স্বাভাবিকের থেকে ১৫১% বেশি বৃষ্টিপাত! কেন উপচে গেল ত্রিপুরার বাঁধ?
Bangladesh Flood: ত্রিপুরার বিদুৎ দফতরের মন্ত্রী বলেছেন, 'গোমতী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কোনও গেট খুলে দেওয়া হয়নি। এই বিদুৎকেন্দ্রের জলধারটির সর্বোচ্চ ধারণ ক্ষমতা ৯৪ মিটার। জলস্তর এর বেশি উঠলেই নিজে থেকেই জল গেট দিয়ে বেরোত...
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত গোমতী নদী লাগোয়া এলাকাগুলিতে বিগত কয়েকদিন ধরেই টানা ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। যার ফলে ভয়াবহ বন্যার সম্মুখীন একাধিক এলাকা। বন্যায় দিশেহারা প্রায় লক্ষাধিক মানুষ। বাংলাদেশের একাধিক সংবাদমাধ্যম অভিযোগ করেছে, টানা বৃষ্টি এবং ভারত থেকে আসা জলের কারণেই বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সংবাদ মাধ্যম 'বিবিসি'-র তরফে লেখা হয়, ভারতের ত্রিপুরার ডম্বুর হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্রজেক্ট বা ডম্বুর বাঁধের জলস্রোত বিপদসীমা ছুঁয়ে ফেলেছিল। ওই সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ত্রিপুরার গোমতীর জেলা প্রশাসক তড়িৎকান্তি চাকমা এক্স হ্যান্ডেলে জানিয়েছিলেন, বাঁধ বাঁচাতে গেট খুলে জল ছাড়া হয়। যদিও ইনস্ক্রিপ্ট তেমন কোনও তথ্য খুঁজে পায়নি। তবে আসল ঘটনাটি কী? ঠিক কী ঘটেছে ডম্বুর বাঁধে?
ভারী বৃষ্টিপাতের জন্যে হাওড়া,খোয়াই, মুহুরী ও ঢালাই-সহ রাজ্যের প্রায় বেশিরভাগ নদীই বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে। বন্যায় ত্রিপুরায় অন্তত ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে সে রাজ্যের বিপর্যয় মোকাবিলা দফতর। শুধু গত ২৪ ঘন্টায় মারা গিয়েছেন ৭ জন। এখনও নিখোঁজ ২। ত্রিপুরা রাজ্য সরকার বৃহস্পতিবার জানিয়েছে, প্রায় ১৭ লক্ষ মানুষ জলে আটকে রয়েছে। রাজধানী আগরতলা-সহ পার্শ্ববর্তী এলাকা প্রায় জলের নীচে তলিয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশেও প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। বন্যায় ডুবে গিয়েছে ১০টি জেলা। এখনও পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী, মৃত্যু হয়েছে অন্তত ৫ জনের।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যা, নেপথ্যে যে কারণ
ত্রিপুরা সরকার জানিয়েছে, গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে এমন ভয়াবহ বন্যা দেখেনি সে রাজ্য। রাজ্যের এক মন্ত্রী 'বিবিসি বাংলা'-কে বলেছেন, অগস্ট মাসে স্বাভাবিকের থেকে অন্তত ১৫১% বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। ৪ দিন ধরে টানা বৃষ্টিপাত হচ্ছে ওই রাজ্যে। ত্রিপুরায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত গোমতী জেলা। সূত্রের খবর, যেখানে গোমতী জেলায় অগস্ট মাসে ১৯৬.৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হওয়ার কথা, সেখানে ২৩৪% বেশি বৃষ্টি হয়েছে (৬৫৬.৬ মিলিমিটার)। এখানেই গোমতী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের অধীনে ডম্বুর জলধারটি অবস্থিত। ওই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি ত্রিপুরা রাজ্যের বিদুৎ দফতরের অধীনস্থ।
'বিবিসি'র অভিযোগ, ডম্বুর বাঁধের জলই ঢুকেছে গিয়ে বাংলাদেশে। যদিও এই তত্ত্ব খারিজ করে দিয়েছে ভারত সরকার। ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের তরফে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে, 'বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতির অবনতির জন্য ত্রিপুরার গোমতী নদীতে ডম্বুর বাঁধ থেকে জল ছাড়ার কারণকে দায়ী করা হয়েছে। এই তথ্য সঠিক নয়।' ত্রিপুরার বিদুৎ দফতরের মন্ত্রী 'বিবিসি বাংলা'কে বলেছেন, 'গোমতী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কোনও গেট খুলে দেওয়া হয়নি। এই বিদুৎকেন্দ্রের জলধারটির সর্বোচ্চ ধারণ ক্ষমতা ৯৪ মিটার। জলস্তর এর বেশি উঠলেই নিজে থেকেই জল গেট দিয়ে বেরিয়ে যেতে শুরু করে। জলস্তর সর্বোচ্চ ধারণ ক্ষমতার বেশি হয়ে যেতেই জলধারের দু'টি গেট দিয়ে জল বেরোনো শুরু হয়। এর মধ্যে একটি গেট দিয়ে ৫০% হারে জল বেরচ্ছে। সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষকে আগে থেকেই মাইকিং করে সতর্ক থাকার অনুরোধও জানানো হয়েছিল।' তিনি আরও বলেন, '১৯৯৩ সালের ২১ শে অগস্ট ত্রিপুরার সাব্রুমে একদিনে ২৪৭ মিলিমিটার বৃষ্টির রেকর্ড ছিল। আর এ বছর ২০ শে অগস্ট একদিনে বৃষ্টি হয়েছে ৩৭৫.৮ মিলিমিটার।'
