয়ে উঠল। এদিকে পিয়ের জ্যানসেন নামে এক ফরাসি জ্যোতির্বিদ একটি ‘রিভলভার’ ক্যামেরা আবিষ্কার করেন। রিভলভার, কারণ এই ক্যামেরার মধ্যে থাকা ফোটোগ্রাফিক লেন্সটিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একের পর এক ফটো তোলা হত। বন্দুকের ঘোড়া টানলেই এক একটি নেগেটিভ সামনে চলে আসত। ১৮৭৪ সালের ডিসেম্বরে শুক্র গ্রহ পৃথিবীর সামনে যখন চলে আসে, তখন তিনি এটির সাহায্যে ছবি তোলেন, এখান থেকেই পরবর্তীকালে চলচ্চিত্রগ্রহণের নাম হয়ে যায় ‘শুটিং’। মনে রাখতে হবে, এই রিভলভার ক্যামেরাই কিন্তু আধুনিক মুভি ক্যামেরার পূর্বপুরুষ।
সারা বিশ্বে যখন চলচ্চিত্র নিয়ে গবেষণা চলছিল, মেনলো পার্কের নিজের ল্যাবরেটরিতে বসে নিরলসভাবে শব্দকে বন্দি করার আবিষ্কারে মেতে ছিলেন বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন। তিনি কাজ করছেন ফোনোগ্রাফ যন্ত্র নিয়ে। তাঁর গবেষণাগারে ইলেকট্রিক্যাল টেস্টিংয়ের প্রধান ছিলেন বছর ছাব্বিশের উইলিয়াম ডিকসন। ১৮৮৬-এর নভেম্বরের এক হাড় কনকনে সকালে এডিসন ডেকে পাঠালেন ডিকসনকে, তাঁকে দায়িত্ব দিলেন এডিসনের ফোনোগ্রাফের আওয়াজের সঙ্গে জ্যুট্রোপের ছবিকে মেলানো যায় কী না। অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। তিন বছর কেটে গেল। ১৮৮৯-এ ডিকসনের কাছে খবর এল, জর্জ ইস্টম্যানের ‘কোডাক’ কোম্পানি নাকি নমনীয় পাতলা ফিল্ম বানিয়েছে। এই ফিল্ম হাতে পেয়েই নতুন উদ্যমে কাজ শুরু হল। এদিকে এডিসন গেলেন ইউরোপ ভ্রমণে। ফিরে আসামাত্র ডিকসন তাঁর হাত ধরে সোজা চলে গেলেন ওয়েস্ট অরেঞ্জ স্টুডিয়োতে। দরজা খুলতে অন্ধকার। এডিসনের মানিয়ে নিতে খানিক সময় লাগল। হঠাৎ দেখলেন, সামনে পর্দায় ডিকসন তাঁকে টুপি খুলে অভিনন্দন জানিয়ে বলছেন, "Good morning Mr. Edison: glad to see you back. I hope you are satisfied with Kineto-phonograph." ইতিহাস সৃষ্টি হল। ১৮৮৯ সালের ৬ অক্টোবর পর্দায় এলোপৃথিবীর প্রথম সবাক চলচ্চিত্র।
আরও পড়ুন- চারশো টাকা না পেলে হাসপাতাল থেকে ফিরত না স্ত্রী! যেভাবে আমজাদ খান হলেন গব্বর সিং
