যুগ যুগ ধরে ভালোবাসার প্রতীক তিনি, সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের হৃদয় আজও রাখা আছে এই জায়গায়
St. Valentine's Heart Valentines Day : জড়িয়ে রয়েছেন আরও একজন – সেন্ট ভ্যালেন্টাইন। যার নামে, যার জীবনযুদ্ধের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে এই ভালোবাসার দিনটি।
১৪ ফেব্রুয়ারি। অজস্র মন খারাপ, বিষাদ, মৃত্যু, হাহাকার পেরিয়ে এই একটি দিন পৃথিবী মেতে ওঠে ভালোবাসায়। সেইসঙ্গে থাকে স্বপ্ন দেখার প্রত্যাশা; হাজার ঝড়ের ভিড়েও ভালোবাসার বাণী, প্রেমের স্পর্শ ছড়িয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার। গোলাপ, টেডি বিয়ার, চকোলেটের ভিড়ে লুকিয়ে থাকে এক চমকপ্রদ ইতিহাস। সেই ইতিহাস যেমন সুন্দর, তেমনই বিষাদের। সেখানে জড়িয়ে রয়েছেন যিশু খ্রিস্ট, রয়েছে খ্রিস্ট ধর্ম। সেইসঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন আরও একজন – সেন্ট ভ্যালেন্টাইন। যার নামে, যার জীবনযুদ্ধের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে এই ভালোবাসার দিনটি।
কাট টু ডাবলিন। আয়ারল্যান্ডের রাজধানী এই শহরটি ছবির মতো সুন্দর। সেখানেই হোয়াইটফ্রায়ার স্ট্রিটেই রয়েছে কার্মেলাইট চার্চ। বাইরে থেকে দেখলে আর পাঁচটা সাধারণ বাড়ির মতো মনে হবে। ধূসর রঙের বিরাট স্থাপত্যটির মূল দরজা দিয়ে ঢোকার সময় দৃশ্যগুলি বদলে যাবে। ভেতরে অসম্ভব সুন্দর সব স্থাপত্যশিল্পী, মূর্তি, ফ্রেসকোর কারুকাজ। অদ্ভুত মায়াবী একটা পরিবেশে ভেসে যাচ্ছে কার্মেলাইট চার্চের অন্দরমহল। এই বিশেষ গির্জায় প্রতিবছর ভিড় জমান অগুনতি মানুষ। বিশেষ করে, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ভ্যালেন্টাইনস ডে-র দিনটিতে অনেকেই আসেন এখানে। কেন? কারণ এই বিশেষ চার্চে আজও ছড়িয়ে রয়েছেন স্বয়ং সেন্ট ভ্যালেন্টাইন! গোটা গির্জা জুড়ে তাঁর ছবি, মূর্তি। আর সেইসঙ্গে খুব সাবধানে, যত্ন করে রাখা একটি সুদৃশ্য বাক্স। মানুষের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু সেটাই। এই বিশেষ বাক্সেই আজও সংরক্ষিত রয়েছে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের হৃদপিণ্ড!
তাঁর নামের এই বিশেষ দিনটিতেই মন বিনিময় হয় অজস্র মানুষের। ১৫০০ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গিয়েছে। আর এই যুগ যুগান্ত ধরে প্রেমের প্রতীক হিসেবেই বেঁচে রয়েছেন সেন্ট ভ্যালেন্টাইন। অজস্র হৃদয়ভাঙা মানুষও এই দিনটির দিকে তাকিয়ে আশায় বাঁচেন। আর সেই বিশেষ মানুষটির হৃদয় এখনও রয়েছে ডাবলিনের হোয়াইটফ্রায়ার স্ট্রিটের কার্মেলাইট চার্চে। অবশ্য এই বিশেষ দিনটির সঙ্গে প্রাথমিকভাবে জুড়ে রয়েছে বিষাদ। কারণ, এই দিনটিতেই সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়।
গল্পটা ছোট্ট করে একবার বলে নেওয়া যাক। তৃতীয় শতকে রোমান পুরোহিত, কারও কারও মতে ডাক্তারও ছিলেন এই ভ্যালেন্টাইন। সেইসঙ্গে ছিলেন খ্রিস্টধর্মের প্রচারক। এদিকে তখনও গোটা পৃথিবীতে খ্রিস্ট ধর্মের এতটা প্রচার ও ব্যাপ্তই হয়নি। রোমান সাম্রাজ্য তখনও ক্ষমতায়। আর তাদের রাজত্বে খ্রিস্টানদের কোনও জায়গা ছিল না। খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারও করা যেত না। যদি কেউ ধরা পড়ত, সঙ্গে সঙ্গে তাকে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি দেওয়া হতো।
আরও পড়ুন : এখনও লেগে আছে যিশু খ্রিস্টের রক্তের দাগ! শ্রাউড অফ তুরিন কি সত্যিই ইতিহাস, না স্রেফ মিথ?
