টাইমড আউট হতে পারতেন সৌরভ গাঙ্গুলিও! ১৬ বছর আগে কীভাবে বেঁচে যান তিনি?
Sri Lanka Bangladesh Timed Out Controversy: অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউস নয়, বরং আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বিশ্বে এই ধরনের আউটের প্রথম শিকার হতে পারতেন ভারতের প্রাক্তন অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়।
খেলার মাঠে সৌজন্য নয় বরং তিক্ততায় ভরে থাকল শ্রীলঙ্কা এবং বাংলাদেশের ম্যাচ। টাইম আউট নিয়ে যে তিক্ততা শুরু হলো তা নিয়ে রীতিমতো যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হলো অরুণ জেটলি স্টেডিয়াম। এমনকী বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের সঙ্গে হ্যান্ডশেক পর্যন্ত করলেন না শ্রীলঙ্কার খেলোয়াড়রা। একই সঙ্গে বাংলাদেশের তানজিম শাকিবের সিদ্ধান্ত নিয়েও শুরু হয়েছে বিতর্ক। তুমুল ট্রোলিং চলছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। বাংলাদেশ স্বভাবতই রয়েছে শাকিবের পাশে কিন্তু ভারত সহ অন্যান্য দেশগুলি কিন্তু একেবারেই পাশে নেই বাংলাদেশের এই সিদ্ধান্তের।
কেন আউট হলেন অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউস?
এই যাবতীয় বিতর্ক শুরু হয়েছিল বিশ্বের সর্বপ্রথম টাইম আউট হওয়ার সিদ্ধান্তকে নিয়ে। শ্রীলঙ্কার ইনিংসের ২৫ তম ওভারে সমরবিক্রম আউট হয়ে যাওয়ার পরেই মাঠে আসেন অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউজ। যখন তিনি মাঠে নামেন সেই সময় কোনও সমস্যা হয়নি। কিন্তু, সমস্যা হয়ে যায় হেলমেট নেওয়ার সময়। তিনি যখন ব্যাট করতে নামেন তখন তাঁর হেলমেটের স্ট্র্যাপ খোলা ছিল। ফলে, হেলমেট পরিবর্তন করতে চান তিনি। নিজের দলের ডাগ আউটের দিকে নির্দেশ করে তিনি একটি বিকল্প হেলমেট আনতে বলেন। সেখানেই হয়ে যায় সমস্যা। হেলমেট আনতে দেরি হওয়ায় ততক্ষণে শাকিব আল হাসান দ্বারস্থ হন আম্পায়ারের। প্রশ্ন করেন, নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গিয়েছে, তাই কেন আউট দেওয়া হবে না অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউসকে? সেই সময় আম্পায়ার শাকিবের দাবি সমর্থন করেন আর তাঁর পক্ষেই রায় দেন। আম্পায়ারের এই নির্দেশে টাইমড আউট হয়ে যান অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউস।
নিয়মটা আসলে কী?
ক্রিকেটের নিয়মের মধ্যে একটা এই ধরনের আউটের নিয়ম অবশ্যই আছে। যদি কোনও একজন ব্যাটার আউট হয়ে যাওয়ার পরে নতুন খেলোয়াড় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাউন্ডারির মধ্যে না আসতে পারেন, তাহলে তাঁকে আউট ঘোষণা করার একটা নিয়ম আছে। এই সময়টাও পুরোপুরি নির্ধারিত। টেস্ট ক্রিকেটের ক্ষেত্রে এই সময়টা ১৮০ সেকেন্ড। ওয়ান ডে ক্রিকেটের ক্ষেত্রে এই সময়টা ১২০ সেকেন্ড। আর ২০ ওভারের খেলার ক্ষেত্রে এই সময়টা মাত্র ৯০ সেকেন্ড। অর্থাৎ, এত ভাবনা চিন্তার সময় খেলোয়াড়দের হাতে থাকে না।
এবারে অনেকেই ভাবতে পারেন,অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউস তো ১২০ সেকেন্ডের মধ্যেই ক্রিজে এসে গিয়েছিলেন। ফলে এর পরেও কেন এই নিয়ম ধার্য হলো তাঁর উপরে। আসলে বিষয়টা হলো, এই নিয়ম অনুযায়ী পুরোপুরি নির্দেশিত হেলমেট এবং ব্যাট নিয়ে তবেই আপনাকে সময়ের মধ্যে আসতে হবে। যদি আপনার হেলমেটের কোনও সমস্যা হয় বা ব্যাট খারাপ হয় তাহলেও কিন্তু এই একই নিয়ম কাজ করবে। আর সেটাই হয়েছে অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউসের ক্ষেত্রে। যেহেতু তাঁর হেলমেট ঠিক ছিল না, সেই কারণেই তাঁকে আউট ঘোষণা করে দেন আম্পায়ার।
শাকিবকে নিয়ে বিতর্কের ঝড়
খেলার নিয়মেই তিনি খেলেছেন। ফলে, অনেকেই শাকিবের প্রশংসা করেছেন কারণ তিনি নিজের বুদ্ধি দিয়ে বাংলাদেশকে একটা উইকেট পাইয়ে দিয়েছেন। তবে, এই ধরনের সিদ্ধান্তের বিরোধিতাও অনেকে করেন। শাকিব আল হাসানের এই আবেদনের কারণে অনেকেই তাঁর স্পোর্টসম্যান স্পিরিট নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এমনকী এই হ্যান্ডশেক বিতর্কের পরে, পোস্ট ম্যাচ প্রেজেন্টেশনে নিজেও এই বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি বলেছেন, "এরকম আউট ঠিক না কি ভুল সেটা আমি জানি না। আমি জানি এটা নিয়ে পরে অনেক বিতর্ক হবে। তবে, যখন আমার দলের দরকার তখন আমি এই সিদ্ধান্তটা নিতে বাধ্য। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ একটা যুদ্ধের মধ্যে রয়েছে। আর এই যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে হারাতে যে সিদ্ধান্তই গ্রহণ করতে হয়, সেটাই আমরা নেব।"
সিদ্ধান্ত ঠিক নাকি ভুল?
