কম্পিউটাই গ্রাফিক্স ছাড়াই স্পেশ্যাল এফেক্ট সম্ভব, গুপি বাঘায় দেখিয়েছিলেন সৌমেন্দু
Soumendu Roy : সেই সাদাকালো যুগে জ্যোৎস্না রাত করা হতো 'ডে ফর নাইট' দিয়ে। মানে দিনের বেলায় চাঁদের আলোর দৃশ্য তোলা হতো।
সৌমেন্দুদা চলে গেলেন। আমার মনে হয়, ওই পর্যায়ের মানে সেলুলয়েড যুগের শেষ ক্যামেরাম্যান চলে গেলেন। আসলে সৌমেন্দুদার মূল্যায়ন করবই বা কীভাবে? এই তো সেদিন অবধি তিনি কাজ করে গেছেন। আমার সঙ্গেও দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। নানা বিষয় নিয়ে হামেশাই আলোচনা করেছি, অনেক কিছু শিখেওছি। সৌমেন্দু রায় কাজ করা শুরু করেছিলেন বড্ড কম বয়সে। তখন বয়স কতই বা হবে, কুড়ি বা একুশ বড়জোর। স্টুডিওতে ক্যামেরার কেয়ারটেকার বা ক্যামেরা অ্যাটেনডান্ট হয়েই কাজে হাতেখড়ি। ফলে স্টুডিওতে বসেই অনেক কিছু শিখেছিলেন তিনি। তাঁর যারা গুরু ছিলেন, বিখ্যাত ক্যামেরাম্যান রামানন্দ সেনগুপ্ত, ডি কে মেহতা এদের কাছ থেকে স্টুডিও সম্পর্কে অনেক কিছু শিখেছিলেন তিনি। কিন্তু সৌমেন্দুদার প্রথম এক বিরাট নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা হয় যখন তিনি প্রথম পথের পাঁচালীর শ্যুটিং করতে যান সুব্রত মিত্রর অধীনে। সব থেকে মজার বিষয় হচ্ছে, সত্যজিৎ নিজের প্রথম সিনেমার জন্য কিন্তু বেছে নিয়েছিলেন সুব্রত মিত্রকে। তিনি তখন একেবারেই অ্যামেচার ক্যামেরাম্যান। তাঁর সহকারীদের মধ্যে আবার ছিলেন সৌমেন্দু রায়, দীনেন গুপ্ত সহ আরও অনেকেই।
প্রথম পথের পাঁচালীর সূত্রেই আউটডোর শ্যুটিং সম্পর্কে একেবারে এক নতুন অভিজ্ঞতা হয় তাঁর। সত্যজিৎ এবং সুব্রত মিত্র মিলে চেষ্টা করেছিলেন আউটডোরকে কীভাবে আরও বাস্তবসম্মত করে তোলা যায়। আমাকে সৌমেন্দুদা অনেকবারই বলেছিলেন, এই অভিজ্ঞতাগুচ্ছ তাঁর কাছে বিশাল পাওনা, এক নতুন ভুবন যেন। ফলে সত্যজিৎ রায় ও সুব্রত মিত্রের সঙ্গে কাজ করা, পাশাপাশি অন্যান্য ক্যামেরাম্যানদের সঙ্গে কাজ করা, স্টুডিও লাইটিং নিয়ে কাজ করা এসব অভিজ্ঞতা তাঁর অনেক অল্প বয়স থেকেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তখন তো আর ফিল্মস্কুল ছিল না, এইসব স্টুডিওগুলোই ছিল আস্ত ফিল্মস্কুল। সেখানেই কাজ করতে করতে শেখা। সৌমেন্দু রায় শিখেওছিলেন বড় যত্নে। তাঁর ফিল্মোগ্রাফি দেখলেই বোঝা যায় কেবল সত্যজিৎ না, অসংখ্য পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি যাঁদের মধ্যে রয়েছেন ঋত্বিক ঘটকও! সেখানে দীনেন গুপ্ত, দিলীপরঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের সহকারী ছিলেন তিনি। অযান্ত্রিক, মেঘে ঢাকা তারা, কোমলগান্ধারের মতো সিনেমায় ক্যামেরায় সহযোগিতা করেছিলেন সৌমেন্দু।
