ধর্ষণের আগে ধর্ষিতা পালাতে কেন পারেন না? বিজ্ঞান কী বলছে?
Rape and Molestation Victim: ‘ফ্রিজিং’-এর শিকার হলে কোনও ব্যক্তি ও অন্যান্য প্রাণী যে কোনও ভঙ্গিতে স্থির হয়ে, থমকে যেতে পারেন। যাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘টনিক মোবিলিটি' বলে।
আচ্ছা আপনাদের কারও বাড়িতে মাঝরাতে চোর বা ডাকাত পড়েছে কখনও? চোর বা ডাকাতকে আচমকা দেখে আপনি সবসময়, সবক্ষেত্রে চেঁচিয়ে উঠতে পেরেছেন “চোর চোর” বলে? গলা থেকে আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়নি! মনে হয়নি শরীরটা যেন আর চলছে না, আর আপনি ক্রমশ যেন মাটির ভেতরে ঢুকে যাচ্ছেন? আপনার নিজের সঙ্গে যদি এ ঘটনা না-ও ঘটে থাকে, নিদেনপক্ষে পাড়া-প্রতিবেশি, অফিস কলিগ কিংবা বন্ধু-বান্ধবের মুখে তো এরকম ঘটনা শুনেই থাকবেন যে, চোর পড়েছে বাড়িতে, আর তা দেখে গলা থেকে আওয়াজ
বেরোয়নি। এবার এরকমই একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যাক। তবে বিষয়টা চুরির থেকেও অনেক গুরুতর অপরাধকে কেন্দ্র করে।
“যদি লোকটা আপনাকে ধর্ষণই করতে আসে, আপনি পালালেন না কেন? তার মানে নিশ্চয়ই আপনার সায় ছিল।” “লোকটি আক্রমণ করলই যখন চিৎকার করে লোক ডাকলেন না কেন? আপনি নিশ্চয়ই চাইছিলেন…”! “লোকটা একটা নোংরা কথা বলে চলে গেল, গায়ে হাত দিল, ঘুরে একটা থাপ্পড় মারতে পারলি না?” হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। আলোচনা ধর্ষণ ও যৌনহিংসার মতো গুরুতর অপরাধ নিয়েই।
ধর্ষিতা বা যৌনআক্রমণের শিকার এমন কেউ যদি আক্রমণের ঠিক আগে পালাতে না পারেন, তাহলে এই অতি চেনা প্রশ্নগুলো তাঁর দিকে বিষাক্ত তিরের ফলার মতো ধেয়ে আসে। প্রথমে প্রশ্ন আসে পরিচিত এবং আশেপাশের মানুষদের কাছ থেকে। তারপর একই প্রশ্ন শুনতে হয় থানায় দাঁড়িয়ে কয়েকপ্রস্থ পুলিশি জেরার সময়, যখন আইনের রক্ষকরা অভিযোগ নিতে চান না। কারণ বিপদ দেখেও মেয়েটি পালিয়ে যায়নি! কপালজোরে তাঁরা যদি অভিযোগ নিতে রাজিও হন, আর সেই মামলা যদি আদালত অবধি গড়ায়, অপরপক্ষের উকিলও একইভাবে অভিযোগকারিণীর দিকে আঙুল তুলে থাকেন। কারণ তিনি পালাননি ধর্ষণের আগে। চিৎকার করে লোকও ডাকেননি। সমাজের চোখে দোষ তো তাঁরই। ধর্ষকের দোষ সেখানে লঘু।
আরও পড়ুন- ডিয়ার পুরুষ, ‘লড়কিও কি না মে হাঁ নেহি হোতি হ্যায়’
অনেক মহিলাই জানিয়েছেন ধর্ষণের আগে তিনি দৌড়ে পালিয়ে যেতে পারেননি। চিৎকার করার সময়ে গলা থেকে আওয়াজও বেরোয়নি। যখন জানতে চাওয়া হয়, কেন তাঁরা পালাতে পারলেন না, উত্তরে তাঁরা অসহায়ের মতো বলেছেন, শরীর আর চলছিল না। বিপদের মুখে শরীর না চালাতে অক্ষম হয়ে, থম মেরে বসে যাওয়ার এই ঘটনাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে 'ফ্রিজিং'।