ঠিক এই জায়গায়, যেখানে এডিসনের এক পা এগোনোর কথা ছিল, তিনি দুই পা পিছিয়ে গেলেন। তাঁর মনে হল, পর্দায় দেখানো ছবি মানুষ পছন্দ করবে না, বরং পিপ-শো, যাতে বাক্সের ভেতর নানা জিনিস দেখানো হয়, লোকে সামনের কাচে উঁকি মেরে দেখে, তেমন করলেই ভালো হয়। ফলে এডিসনের পিপ-শো মেশিনের নাম রাখা হল কিনেটোস্কোপ। এতে চোখ রেখে একসঙ্গে একজনের বেশি দর্শক দেখতে পেতেন না। তাও দেখতে হত কালো বাক্সের ফুটোতে চোখ রেখে। হাজারে হাজারে কিনেটোস্কোপ বিক্রি হতে লাগল। তবুও এডিসন একে বাচ্চাদের খেলনা ছাড়া কিছুই ভাবলেন না। বরং তিনি অনেক বেশি সিরিয়াস ছিলেন ফোনোগ্রাফ যন্ত্রটি নিয়ে। ইতোমধ্যে গ্রে ও ওটওয়ে ল্যাথাম নামে দুই মার্কিন ওষুধ ব্যবসায়ীর ব্যবসা ভালো চলছিল না। তাঁরা কিনেটোগ্রাফ ক্যামেরায় ছবি তুলে কিনেটোস্কোপে দেখানো শুরু করেন। ঠিক এই সময় এই যন্ত্রের আরও একটি সমস্যা তাঁদের চোখে পড়ে। এক এক করে কিনেটোস্কোপ দেখানোর চেয়ে একসঙ্গে অনেককে পর্দায় ফেলে দেখানো অনেক সুবিধার। ফলে কিনেটোস্কোপের চলচ্চিত্র তাঁরা প্রোজেক্টরের মাধ্যমে পর্দায় দেখাতে উদ্যোগী হন। কিন্তু স্বয়ং এডিসন এই খবরে মারাত্মক রেগে যান, এমনকী ল্যাথামদের বিরুদ্ধে মামলারও হুমকি দেন। এডিসন তখন বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানী। ফলে তাঁর সঙ্গে লড়াইয়ের সামর্থ ল্যাথামদের ছিল না। তাঁরা পিছু হটলেন।
১৮৯৪-এর অক্টোবরে প্যারিসে কিনেটোস্কোপ দেখলেন দুই লুমিয়ের। প্রথমেই তাঁদের মাথায় এল পর্দায় প্রোজেকশনের কথা। কিন্তু ল্যাথামদের খবর তাঁদের জানা ছিল, তাই নিউ ইয়র্ক সেলুলয়েড কোম্পানি থেকে কাঁচা সেলুলয়েড এনে নিজেদের কারখানার কেমিক্যাল লাগিয়ে উপযুক্ত ফিল্ম নিজেরাই বানিয়ে নিলেন। প্রায় পাঁচ মাস অমানুষিক পরিশ্রম করে তাঁরা সেকেন্ডে ষোলোটা ছবি তোলার মেশিন আবিষ্কার করলেন। এডিসনের যন্ত্র বিদ্যুতে চলত আর লুমিয়েরদের যন্ত্রে একটা খাঁজকাটা হাতল ছিল। একবার ঘোরালে আটটা ফ্রেমে ছবি উঠত। তাই সেকেন্ডে দু'বার হাতল ঘোরাতে হত। দেখতে ছোটোখাটো সিগারকেসের মতো। হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়া যায় অনায়াসে। কিনেটোস্কোপ এর পাশে বিশাল এক জগদ্দল যন্ত্র। ১৮৯৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি লুমিয়েররা তাঁদের যন্ত্রের পেটেন্ট নিলেন, নাম দিলেন ‘সিনেমাটোগ্রাফ’। তুললেন নানা বহির্দৃশ্যের ছবি।