শ্রীলঙ্কার অধিনায়ক কুশল মেণ্ডিস বলেছেন, শ্রীলঙ্কার খেলোয়াড় অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউস ক্রিজে আসতে দেরি করেছিলেন তার কারণ হলো, মূলত ইকুইপমেন্ট ম্যালফাংশন। তাঁর হেলমেটের স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে গিয়েছিল বলে তিনি সেই সময় ক্রিজে ঢুকতে পারেননি। ফলে, এই বিষয়টা একবার ভেবে দেখা যেতে পারত। বিশ্বের অন্যান্য ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা যদিও বলেছেন, শাকিব আল হাসান এই সিদ্ধান্ত নিয়ে কিন্তু খুব একটা ভুল কাজ করেননি। ইকুইপমেন্ট ঠিক রাখার দায়িত্ব পুরোপুরিই বিপক্ষ দল এবং সেই খেলোয়াড়ের উপর বর্তায়। খেলোয়াড় যদি দেরি করে মাঠে আসেন এবং এই দেরি করার মাসুল যদি নিজেদের উইকেট খুইয়ে গুনতে হয়, তাহলে সেই ভুলটা সম্পূর্ণভাবে সেই খেলোয়াড়েরই। যেহেতু ক্রিকেটের নিয়মে পরিষ্কারভাবে বিষয়টা লেখা রয়েছে, তাই শাকিবের সিদ্ধান্ত কোনওভাবেই খারাপ নয়।
শাকিবের এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পিছনে আরও একটি কারণ রয়েছে। আদতে, ২০২৫ সালে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলতে পারবে সেই আটটি দল যেগুলি বিশ্বকাপের তালিকায় সেরা আটে রয়েছে। বাংলাদেশ নেদারল্যান্ডের কাছে হেরে ইতিমধ্যেই ২ পয়েন্ট খুইয়ে ফেলেছিল। সেই কারণে শ্রীলঙ্কা ম্যাচ থেকে দুটো পয়েন্ট তুলতেই হতো টাইগারদের। এই ম্যাচটার গুরুত্ব তাদের কাছে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে যাওয়ার থেকেও বেশি। তাই, যদি সেই সময় শাকিব এই সিদ্ধান্ত না নিতেন, তাহলে হয়তো আরও দুই পয়েন্ট খুইয়ে ফেলত বাংলাদেশ।
কী প্রতিক্রিয়া হলো এরপর?
এই সিদ্ধান্তের ফলে বিরক্ত এবং হতাশ ম্যাথিউস ডাগ আউটে প্রবেশ করে সজোরে নিজের ব্যাট ছুড়ে মারেন। এই আউটের সিদ্ধান্ত নিয়ে ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও দ্বিমত রয়েছে। শ্রীলঙ্কার প্রাক্তন অলরাউন্ডার রাসেল আর্নল্ড বলছেন, আমি যতদিন ক্রিকেট খেলেছি এরকম জিনিস কিন্তু কখনই দেখিনি। অন্যদিকে, ওয়াকার ইউনিস এই সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, "এরকম সিদ্ধান্ত কিন্তু ক্রিকেটের স্পিরিটের ক্ষেত্রে খুব একটা ভালো নয়। এর ফলে বাংলাদেশ উইকেট পেল ঠিকই, কিন্তু স্পোর্টসম্যান স্পিরিট তারা দেখাতে পারল না মাঠে।"
তবে, ভারতের সঞ্জয় মঞ্জরেকার এবং পাকিস্তানের রামিজ রাজা বাংলাদেশকেই সমর্থন করেছেন এই সিদ্ধান্ত নিয়ে। সঞ্জয় মঞ্জরেকার বলেছেন, ইদানীংকালে সাদা বলের ক্রিকেটে খেলোয়াড়দের মাঠে আসা নিয়ে যে ঢিলেঢালা মনোভাব দেখা যায়, তাতে কোনও না কোনওদিন এটা হতোই। এবারে হয়তো অন্যান্য খেলোয়াড়রা একটুখানি সময়জ্ঞান দেখাতে পারবেন। অন্যদিকে, রামিজ রাজা বলেছেন, এমনিতেই সেই সময় বাংলাদেশের বোলিং রেট স্লো ছিল। এর ফলে শেষে দশ ওভার শাকিবকে অতিরিক্ত একটা ফিল্ডার ৩০ গজের রেখার মধ্যে রাখতে হবে। অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউস শেষের দিকে বেশ ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারেন। তাই যদি অতিরিক্ত প্লেয়ার ভিতরে রেখে খেলা হতো, তাহলে অনেকটা পাওয়ার প্লের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো বাংলাদেশের জন্য, যা তাদের জন্য খুবই খারাপ হতো। ফলে, শাকিব আল হাসান এই সিদ্ধান্ত নিয়ে কোন ভুল কাজ করেননি।
এর আগেও হয়েছে এরকম আউট?
