দেখলেই স্প্রে করছেন! জানেন, আপনার জন্যই যৌন মিলন করতে পারছে না আরশোলারা?

Cockroaches Sex Life: সঙ্গী খোঁজার সময়, পুরুষ আরশোলা তাদের পিঠের দিকে একটি মিষ্টি তরল তৈরি করে নিঃসরণ ঘটায়।

বনে গেছেন পাণ্ডু। রাজা মানুষ, তার উপর বন জঙ্গলে মৃগয়ায় গিয়ে তো নিশ্চয়ই কেবল দৃশ্য দেখবেন না! দূর থেকে দেখলেন ঝোপের ফাঁকে দুই হরিণ। দিলেন তির চালিয়ে। সেই মুহূর্তে সঙ্গমে লিপ্ত ছিল ওই হরিণ এবং এক হরিণী। অত ঘন জঙ্গলে কেই বা আর বন্যপ্রাণ বাঁচানোর ডাক দেবে? সেই সময় অত কড়াকড়িও তো ছিল না প্রাণী হত্যার। মৃগয়া সফল হয়েছে ভেবে এগিয়ে গিয়ে পাণ্ডু দেখেন, সর্বনাশ করেছেন। এক ঋষিপুত্র ছদ্মবেশ ধরে তাঁর হরিণীরূপী স্ত্রীর সঙ্গে যৌন মিলন করছিলেন। পাণ্ডু বেচারা বুঝবেনই বা কীভাবে! ঋষিকুমার কিমিন্দম তখন পাণ্ডুকে বললেন, এত তাড়া কীসের ছিল? যখন দেখছেন দুটো হরিণ যৌন মিলনরত অবস্থায় আছে, একটু অপেক্ষা করতে কী হয়? যৌন মিলনের মতো চরম মুহূর্তে কেউ কাউকে মারে? পাণ্ডু ক্ষমা টমা চাইলেন বটে, কিন্তু বরফ গলল না। একে মিলন সম্পূর্ণ হয়নি, তারপর লেগেছে তির! বিশাল চটে ঋষিকুমার পাণ্ডুকে অভিশাপ দিলেন, যখনই পাণ্ডু কারও সঙ্গে যৌনতায় যাবেন তখনই তাঁর মৃত্যু হবে! যৌন মিলনে বাধা দেওয়ার ফলে কুকুরদেরও এমন অভিশাপ পেতে হয়েছিল দ্রৌপদীর থেকে। খুব বেশি দিন নেই, মানুষকে এমন ঝুরি ঝুরি 'অভিশাপ' দেবে আরশোলারা। দেখলেই স্প্রে করে দিচ্ছেন তো কীটনাশক? আরশোলারা পালাচ্ছে বা মরে যাচ্ছে। মরে গেলে তো হয়েই গেল, যারা বেঁচে যাচ্ছে- আজীবনের মতো যৌনতার ক্ষমতা শেষ হয়ে যাচ্ছে সেই আরশোলাদের। আর এর জন্য দায়ী একমাত্র মানুষ!

মানুষের নানা কাজকর্মের ফলে প্রাণীদের, কীটদের, পতঙ্গদের কী কী বদল এসেছে, কীভাবে নতুন করে অভিযোজিত হচ্ছে তারা, এই নিয়ে গবেষণা চলছে দীর্ঘদিন ধরেই। তেমনই একটি গবেষণা বলছে, কীটনাশক ব্যবহারের ফলে আরশোলাদের যৌন জীবনে অস্বাভাবিক বদল আসছে। কিছু কিছু আরশোলা এই কীটনাশকের ফলে গ্লুকোজ সহ্য করতে পারছে না। গ্লুকোজের প্রতি এই ঘৃণা থেকেই যৌনতা করতে পারছে না আরশোলারা। সাম্প্রতিক এই গবেষণা বলছে, পুরুষ আরশোলাদের যৌনমিলনের কৌশলগুলি অভিযোজিত হয়েছে, আচরণগত বিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু গ্লুকোজ, কীটনাশক এবং আরশোলার যৌনতার মধ্যে সম্পর্ক কী?

আরও পড়ুন- বিষে হার মানাবে গোখরোকে, পশ্চিমবঙ্গেও হানা দিচ্ছে এই মারাত্মক পোকা

নর্থ ক্যারোলিনা স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকরা দেখতে চেয়েছিলেন যে, কীভাবে মানুষের কোনও আচরণ প্রাণিকুলের দ্রুত বিবর্তন ঘটায় এবং কীভাবে প্রাণীরা এই জাতীয় সমস্যার মোকাবিলা করতে না পেরে ভুক্তভোগী হয়। গবেষণার জন্য জার্মান আরশোলা ব্লাটেলা জার্মানিকাদের বেছে নেন তারা। এই আরশোলাদের আচরণে অভিযোজিত পরিবর্তনের কারণে তাদের যৌন আচরণে পরিবর্তন দেখা দেয়।

ঘটনাটি কী ঘটে জানা যাক আগে। সঙ্গী খোঁজার সময়, পুরুষ আরশোলা তাদের পিঠের দিকে একটি মিষ্টি তরল তৈরি করে নিঃসরণ ঘটায়। স্ত্রী আরশোলাদের প্রলুব্ধ করার জন্য এটি নাকি 'বৈবাহিক উপহার' হিসাবে ব্যবহার করে পুরুষ আরশোলারা। যখন স্ত্রী আরশোলা লোভে পড়ে এই মিষ্টি খাবারটি উপভোগ করার জন্য পুরুষের ডাকে সাড়া দেয় তখন পুরুষ আরশোলা তার সঙ্গে যৌনমিলন শুরু করে দেয়। প্রায় ৯০ মিনিট পর্যন্ত চলে আরশোলাদের সঙ্গম।

