ধ্বংসের মুখোমুখি ওয়ানাড়! একদিনে মৃত ১৫৬! কেন প্রতি বর্ষায় কেরলে ঘটছে বিপর্যয়?
Wayanad landslides: মালাপ্পুরমের নীলাম্বুর অঞ্চলের চালিয়ার নদী থেকে একাধিক মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে, বহু মানুষের দেহ ভেসে গেছে বলেও আশঙ্কা
১৫৬ জন মৃত! ২৪ ঘণ্টার মধ্যে, সেকেন্ডে সেকেন্ডে বেড়ে গিয়েছে মৃতের সংখ্যা। ২০০-র কাছাকাছি মানুষ আহত। কত মানুষ যে চাপা পড়ে আছেন ইয়ত্তা নেই। অর্থাৎ লাশের সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কাই বাড়ছে কেবল। প্রবল বৃষ্টি আর ভূমিধসে কেরলের ওয়ানাড় জেলা একেবারে বিধ্বস্ত। এত অল্প সময়ের মধ্যে প্রকৃতির বীভৎস বিপর্যয়ে এত মৃত্যু প্রশ্ন তুলছে আবার, এই ভূমিধস, প্রবল বর্ষণ, মৃত্যু— মানুষের তৈরি নয় কি? মঙ্গলবার, ৩০ জুলাই ভোরবেলা ওয়ানাড়ের মেপ্পাদির কাছে পাহাড়ি এলাকায় প্রবল বর্ষণের ফলে মেপ্পাদি পঞ্চায়েতের অন্তর্গত মুন্ডক্কাই এবং চুরমালা গ্রামে বেশ কয়েকটি ভূমিধসের খবর পাওয়া গেছে। মালাপ্পুরমের নীলাম্বুর অঞ্চলের চালিয়ার নদী থেকে একাধিক মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে, বহু মানুষের দেহ ভেসে গেছে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। মুন্ডাক্কাই গ্রামের দিকে যাওয়ার মূল সেতুটিই ভেঙে পড়ার পর উদ্ধারকার্যও ব্যাহত হয়।
প্রবল বৃষ্টিতে মঙ্গলবার চার ঘণ্টার ব্যবধানে তিনটি ভূমিধস নামে ওয়ানাড়ে যার ফলে মুন্ডক্কাই, চুরমালামালা, আত্তামালা এবং নুলপুঝা গ্রামগুলি প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। ভূমিধসের কারণে স্থায়ী সেতু ভেসে যাওয়ার পরে সেনাবাহিনী অস্থায়ী সেতু ব্যবহার করে ১,০০০ জনকে উদ্ধার করেছে। ওয়ানাড়ে মোট ৪৫টি ত্রাণ শিবির স্থাপন করা হয়েছে, সেখানে ৩,০৬৯ জনের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে, পিটিআই জানিয়েছে।
আরও পড়ুন- শুধু চেন্নাই নয়, ৩ ফুট জলের নীচে তলিয়ে যেতে চলেছে ভারতের ১২ টি শহর!
প্রায় প্রতি বছরই কেরলে বর্ষাকালে মারাত্মক ভূমিধস ঘটে। কেন এমনটা হয়?
কেরলে ২০১৮ সালে এক বিধ্বংসী বন্যা হয়েছিল। কেরলের ইতিহাসে এর চেয়ে বীভৎস বিপর্যয় আর হয়নি। ৪৮৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল সেই বন্যায়। সেই বছরের আগস্টে মাত্র তিন দিনে কেরলে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের এক তৃতীয়াংশ বৃষ্টি হয়েছিল। ১৯৬১ সাল থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে কের;এ বিভিন্ন ভূমিধসের কারণে ২৯৫ জনের মতো মানুষ মারা যায়। আর ২০১৮ সাল থেকে ভূমিধসের ফলে মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতির হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৯ আর ২০২০ সালের বর্ষাতেও একই রকমের বিপর্যয় ঘটে যাতে প্রায় শ'খানেক মানুষের মৃত্যু হয়। ২০২১ সালে, কেরলের কোট্টায়াম এবং ইদুক্কি জেলায় একাধিক ভূমিধস এবং বন্যার কারণেও বহু মানুষের প্রাণ যায়। ২০২২ সালেও বর্ষায় ভূমিধস এবং আকস্মিক বন্যায় বেশ কিছু মানুষ প্রাণ হারান।
ভারতের আবহাওয়া বিভাগ (আইএমডি) জানুয়ারি মাসে একটি প্রতিবেদন পেশ করে যাতে দেখা যায়, ২০২২ সালে কেরলে চরম আবহাওয়ার কারণে ৩২ জনের মৃত্যু হয়েছে। বন্যা ও প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে ৩০ জন মারা যান, বজ্রপাতে দু'জন মারা যান। ২০২২ সালের জুলাইয়ে, আর্থ সায়েন্স মন্ত্রক লোকসভায় জানায়, গত সাত বছরে দেশের সবচেয়ে বড় ভূমিধস ঘটেছে কেরলে। ২০১৫ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ঘটা ৩,৭৮২টি ভূমিধসের মধ্যে, প্রায় ৫৯.২ শতাংশ বা ২,২৩৯টিই ঈশ্বরের আপন এই দেশ কেরলে ঘটেছে।