আরও পড়ুন- মোৎজার্ট অন্ত প্রাণ, বেঠোফেনকে নিয়ে ছবি করতে চাইতেন সত্যজিৎ রায়
আমি রায়দাকে বারবার জিজ্ঞেস করতাম, “আপনাকে যখন দায়িত্ব দিলেন মানিকদা রবীন্দ্রনাথ এবং তিন কন্যা করার, আপনার কেমন মনে হয়েছিল?” সৌমেন্দুদা বলেছিলেন, “আমার তো হাত-পা প্রায় শুকিয়ে গিয়েছিল! আমি দায়িত্ব নেব কী! তখন সত্যজিৎ রায় বিখ্যাত পরিচালক। তাঁর সিনেমার দায়িত্ব নেব আমি?” সুব্রত মিত্র, মানে সত্যজিতের তখন যিনি মূল ক্যামেরাম্যান, তাঁর চোখের একটি অপারেশন হয়েছিল সেই সময়। স্বাভাবিকভাবেই তিনি কাজ করতে পারতেন না তখন। সৌমেন্দুদা বলেছিলেন, সত্যজিৎ তাঁকে এমন ভরসা জুগিয়েছিলেন যে কোনও অসুবিধাই হয়নি। তিন কন্যাতে তিনটি গল্প, সমাপ্তি, পোস্টমাস্টার ও মণিহারা। দর্শক লক্ষ্য করবেন, তিনটিই সাদাকালো ছবি অথচ তিনিটির আলো, টোনাল কোয়ালিটি তিন রকমের। মণিহারাতে আলোছায়ার খেলা ছিলই। পোস্টমাস্টারে হ্যারিকেনের আলোর পরিবেশ করেছিলেন। আর সমাপ্তিতে সেই প্রচণ্ড গ্রামবাংলার কাদা! কিছুটা সত্যিকারের কাদা ছিল, কিছুটা তো তৈরি করা কিন্তু তার গড়ন অপূর্বভাবে ক্যামেরায় ধরেছিলেন সৌমেন্দু রায়।
আরেকটি দৃশ্য আমার খুব মনে পড়ে, মৃণ্ময়ী যেখানে চাঁদের আলোয় দোলনায় দুলছে। তখন, মানে সেই সাদাকালো যুগে জ্যোৎস্না রাত করা হতো 'ডে ফর নাইট' দিয়ে। মানে দিনের বেলায় চাঁদের আলোর দৃশ্য তোলা হতো। তার জন্য একটি রেড ফিল্টার লাগত, আরও নানা ফিল্টার দিয়ে ওই দৃশ্য তোলা হতো। সমাপ্তির সেই দৃশ্য আমার কাছে বাংলা সিনেমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ডে ফর নাইট দৃশ্য। এরপর সত্যজিতের বহু সিনেমায় তিনি কাজ করলেন। মাঝে সুব্রত মিত্র আবার ফিরে আসেন, সত্যজিতের নায়ক সিনেমায় কাজ করেন। গুপি গাইন বাঘা বাইনের বিরাট দায়িত্ব এসে পড়ে সৌমেন্দু রায়ের কাঁধেই। এই সিনেমায় প্রচুর 'স্পেশ্যাল এফেক্টস'! তখন তো আর আজকালকার মতো কম্পিউটার গ্রাফিক্স ছিল না। পুরোটাই হাতে করা। স্পেশ্যাল এফেক্টস ক্যামেরাতে ডুপ্লিকেট করে করতে হতো। অসাধারণ সব পরিকল্পনা করে সৌমেন্দু সেই কাজগুলি অবলীলায় করে ফেলেন।
