সত্যজিতের থেকে ক্যামেরার স্বাধীনতা পাননি সৌমেন্দু রায়
Soumendu Roy: সৌমেন্দু তাঁর নিজের মতো করে এক ধরনের মাঝারিয়ানার ক্যামেরাম্যান।
প্রয়াত সৌমেন্দু রায়ের কথা ভাবলে আমার যা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মনে হয় তা হলো তাঁর স্বভাবের অভিজাত অন্তরাল। তিনি হাসিমুখে কথা বলতেন কিন্তু খুব সংলগ্ন হতেন না। অনেকটা যেন যুধিষ্ঠিরের রথ, মাটির একটু উপর দিয়ে চলাচল করে। দেখা যাবে, সৌমেন্দুদার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বিশেষ কেউই জানেন না, তিনি জানতে দিতেও চাইতেন না। 'সপ্তর্ষি'-র সেই ন'তলা থেকে কলকাতাকে দেখা যেত কিন্তু সেটা হিচককের এস্টাব্লিশিং শটের মতোই, শহরকে একটু দূরত্ব থেকে দেখা। আমার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল প্রথম, যখন তিনি কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের টেকনিক্যাল কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করতেন। আমি দেখতাম, শিশির মঞ্চ অথবা রবীন্দ্র সদনে ঠিকমতো আলো পড়ছে কিনা পর্দায় এসব দেখার জন্য সৌমেন্দু রায় দেবানন্দ সেনগুপ্ত প্রমুখ সহকারীদের নিয়ে শিশির মঞ্চ, রবীন্দ্র সদনের প্রোজেকশন পরীক্ষা করছেন। নন্দনে তবু তাঁর সমস্যা কম ছিল। তাও তো সুব্রত মিত্রের খুঁতখুঁতানিতে একবার তিনি মাথা চুলকে বললেন, "আর কী করব সুব্রত দা!"
টেকনিক্যাল কমিটির কাজের ফাঁকে ফাঁকে তাঁর সঙ্গে কাজের আলাপ জমেছিল। এমনকী তিনিই আমাকে জানিয়েছিলেন পরে যে, "জানো, রাউল কুতার নেপাল থেকে কলকাতায় দু'দিন কাটিয়ে গেলেন গ্র্যান্ড হোটেলে।” আমি তো আকাশ থেকে পড়েছিলাম! রাউল কুতার মানে নবতরঙ্গের সেই কিংবদন্তিসম ক্যামেরাম্যান! গোদার, ত্রুফোর বন্ধু! আমি তো অবাক, কলকাতার মিডিয়া জানতে পারল না? সৌমেন্দু রায় মৃদু হেসে বললেন, "এরা দেবতার মতো আড়ালে থাকেন, প্রেস কনফারেন্স করেন না।" সৌমেন্দুও খানিক তেমনই। তাঁর সঙ্গে আলাপ ঘনিষ্ঠ হলো রূপকলা কেন্দ্রে। সেখানে আমি কিছুদিন দায়িত্বে ছিলাম আর সৌমেন্দুদা ক্যামেরা বিভাগের পরামর্শদাতা এবং অনেকসময় প্রবীণ শিক্ষক হিসেবেও ক্লাস নিতেন। দুপুরবেলা বৃদ্ধ আসতেন আমার ঘরে, তখন নানারকম কথাবার্তা হতো। যেমন, কী চমৎকারই না তিনি বলেছিলেন, পথের পাঁচালীর প্রথম দিনের শ্যুটিংয়ের কথা। সেটা ছিল জগদ্ধাত্রী পুজোর বিজয়া দশমীর দিন। বর্ধমানের কাছে পালসিট স্টেশনের পাশে একটা কাশবন। সৌমেন্দু রায় বলছিলেন, "সুব্রতদা, মানিকদা তো আগেই চলে এসছেন। আর কী সমস্যায় যে পড়েছি আমরা! সেই ভারী ব্যাটারি টানতে টানতে আমরা সিগনালের তার পেরোচ্ছি। কী কষ্ট, ঘেমে নেয়ে গেছি একেবারে। তারপর সেই কাশবনে অবশেষে ক্যামেরা নিয়ে রাখলাম।" তাঁর কোনও সমস্যা ছিল না, এই যে ট্রলিম্যান বা ওজন বয়ে নিয়ে যাওয়ার মানুষ হিসেবেও কাজ করেছেন তা তিনি নির্দ্বিধায় জানাতে পারতেন।
আরও পড়ুন- সত্যজিৎ, ঋত্বিক নন; মধ্যবিত্ত সমাজকে থাপ্পড় কষিয়েছিলেন মৃণাল সেনই!