ধর্ষণের আগে ধর্ষিতার পালিয়ে না যাওয়া, বরং বলা ভালো পালাতে না পারার ব্যাখ্যা দিয়ে ২০২৩ সালে ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডনের ইনস্টিটিউট অফ কগনিটিভ নিউরোসায়েন্সের দুই বিজ্ঞানী ইবানি ধাওয়ান ও প্যাট্রিক হ্যাগার্ড একটি সাড়া-জাগানো গবেষণা প্রকাশ করেন ‘নেচার হউম্যান বিহেভিয়ার’ জার্নালে। নিউরোবিজ্ঞানের লেন্স থেকে এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তাঁরা বলেন, আচমকা বিপদ মানুষ ও যে কোনও প্রাণীর শরীরে ‘ফ্রিজিং’-এর মতো প্রতিক্রিয়া ঘটাতে বাধ্য করে। ‘ফ্রিজিং’-এর শিকার হলে কোনও ব্যক্তি ও অন্যান্য প্রাণী যে কোনও ভঙ্গিতে স্থির হয়ে, থমকে যেতে পারেন। যাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘টনিক মোবিলিটি' বলে। আবার এমনটাও হতে পারে, সেই ব্যক্তি কিংবা প্রাণীর শরীরের পেশিগুলোর স্বাভাবিক ‘টোন’ লোপ পেল।
পেশির ‘টোন’ আসলে আমাদের দাঁড়িয়ে থাকতে, বসতে, বসার পর উঠতে সাহায্য করে। পাশাপাশি, আমাদের অঙ্গগুলো আমরা কতটা দ্রুত গতিতে নাড়াচাড়া করতে পারব, সেই নাড়াচাড়ার কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারব, এইসব কিছুর জন্যে দায়ী পেশির ‘টোন’। পেশির ‘টোন’ না থাকলে আমাদের সামান্য হাত-পা নাড়ার ক্ষমতাও লোপ পাবে। বিপদের মুখে পড়ে হঠাৎ যদি পেশির ‘টোন’ লোপ পায়, সে ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে থাকা কিংবা চলন্ত মানুষও হঠাৎ মাটিতে বসে পড়বে। ‘ফ্রিজিং’-এর সময়ে এরকম ঘটনা ঘটলে একে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে ‘কোলাপ্সড মোবিলিটি’।
বিপদ দেখলে আমাদের মস্তিষ্ক মূলত তিনরকম ভাবে সাড়া দেয়। যদিও বলা হয়, এমন অবস্থায় মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী দু’রকম প্রতিক্রিয়া দেখায়। সে হয় লড়াই করে – যাকে বলে ‘ফাইট মোড’; কিংবা সে পালিয়ে যায়, যা ‘ফ্লাইট মোড’ নামেও পরিচিত। কিন্তু এছাড়াও, এই দুইয়ের মাঝামাঝি দেখা যায় ‘ফ্রিজ’ মোড। এই প্রত্যেকটি অভিব্যক্তি দেখানোর ক্ষমতা মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীরা লাভ করেছে নিজেকে বাঁচানোর জন্য। আর এই ক্ষমতা অর্জন করতে অভিযোজনের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। যে যাত্রাপথের প্রতিটা পদক্ষেপের ইতিহাস জেনেটিক স্মৃতি হিসেবে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে গাঁথা হয়ে গেছে আমাদের জিনে। যে অভিযোজনের মূল লক্ষ্যই আপেক্ষিকভাবে শক্তিশালী প্রজাতিটিকে পৃথিবীর বুকে বাঁচিয়ে রাখা। আর এতগুলো বছর বেঁচে থাকার ফলে মানুষের মস্তিষ্ক যত উন্নত হয়েছে,তার গঠনগত ও কার্যগত জটিলতাও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। আরও নিখুঁত ও সূক্ষ হয়েছে মানুষের বেঁচে থাকার স্বাভাবিক সহজাত প্রবৃত্তি
বা ‘সার্ভাইভাল ইন্সটিঙ্কট’।
বিপদ দেখে লড়াই করা অথবা পালিয়ে যাওয়া, এই দু'টি ক্ষেত্রে মানুষের শরীরে সক্রিয় হয়ে ওঠে ‘সিম্প্যাথেটিক’ স্নায়ুতন্ত্র। কিন্তু ‘ফ্রিজিং’-এর ক্ষেত্রে ‘সিম্প্যাথেটিক’ স্নায়ুতন্ত্রের পাশাপাশি, নড়েচড়ে বসে ‘প্যারাসিম্প্যাথেটিক’ স্নায়ুতন্ত্রও। এই দুই-ই ‘অটোনমিক নার্ভাস সিস্টেম’-এর অংশ। এই দুই আলাদা-আলাদা স্নায়ুতন্ত্রের সক্রিয়তার তারতম্যের উপর নির্ভর করছে ‘ফ্রিজিং’-এর মুহূর্তে মানুষটি কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে।
আরও পড়ুন- ‘মেয়েছেলে’ চাকরি করছে মানেই বসের সঙ্গে শুতে যাচ্ছে?