সৌমেন্দু রায়ের ছায়াসঙ্গী ছিলেন পূর্ণেন্দু বসু। টেকনিক্যাল জ্ঞানও প্রবল। সৌমেন্দু রায়কে সারাক্ষণ সাহায্য করে গেছেন তিনি। সত্যজিতের সিনেমা ছাড়াও তরুণ মজুমদারের সঙ্গে প্রচুর কাজ করেছেন তিনি। সেখানে ক্যামেরার কাজ একেবারেই আলাদা। আলোর পিপাসায় স্টুডিও লাইটের কাজ ছিল বিপুল, পলাতকে গ্রামের দৃশ্য অদ্ভুত সুন্দরভাবে ফিরিয়ে আনেন সৌমেন্দু। গানের দৃশ্যেও ম্যাজিক করতেন তিনি। কুহেলি বলে একটা সিনেমা করেছিলেন, অমন রহস্যমাখা ছবিতে তাঁর আলো আর ক্যামেরাই ছিল যেন মূল আকর্ষণ। আসলে সেই সময় সুব্রত মিত্র, বংশী চন্দ্র গুপ্ত এবং সত্যজিৎ রায় ছিলেন মণিকাঞ্চন যোগ। সিনেমায় কীভাবে বাস্তবধর্মী আলো, সেট করা যায় এই নিয়ে দুর্দান্ত ধারণা ছিল তাঁদের। সৌমেন্দু রায় ছিলেন এদেরই সাহচর্যে, এই ঘরানার শিক্ষা তিনি যেমন পেয়েছেন পাশাপাশিই পেয়েছেন স্টুডিওর শিক্ষা। বিভিন্ন সিনেমায় তাই বিভিন্ন ফটোগ্রাফিক স্টাইল প্রয়োগ করেছেন তিনি। প্রথম রঙিন সিনেমা করলেন সৌমেন্দু, অশনি সংকেত। সত্যজিতের ইচ্ছা ছিল গ্রামকে শস্য শ্যামলা সবুজই দেখাবেন কিন্তু দুর্ভিক্ষ যে আসছে সেই সংকেতও রইবে। এই বৈপরীত্যকে অদ্ভুতভাবে ধরেছিলেন সৌমেন্দু।
আরও পড়ুন- ‘সোনার কেল্লা’ কমেডি থ্রিলার, বলেছিলেন সত্যজিৎ
আরেকটি দৃশ্যের কথা না বললেই নয়। সোনার কেল্লা সিনেমা। রামদেওরা স্টেশনে বসে আছে ফেলুদা, তোপসে, জটায়ু। সিল্যুয়েটে দেখা যাচ্ছে তাদের, আড়মোড়া ভাঙছে তারা আর ক্যামেরা ট্র্যাক করে দেখাচ্ছে আগুন জ্বালিয়ে স্থানীয় গায়করা একজায়গায় বসে গান গাইছেন। পিছনের আকাশ, সামনের জমি, আগুন, গায়কদের মুখ সব মিলিয়ে এক্সপোজারের নিয়ন্ত্রণ এখানে অপূর্ব। আসলে ভালো পরিচালকদের একটা চিন্তাভাবনা থাকে, দর্শন থাকে নিশ্চয়ই কিন্তু পরিচালকের চোখ হচ্ছেন ক্যামেরাম্যানরাই। তখন তো মনিটর ছিল না। সৌমেন্দুদারা কোনওদিন মনিটরে দেখেননি, অথচ মনে মনে কতটা আত্মবিশ্বাস ছিল যে যা কাজ হয়েছে তা চূড়ান্ত হয়েছে!
পরবর্তীকালে টেলিভিশনেও কাজ করেছিলেন সৌমেন্দু, ডিজিটাল ক্যামেরায় কাজ। কিন্তু শেষদিকে রূপকলা কেন্দ্রে দেখতাম ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে খুব ভালো ছিলেন তিনি। হুইলচেয়ারে করেও পড়াতে যেতেন। আসলে ছাত্রছাত্রী তৈরি করতে ভালোবাসতেন। নিজের এতদিনের অভিজ্ঞতা, ক্যামেরার যে বিবর্তন তা শিখিয়ে যেতে চাইতেন। গোদার, ত্রুফোর ক্যামেরাম্যান রাউল কুতার লিখেছিলেন, যখন চলচ্চিত্র নির্মাণ হয় ক্যামেরাম্যানই তার প্রথম দর্শক। সৌমেন্দু রায় আজীবন ছিলেন এমন অসংখ্য ভালো সিনেমার প্রথম দর্শক।