অন্যদিকে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, 'তাঁরা যদি আসেন আমি নিজে গাড়ি করে নিয়ে যাব ডম্বুর দেখাতে।' তাঁর কথায়, 'কোনও ধরনের আগাম সতর্কতা ও প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ না দিয়েই বাঁধ খুলে দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে ভারত অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছে এবং বাংলাদেশের সঙ্গে অসহযোগিতা করেছে।' যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, 'ত্রিপুরার বন্যা নিয়ে ভারতীয় হাই কমিশনার প্রণব বার্মা বলেছেন, এতো বৃষ্টিপাত হয়েছে এটা ভারতেরও ধারণার বাইরে ছিল। সামাজিক মিডিয়াগুলিতে যেমনটি প্রচার হচ্ছে, তা দুঃখজনক।' 'বিবিসি'র তথ্য বলছে, ১৯৯৩ সালে শেষবার এই বাঁধ খোলা হয়েছিল।
২০১০ সালে ইতিহাসবিদ ইফতেকার ইকবাল তাঁর বই 'দ্য বেঙ্গল ডেল্টা: ইকোলজি, স্টেট অ্যান্ড সোস্যাল চেঞ্জ, ১৮৪০-১৯৪৩' - এ লিখেছিলেন— বাংলাদেশ বন্যা অনেকদিনের পুরোনো সমস্যা। ঔপনিবেশিক শাসকেরা উত্তর-দক্ষিণের নদীগুলির উপর দিয়ে পূব বরাবর টানা রেল লাইন বসায়, নির্বিচারে বাঁধ নির্মাণ করে, তখন থেকেই বন্যা কবলিত পূর্ববঙ্গ। উন্নয়নের নামে মানুষের তৈরি বন্যার ভয়াবহতার সূচনা তখন থেকেই। এ জন্য দীর্ঘদিন ধরেই ত্রিপুরা, কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম বন্যায় ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আরও পড়ুন: ‘বাংলাদেশি’ তকমা! ওড়িশায় কেন নির্যাতনের শিকার বাংলার শ্রমিকেরা?
পশ্চিম ত্রিপুরার খোয়াই জেলায় আগামী আরও দু'দিন অতি ভারী বৃষ্টিপাতের লাল সতর্কতা জারি করা হয়েছে। এছাড়াও ৬টি জেলায় কমলা সতর্কতা জারি রয়েছে। রাজ্যের ত্রাণ, পুনর্বাসন ও রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের তরফে জানানো হয়েছে, রাজ্যে মোট ৪৫০টি আশ্রয় শিবিরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই ৬৫,০০০ হাজারেরও বেশি মানুষ সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, উদ্ধারকাজে দু'টি হেলিকপ্টার আনা হয়েছে। জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী, অসম রাইফেলস, ত্রিপুরা স্টেট রাইফেলসও হাত লাগিয়েছে উদ্ধারকাজে। বাংলাদেশ ও ত্রিপুরা, দুই জায়গাতেই আরও বৃষ্টিপাতের সম্ভবনা রয়েছে বলে আবহাওয়া দফতর সূত্রের খবর।
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলি আশঙ্কা করছে, সিকিম থেকে নেমে আসা তিস্তা নদীতেও জল স্বাভাবিকের থেকে বেড়েছে। তবে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলীয় নদী বিশেষজ্ঞ তথা ওই অঞ্চলের পরিবেশ সংরক্ষণের কাজে যুক্ত রাজ বসু 'বিবিসি'কে বলেছেন, সম্প্রতি সিকিমে বড়সড় ভূমিধস হলেও, নদী অববাহিকায় ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে না। বুধবার থেকে তিস্তা ব্যারেজে জলস্তর সামান্য বেড়েছে, সেখানেও কয়েকটি গেট খুলে দেওয়া হয়েছে বলে 'বিবিসি বাংলা'য় লেখা হয়েছে। ওয়াকিবহাল মহলের দাবি, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পালাবদলের পর মহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে কোনও দ্বন্দ্বে জড়াতে চায় না ভারত সরকার। যে কারণেই ও দেশের সরকারি তরফে কোনও অভিযোগ না উঠলেও তড়িঘড়ি বিবৃতি দিয়ে দিয়েছে এ দেশের বিদেশ মন্ত্রক।