১৮৯৫ সালের ১০ জুন, প্যারিসের এক বন্ধ ঘরে টাঙানো সাদা পর্দার সামনে বসে রয়েছেন ফরাসি ফোটোগ্রাফি সোসাইটির জনা কয়েক সদস্য। তাঁরা সঠিক বুঝতেও পারছেন না কী ঘটতে চলেছে। চিত্রকর আঁতোয়া লুমিয়ের দুই ছেলে লুই আর অগুস্ত তাঁদের রীতিমতো নেমন্তন্ন করে ডেকে এনেছে। আর এঁরা নিতান্ত অজ্ঞাতকুলশীল নয়, লিওঁতে তাঁদের ফোটোগ্রাফিক প্লেটের রমরমা ব্যবসা। তিনশো লোক কাজ করে সে কারখানায়। বছরে তৈরি হয় প্রায় এক কোটি পঞ্চাশ লক্ষ কাচের ফোটোগ্রাফিক প্লেট। সেলুলয়েড আবিষ্কারের আগে এই ধরনের কেমিক্যাল মাখানো কাচের প্লেটেই ছবি তোলা হত। তাঁরা আবার নতুন কী দেখাবেন ভেবে সবাই বেশ আগ্রহী ছিলেন।
আরও পড়ুন- স্টিয়ারিং বুকে লেগে স্পট ডেথ— সিনেমায় আর ফেরা হয়নি ছবি বিশ্বাসের
ছবি শুরু হল। প্রোজেক্টরের ক্যারকেরে আওয়াজ আর লাইমলাইটের উজ্জ্বল সাদা আলোতে চোখ-কান দুটো ধাঁধিয়ে যাবার জোগাড়। তবু তারই মধ্যে দেখা গেল, একদল শ্রমিক দিনশেষে বেরিয়ে আসছে লুমিয়ের কারখানা থেকে। সবাই এবার নড়েচড়ে বসলেন। দেখানো হল অগুস্তের সেই প্রাতঃরাশের দৃশ্য। পেছনে গাছের পাতা নড়তে দেখে সবাই অবাক। থিয়েটারে তবু মানুষকে নড়াচড়া করতে দেখা যায়, কিন্তু সত্যিকারের গাছের পাতা নড়তে এর আগে পর্দায় দেখেননি কেউ। মজা হল কিছু বাদে। প্ল্যাটফর্মের কিনারা থেকে তোলা সেই দৃশ্যে অনেক দূর থেকে ক্রমাগত সামনে এগিয়ে আসছে একটি ট্রেন। ট্রেন সামনে আসতেই সামনে বসা দর্শকরা শিউরে উঠে মাথা নিচু করে চেয়ার ছেড়ে বসে পড়ে। ভাবে, এই বুঝি সেই ট্রেন চাপা দিল তাদের। আজকের দিনে ব্যাপারটা যতই হাস্যকর লাগুক না কেন, প্রথমবার চোখে থ্রি-ডি চশমা লাগিয়ে সিনেমা দেখতে গিয়ে অনেককেই আমি এখনও এমন করতে দেখেছি। আসলে আগে কোনও দিন অমন ধেয়ে আসা ট্রেন তো কেউ দেখায়নি পর্দায়! এক এক মিনিটের এই দৃশ্যগুলো দেখানো শেষ হলে সবাই উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিলেন। সাহস পেলেন লুমিয়ের ভাইরা।
সে বছরই ২৮ ডিসেম্বর প্যারিসের গ্রান্ড কাফের সালোঁ ইন্ডিয়েন প্রেক্ষাগৃহে জনসাধারণের জন্য শুরু হল সিনেমাটোগ্রাফের প্রদর্শন। ১২০টি চেয়ারবিশিষ্ট লাল পর্দায় মোড়া হলটিতে ধীরে ধীরে লোকসমাগম বাড়তে থাকে, মাথাপিছু টিকিটের দাম ছিল এক ফ্রাঁ, তখনকার হিসেবে নিতান্ত কম নয়। দিনে আধ ঘণ্টার ব্যবধানে এক একটি প্রদর্শন হত। দশখানি গড়ে এক মিনিটের ছবি দেখানো হত তাতে। পরে ভিড় এত বেড়ে যায় যে প্যারিসেই একসঙ্গে চার জায়গায় প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। দিনে রোজগার হত প্রায় ২৫০০-৩০০০ ফ্রাঁ। সিনেমাটোগ্রাফ যন্ত্রের এই নড়াচড়া করা ছবির আর-এক নাম হল সিনেমা বা কিনেমা। আর সিনেমার জনক হিসেবে ইতিহাসে রয়ে গেলেন লুমিয়ের ভাইরা।