একবার তিনি হেসে বললেন, "তুমি তো জানো না, আমি তোমার গুরুরও শাগরেদি করেছি। আরে, দীনেন গুপ্ত আমাকে একদিন ডেকে পাঠালেন, মেঘে ঢাকা তারায় কাজ করলাম। দেখবে, ক্রেডিট টাইটেলে নাম আছে।" যখন একটু সিরিয়াসলি আলোচনা করতেন তখন ঋত্বিক ঘটক এবং সত্যজিতের ক্যামেরা পরিচালনার পার্থক্য নিয়েও দামী মন্তব্য করতেন। যেমন, ঋত্বিক প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, "ঋত্বিকবাবুর লেন্স ডায়াগ্রাম মারাত্মক স্ট্রং। কোনও লেন্স ডায়াগ্রাম কোন পয়েন্ট থেকে কোন পয়েন্টে যাবে, কতটা প্যানিং হবে এসব একেবারে মাপা। ঋত্বিক কিন্তু ক্যামেরার ক্ষেত্রে মোটেই এলোমেলো ছিলেন না। সত্যজিৎ রায়ের ক্যামেরা তো স্বরলিপির মতো বাঁধা! আমার বিশেষ কিছু করারও থাকত না।" এই বিনয় কতজনের মধ্যেই বা আর মেলে? লোকে এখন আত্মপ্রচারের নামে মুখিয়ে ওঠে, আর সৌমেন্দু লুকিয়ে থাকতেন।
যেমন একদিন তিনি আমাকে বললেন, "জানো, খুব সমস্যা হয়েছিল অশনি সংকেতের সময়। এক রবিবার মানিকদা আমাকে বাড়ির আড্ডায় ডেকে বললেন কথা আছে, একটু থেকে যেও। তো থেকে গেলাম। সত্যজিৎ বললেন, সৌমেন্দু, এবার কালারে ছবি করব ভাবছি। আমার তো শুনেই মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। সত্যি কথা বলতে কী, রঙিন ছবি আমি করিনি, তার উপর মানিকদার রঙিন ছবি। বলতেও পারছি না যে, মানিকদা আমার ঠিক কনফিডেন্স আসছে না আবার এমন চান্স ফেলে দিতেও চাইছি না, মানিকদার মুখের উপর কি আর কথা বলা যায়? অন্যদিকে, একটু বিমর্ষ, একটু ঘাবড়ে আছি। মানিকদা ব্যাপারটা খেয়াল করলেন। সপ্তাহখানেক বাদে বললেন, সৌমেন্দু ক'দিন ধরেই মুখচোরা লাগছে, কী হয়েছে? বললাম, রঙিন ছবি করিনি, অশনি সংকেত কীভাবে করব সেই নিয়েই মাথার মধ্যে চাপ তৈরি হয়েছে। মানিকদা স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন। তারপর হো হো করে হেসে উঠলেন; বললেন, তুমি ভুলে যাও যে তুমি রঙিন ছবি করছো, তুমি সাদা কালোয় যেভাবে কাজ করো, সেভাবেই করবে। আমরা তো দু'জনেই একসঙ্গে কাজ করব।" সৌমেন্দু অতঃপর যোগ করলেন, "সঞ্জয় দেখো, অশনি সংকেতে মানিকদা চড়া রং রেখেছেন, ধানখেত বেশি সবুজ, মেয়েদের কপালের টিপ বেশি লাল। এই যে এক্সাজারেশন এটাই মানিকদার থেকে শেখার মতো। তিনি একটা ফ্রেমিংয়ে দেখতে পাচ্ছিলেন একটা বিপর্যয়কে। সেই জন্যই রংকে এত গাঢ় করে দিয়েছিলেন যাতে দর্শক একটা ইঙ্গিত পায়।
তবে যখন সৌমেন্দুদাকে সত্যিকারের ক্যামেরা চালানোর অভিজ্ঞতা জিজ্ঞেস করেছি তখন তিনি আমাকে সত্যজিৎ না, তরুণ মজুমদারের কথা বলেছেন। বলেছেন 'পলাতক'-এর কথা, 'একটুকু বাসা'-র কথা। ইন্ডোর লাইটিং এবং ফটোগ্রাফি কী হতে পারে তা নিয়ে তপন সিনহার 'হুইল চেয়ার'-এর কথা বলেছেন। বস্তুত, সৌমেন্দু রায় মুখে বলতেন না কিন্তু সহজেই অনুমেয় যে, ফটোগ্রাফির স্বাধীনতা তিনি পেতেন অপেক্ষাকৃত গৌণ পরিচালকদের থেকেই, সত্যজিতের থেকে নয়। আমার মনে হয়, সৌমেন্দুর সেরা আলোকচিত্র গ্রহণ 'শরতঞ্জ কি খিলাড়ি'। কিন্তু সৌমেন্দু সহাস্যে জানাতেন, সেখানে মানিকদাই ক্যামেরা চালাতেন। "আমার কাজ ছিল পাশে বসে থাকা, আলোটা করে দেওয়া।" তুলনায় তরুণ মজুমদার যখন তাঁকে পলাতকে ডে ফর নাইট ফটোগ্রাফি করতে বললেন তখন সৌমেন্দু প্রাণ ঢেলে দিয়েছিলেন। নদীর উপর সেই নৌকাগুলো আজও চোখে জীবন্ত হয়ে ভাসে। 