ক্রিকেট ইতিহাসে কিন্তু এই ধরনের টাইম আউট-এর ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। আর সেই ঘটনা ঘটেছে ভারতেই। ১৯৯৭ সালের ২০ ডিসেম্বর ওড়িশা এবং ত্রিপুরার রঞ্জি ট্রফি ম্যাচে এইভাবে আউট হয়েছিলেন ত্রিপুরার ব্যাটার হেমু যাদব। কটকের বারবাটি স্টেডিয়ামে সেই ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং সেই ম্যাচে ওড়িশার হয়ে অধিনায়কত্ব করেছিলেন প্রাক্তন ভারতীয় পেসার দেবাশিষ মহান্তি। সেই ম্যাচে প্রথম থেকেই চালকের আসনে ছিল ওড়িশা। আট উইকেটে ৫২১ রান তুলে ত্রিপুরাকে চাপে ফেলে দেয় ওড়িশা। এরপর ব্যাট করতে নেমে প্রথমেই ২ উইকেট হারিয়ে বিপদে পড়ে ত্রিপুরা।
পরবর্তীতে লড়াই করার চেষ্টা করলেও, পরপর পাঁচটা উইকেট নিয়ে ত্রিপুরার ব্যাটিং লাইনআপ একেবারে ধ্বংস করে দেন দেবাশিষ মহান্তি। তাঁর এই বোলিংয়ের কারণে মাত্র ২৩৫ রানে ৯ উইকেট হারিয়ে ফেলে ত্রিপুরা। শেষে ১১ নম্বরে ব্যাট করতে নামার কথা ছিল হেমু যাদবের। সেই সময়, আম্পায়ারের সিদ্ধান্তে দেওয়া হয় ড্রিঙ্কস ব্রেক। কিন্তু ড্রিঙ্কস ব্রেক শেষ হয়ে যাবার পরেও আর ব্যাট করতে নামেননি হেমু যাদব। অনেকে মনে করেন, ত্রিপুরার ব্যাটিংয়ের এরকম অবস্থার পরে তিনি আর ব্যাট করতে নামতে চাননি। তাই বাধ্য হয়ে আম্পায়াররা হেমুকে টাইমড আউট ঘোষণা করেন।
টাইমড আউট হতে পারতেন সৌরভ গাঙ্গুলিও
অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউস নয়, বরং আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বিশ্বে এই ধরনের আউটের প্রথম শিকার হতে পারতেন ভারতের প্রাক্তন অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। কিন্তু সেই সময়, বিপক্ষের অধিনায়ক এরকম কোনও সিদ্ধান্ত না নেওয়ার কারণে তিনি বেঁচে যান। ঘটনাটা ঘটেছিল ২০০৭ সালে কেপটাউনে। সেই সময় দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে একটা টেস্ট খেলতে গেছিল ভারত। সৌরভের মাঠে নামার কথা ছিল না। প্রথম উইকেট পড়ার পরে মাঠে নামার কথা ছিল সচিনের। তবে তিনি যেহেতু ফিল্ডে একটা লম্বা সময় কাটিয়ে ফেলেছেন, তাই তিনি মাঠে নামতে পারেননি। অন্যদিকে, সচিনের পরবর্তী ব্যাটার ভিভিএস লক্ষণ তখন স্নান করছিলেন। সেই সময় বাধ্য হয়ে মাঠে নামতে হয় সৌরভকে। টেস্টে তিন মিনিটের মধ্যে নতুন খেলোয়াড়কে মাঠে নামতে হয় পুরোপুরি তৈরি হয়ে।
তিন মিনিটের অনেক পরেই সৌরভ গাঙ্গুলি মাঠে এসেছিলেন। কিন্তু, প্রোটিয়া অধিনায়ক গ্রেম স্মিথ সেই সময় এই সিদ্ধান্ত নেননি। যদি তিনি আম্পায়ারের কাছে এরকম আউটের দাবি জানাতেন, তাহলে হয়তো কোনও বল না খেলেই প্যাভিলিয়নে ফিরে যেতে হতো সৌরভকে। পরে, একটি প্রেস বিবৃতিতে গ্রেম স্মিথ এই বিষয়টা নিজেই জানিয়েছিলেন। এরকম ভাবে আউট করে খেলার পরিবেশ নষ্ট করতে চাননি কখনই।