কেরলের প্রায় ১৪.৫ শতাংশ জায়গাই ভূমিধসের ঝুঁকির মুখে। বিশেষজ্ঞদের মতে, উপকূলীয় জেলা আলাপ্পুঝা ছাড়া কেরলের ১৩টি জেলাতেই ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে। কেরল স্টেট ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অথরিটি রাজ্যের ১,৮৪৮ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে, অর্থাৎ রাজ্যের মোট ৪.৭৫ শতাংশ অঞ্চলকে ভূমিধসের প্রবল ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হিসাবে চিহ্নিত করেছে। কেরলের পশ্চিমঘাট অঞ্চলের প্রায় ৮ শতাংশ এলাকা দিয়ে মানুষের চলাচলকেই ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
সম্প্রতি এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ইদুক্কি, পালাক্কাড়, মালাপ্পুরম, পাথানামথিট্টা এবং ওয়ানাড়েই ভূমিধসের আশঙ্কা প্রবল। কেরল ইউনিভার্সিটি অফ ফিশারিজ অ্যান্ড ওশান সায়েন্সেসের গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৮ সালের ভয়াবহ বৃষ্টিপাতের পরে এই রাজ্যে চরম ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে এমন অঞ্চলের পরিমাণ ৩.৪৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বর্ষাকালে কেরলে এই ঘন ঘন ভূমিধসের জন্য জলবায়ু পরিবর্তনই মূলগত কারণ। বনভূমি ধ্বংস রয়েছে এর নেপথ্যে। গত কয়েক বছর ধরেই কেরলে বৃষ্টিপাতের ধরণ বদলে গেছে। রাজ্যে এখন বর্ষা ঢুকতে দেরি হয়। আগে কেরলে বর্ষা ঢুকত ১ জুন। এখন জুনের প্রথম সপ্তাহ পেরিয়ে যাচ্ছে, এমনকী মাঝে মাঝে দ্বিতীয় সপ্তাহও। মাঝে মাঝে বৃষ্টি হচ্ছে, একটানা হচ্ছে না। জুলাইয়ের শেষের দিক থেকে অগাস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত এখানে প্রচণ্ড তীব্র বৃষ্টিপাত হয়।
আরও পড়ুন- Climate Change: বদলাচ্ছে পৃথিবীর আকৃতি, যে ভয়াবহ বিপদের মুখে আমরা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্ষার বৃষ্টিপাতের পরিমাণে কিন্তু খুব বেশি তারতম্য ঘটেনি। তবে এখন কম পরিমাণ দিনে বেশি পরিমাণ বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে। একদিনে নজিরবিহীন প্রবল বৃষ্টির জন্যই বন্যা এবং ভূমিধসের মতো বিপর্যয় ঘটে। পুরোটাই গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলাফল। পাশাপাশি মানুষের ভূমিকাও রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় নির্মাণকার্য চালিয়ে সংবেদনশীল জায়গাগুলিকে আরও বিপদে ফেলা হচ্ছে। কেরলে এমন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় প্রচুর নির্মাণকার্য চলছে। চলছে রাস্তা বা কালভার্ট নির্মাণ। অনেক জায়গাতেই নদীর জন্য জায়গা ছাড়াই হচ্ছে না। হড়পা বানের নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি। অবৈজ্ঞানিক নির্মাণ প্রক্রিয়ার জন্য ক্রমেই ধ্বংসের মুখে কেরল।
ভূ-সংস্থান, ভূতত্ত্ব, মাটি এবং গাছপালার উপর জলের প্রভাবের কারণেই ভূমিধস হয়। কেরলের পশ্চিমঘাট পার্বত্য এলাকায় পুরু মাটির আচ্ছাদন ছিল কিন্তু বছরের পর বছর ধরে মানুষ সেখানে নানা কাজ করে ভারসাম্য নষ্ট করেছে। ফলে বর্ষাকালে, বৃষ্টির জলের কারণে মাটি আলগা হয়ে যখন দুর্বল হয়ে যায়, গাছপালাও আর মাটিকে ধরে রাখতে পারে না। চরমসীমায় গিয়ে মাটির ভর দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তা নেমে আসে। এই পার্বত্য এলাকার উপরিভাগে ছোট ছোট ড্রেনেজ চ্যানেল রয়েছে। প্রাকৃতিক বাঁধও মাটির এই প্রাকৃতিক প্রবাহকে বাধা দেয়। এই ড্রেনেজ চ্যানেলগুলির উপর বা কাছাকাছি বাড়িঘর তৈরি করা উচিত নয়। অন্ততপক্ষে বেশ কিছুটা জায়গা ছাড়া উচিত। নাহলে কেরলের মানুষের অস্তিত্বই বিপন্নতার মুখে!