'বালিকা বধূ' সিনেমায় ভোরবেলা মাস্টারমশাইকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। লং শটে আমরা যে আলো দেখি, কুয়াশা দেখি সেরকম ইম্প্রেশনিস্ট ক্যামেরা সৌমেন্দু রায় যে তৈরি করেছেন তা আমরা প্রায় ভুলেই থাকি। তপন সিনহার হুইল চেয়ারে ইন্ডোরের অবস্থানকে যেভাবে সৌমেন্দু ব্যবহার করেছেন তাতে তপন খুব একটা হস্তক্ষেপ করেননি। ফলে সৌমেন্দুর প্রতিভা সম্পূর্ণ বিকশিত হতে পেরেছিল।
আরও পড়ুন- ‘জীবনের নোংরা দিকটা আমার ছবিতে যথেষ্ট উঠে এসেছে’: সত্যজিৎ রায়
আর তিনি দেবতার মতো শ্রদ্ধা করতেন সুব্রত মিত্রকে। সুব্রত মিত্র তাঁকে শিখিয়েছিলেন, ক্যামেরাম্যানই প্রথম দর্শক। ক্যামেরাম্যানই দৃশ্যের কৌমার্য মোচন করেন। সৌমেন্দুদা নির্দ্বিধায় বলতে পারতেন, "সুব্রতদা যদি হিমালয় হন আমরা তবে সবাই বালির ঢিবি, বুঝেছো?” নিজেই একদিন আমাকে বলেছিলেন, "তুমি চারুলতা আর প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে তুলনা করে দেখবে সুব্রতদার সঙ্গে আমার তফাত কোথায়?” আর সেই আলোচনাই যখন আমি একটু দূরে টেনে নিয়ে যাই সমিরা মখমলবাফের প্রসঙ্গে ডিজিটাল ফটোগ্রাফির কথা তুলে, তখন সৌমেন্দু খানিক অনিশ্চয়তায় মাথা নাড়েন। আমাকে বলেন, "ডিজিটাল ক্যামেরা ভালো, কিন্তু একটা সর্বনাশ করে দিচ্ছে সঞ্জয়। মুড়ি মিছরি সব এক হয়ে যাচ্ছে। এখন একটা ছবি তুললে, কোনটা সুব্রতদা তুলেছেন আর কোনটা দীনেন গুপ্ত তুলেছেন আর কোনটা তুমি তুলেছো বার করা খুব কঠিন। আমার খুব ভয় হয়, ছবি তোলাটাও যে একটা তপস্যার মতো সেটা ক্রমশ লোকে ভুলে যাবে।"
সৌমেন্দু রায় চলে যাওয়ার পর বলতে পারি, তাঁর সঙ্গে আমার অজস্র মুহূর্ত আছে। তরুণ মজুমদারের সঙ্গেও। আমরা একসঙ্গে আড্ডা দিয়েছি, চা খেয়েছি, সিনেমা নিয়ে কথা বলেছি। এটা ঠিক, দীনেন গুপ্ত বা অজয় করের সঙ্গে সৌমেন্দুর তুলনা করা যাবে না। সৌমেন্দু তাঁর নিজের মতো করে এক ধরনের মাঝারিয়ানার ক্যামেরাম্যান। তবু উল্টোদিকে, শুধু তাঁকে সত্যজিতের ক্যামেরাম্যান হিসেবে চিহ্নিত করা ভুল। তাঁর ফিল্মোগ্রাফিতে অনেক মুকুট। ব্যক্তিগতভাবে আমি, শতরঞ্জ কি খিলাড়ি-তে যখন নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের সিংহাসনে ভিলাসকেথ রেড দেখতে পাই, যখন লখনউয়ের বিষণ্ণ আকাশ শেষ বর্ণচ্ছটা ছড়াতে থাকে তখন আমার মনে পড়ে সৌমেন্দু রায়ের বিষণ্ণ কিন্তু গভীর চোখ দুটো। মনে পড়ে, রূপকলা কেন্দ্রে তিনি আমার ঘরে আসছেন চা খেতে আর সকৌতুকে বলছেন, "আমার তো দু'জনই ডিরেক্টর, একজন মানিকদা আর একজন তুমি।" আমি লজ্জায় মুখ নিচু করে ফেলতাম। আজ নতমুখেই তাঁকে প্রণাম জানালাম।