বাজারে প্রচলিত কীটনাশকগুলিতে থাকে গ্লুকোজ। আসলে বিষের তিক্ত স্বাদকে ঢেকে রাখার জন্যই এই গ্লুকোজ মেশানো হয়। আরশোলা দেখলেই মানুষ কীটনাশক নিয়ে স্প্রে করতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এই গ্লুকোজযুক্ত মিষ্টি কীটনাশক দিয়ে আরশোলা মারার ফলে চিনির প্রতি বিরূপ হয়ে গিয়েছে স্ত্রী আরশোলারা। পুরুষদের দেহের 'মিষ্টি উপহার' আর ভাল্লাগছে না তাদের। এর কারণ হচ্ছে, স্ত্রীদের লালা পুরুষদের পিঠের ক্ষরণের মধ্যে থাকা মল্টোজকে ভেঙে গ্লুকোজে পরিণত করে, যার ফলে তারা পুরুষকে প্রত্যাখ্যান করে এবং যৌন মিলন সম্পূর্ণ না করেই পালিয়ে যায়।

তিরিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে এই বিষয়টি। ২০১৩ সালে, আয়াকো ওয়াদা-কাটসুমাতা এবং তাঁর সহকর্মীরা দেখতে পান, যে আরশোলাদের গ্লুকোজের প্রতি এই বিতৃষ্ণা তৈরি হয়েছে তাদের পেরিফেরাল গাস্টেটরি সিস্টেমে পরিবর্তন ঘটেছে। স্বাদ এবং গন্ধ বোঝার কাজটি করে এই সিস্টেমটি। ঠিক কী পরিবর্তন? এখন আর গ্লুকোজকে মিষ্টি লাগে না তাদের, তেতো লাগে বলেই যৌন মিলনের সময় বিরক্ত হয়ে চলে যায় তারা।

ওয়াদা-কাটসুমাতা স্ত্রী আরশোলাদের পুরুষের মিলনের ডাকে সাড়া দেওয়ার প্রতিক্রিয়া জানার চেষ্টা করেন। তিনি এবং তাঁর সহকর্মী এডুয়ার্ডো হাতানো এবং কোবি শ্যাল একটি ইনফ্রারেড-সংবেদনশীল ক্যামেরার সাহায্যে ২৫১ জোড়া জার্মান আরশোলার যৌনতা রেকর্ড করেন। এও আরশোলাদের মধ্যে কিছু ছিল এমন যাদের গ্লুকোজের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মেছে, কিছু ছিল যাদের এমনটা ঘটেনি। আরশোলাগুলিকে তারপর দু'টি দলে ভাগ করা হয়েছিল - যারা সঙ্গমে সফল হয়েছে এবং যারা হয়নি।

আরও পড়ুন- বিখ্যাত সব ছবি, ভাস্কর্যে পুরুষাঙ্গের আকার এত ছোট কেন? চমকে উঠবেন কারণ জেনে

গবেষকরা দেখেছেন, গ্লুকোজ বিতৃষ্ণা থাকা স্ত্রী আরশোলারা সেই পুরুষদের দেহনিঃসৃত মিষ্টি তরল খাওয়া বন্ধ করে দেয় এবং সঙ্গম করে না যাদের একইরকম বিতৃষ্ণা তৈরি হয়নি। এই একই স্ত্রী আরশোলারা এমন পুরুষদের দেহের তরল খেতে রাজি হয়েছে যাদেরও গ্লুকোজ সহ্য হতো না। সফলভাবে সঙ্গম করেছে এই আরশোলারা। এবং এই আকর্ষণের ২.২ সেকেন্ডের মধ্যে স্ত্রীদের সঙ্গে যৌনতা করতে পেরেছে পুরুষ আরশোলারা, যা স্বাভাবিকের চেয়ে এক সেকেন্ডেরও বেশি দ্রুত।

গ্লুকোজ পছন্দ করছে না এমন আরশোলাদের নিঃসরণ বিশ্লেষণ করার সময়, গবেষকরা দেখতে পান, এতে বেশিরভাগই ম্যালটোট্রিওজ রয়েছে। এই ম্যালটোট্রিওজ তিনটি গ্লুকোজের সমন্বয়ে গঠিত যার মধ্যে একটি ট্রাইস্যাকারাইড যা মহিলাদের লালা উৎসেচকের প্রতিরোধী। ম্যালটোট্রিওস গ্লুকোজে ভেঙে যেতে প্রায় পাঁচ মিনিট সময় নেয়। তাই স্ত্রী আরশোলা যখন মিষ্টি স্বাদ বুঝতে পারে, পুরুষটি যৌন মিলন প্রক্রিয়া শুরু করার সুযোগ ও সময় দুইই পায়। একবার মিলন শুরু হয়ে গেলে, স্ত্রী আরশোলাটি পালাতে পারে না।

প্রসিডিংস অব দ্য রয়্যাল সোসাইটি বি-তে প্রকাশিত গবেষণাটি বলছে, মানুষের নানা আচরণ প্রাকৃতিক নির্বাচনকে অস্বীকার করে। আরশোলাদের যৌন আচরণের অভিযোজনের নেপথ্যে মানুষের ভূমিকাই বেশি। মানুষের কাজকর্মের প্রেক্ষিতে দীর্ঘকাল ধরেই প্রাণীদের আচরণও বদলে যাচ্ছে।

More Articles