মানুষ যখনই বিপদ আঁচ করে, সেই বার্তা তড়িৎবেগে পৌঁছে যায় মস্তিষ্কের ভেতরে অ্যামিগডালার কাছে। যাকে বলে মস্তিষ্কের ‘ফিয়ার সেন্টার’। তার কাজই ভয়কে চিনে নেওয়া। সে দ্রুত খবর দেয় হাইপোথ্যালামাসকে। এটি মস্তিষ্কের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক গ্রন্থি, যার কাজই হলো শরীরে সাম্যাবস্থা বজায় রাখা। এরপর ঠিক রিলে রেসের মতো হাইপোথ্যালামাস বার্তা পাঠায় অ্যাড্রিনালিন গ্রন্থিকে। সে সজাগ হয়ে অ্যাড্রিনালিন হরমোন তৈরি করে, নিমেষের মধ্যে যা শিরা-ধমনী বেয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এই হরমোন যেমন আমাদের মধ্যে ক্রোধ জাগিয়ে তুলতে পারে, তেমনই ভয় সঞ্চারও করতে পারে। উদ্রেক করতে পারে দুঃশ্চিন্তারও।
সাধারণত রাগ, ভয় অথবা দুঃশ্চিন্তায় পড়লে আমাদের হৃদপিণ্ডের গতিবেগ বেড়ে যায়। কারণ তখন ‘সিম্প্যাথেটিক’ স্নায়ুতন্ত্র বেশি সক্রিয়। যে স্নায়ুতন্ত্রের কাজই হলো অ্যাড্রিনালিন হরমোনের ক্ষরণ বাড়িয়ে হৃদস্পন্দন, রক্তচাপ আর নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের গতিকেও বাড়িয়ে তোলা। কিন্তু ‘ফ্রিজিং’-এর ক্ষেত্রে হয় ঠিক উল্টোটা। হৃদপিণ্ডের গতিবেগ ক্রমশই কমতে থাকে। যাকে বলে ব্রাডিকার্ডিয়া। কারণ তখন সক্রিয় থাকছে ‘প্যারাসিম্প্যাথেটিক’ নার্ভাস সিস্টেম। যার কাজ ঠিক ‘সিম্প্যাথেটিক’ স্নায়ুতন্ত্রের বিপরীত। ব্রাডিকার্ডিয়া ওতপ্রোতভাবে ‘ফ্রিজিং’-এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ব্রাডিকার্ডিয়ার পাশাপাশি কমতে শুরু করে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের গতি। একই সঙ্গে শরীরের তাপমাত্রার বদল হতে পারে। ক্ষীণ হয়ে যেতে পারে গলার স্বরও।
‘প্যারাসিম্প্যাথেটিক’ নার্ভাস সিস্টেম সক্রিয় হলে অ্যাড্রিনালিন হরমোনের বদলে অ্যাসিটাইলকোলাইন নামের নিউরোট্রান্সমিটারের
ক্ষরণ বেড়ে যায়। আবারও রিলে রেসের মতো কিছু ধাপ অতিক্রম করে স্ট্রেস হরমোন ক্ষরণের বার্তা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে নানা রকম স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা, যারা সরাসরি ফ্রিজিং-এর জন্য দায়ী। ‘ফ্রিজিং’-এর মতো বিষয় দেখা যায় বিমানচালক বা চালিকাদের মধ্যেও যখন উড়ানের সময় হুট করে কোনও বিপদ হাজির হয়। একে বলে ‘লকআপ স্টেট’। বিপদ এলে তখন শরীর ‘ফ্রিজ’ করে যায়। অথচ বিমান দুর্ঘটনার পর যখন তদন্তের পর্ব শুরু হয়, আমরা কিন্তু বলি না চালক বা চালিকা কি বিপদের মুখে পড়ে
ইচ্ছাকৃতভাবেই স্তব্ধ হয়ে গেলেন? তিনি সত্যিই চেয়েছিলেন বিমানটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ুক?
কিন্তু ধর্ষণের ক্ষেত্রে?