সেই সময় রোমের সম্রাট ছিলেন দ্বিতীয় ক্লডিয়াস। রোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে থেকেও ভ্যালেন্টাইন খ্রিস্ট ধর্মের প্রচার করতেম প্রেমের বাণী শোনাতেন। শেষমেশ ক্লডিয়াসের রোষানলে পড়েন তিনি। তাঁকে ধরে এনে কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়। ক্লডিয়াস নিজে তাঁকে শাস্তি দিলেন – মৃত্যুদণ্ড! কিন্তু তারপরও কোনও হেলদোল নেই ভ্যালেন্টাইনের। কারাগারের চার দেওয়ালের ভেতরেই নিজের মতো করে পড়াশোনা, সাধনা চালিয়ে যেতে লাগলেন। আর সেই দৃশ্যই আকর্ষণ করল সেই কারাগারের কারা রক্ষীকে।
একদিন সেই রক্ষী নিজেই বিশেষ অনুরোধ নিয়ে হাজির হলেন ভ্যালেন্টাইনের কাছে। তাঁর মেয়ে, জুলিয়া অন্ধ, খুব বুদ্ধিমতী। পড়াশোনা করার খুব ইচ্ছে। যদি কারাগারের ভেতরেই ভ্যালেন্টাইন তাঁকে পড়ান! তারপর থেকে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত জুলিয়াকে পড়াশোনা, ঈশ্বর জ্ঞান দিতেন ভ্যালেন্টাইন। তাঁর প্রার্থনার জোরেই নাকি দৃষ্টিশক্তিও ফিরে পেয়েছিলেন জুলিয়া। এমনই আশ্চর্য ঘটনা ঘটার পর এগিয়ে আসে মৃত্যুর দিন। আনুমানিক ২৬৯ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। তরোয়ালের এক কোপে ভ্যালেন্টাইনের মাথা ধড় থেকে আলাদা করে দেওয়া হয়। দিনটি ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি।
ঠিক এর একদিন আগের ঘটনা। মৃত্যুর মুহূর্ত আসন্ন। তার আগে জুলিয়াকে একটি চিঠি লিখলেন সেন্ট ভ্যালেন্টাইন। এখন দৃষ্টিশক্তি ফিরে এসেছে, সে নিশ্চয়ই সেই লেখা পড়বে। লম্বা সেই চিঠির নিচে লেখা ছোট্ট একটি লাইন। “From, Your Valentine.” মানব সভ্যতায় সেইদিন থেকেই অমর হয়ে গেল এই লাইনটি। আজও প্রেম নিবেদনে, প্রেমপত্র লেখার সময় এই লাইনটিই হয়ে ওঠে আপামর প্রেমিক-প্রেমিকাদের আশ্রয়।
আরও পড়ুন : ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গী, কীভাবে জন্ম হল টেডি বিয়ারের?
সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুর প্রায় ২০০ বছর পরের ঘটনা। ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে পোপ প্রথম জেলাসিউস ১৪ ফেব্রুয়ারিকে অমরত্ব দিলেন। তিনিই নির্দেশ দিলেন, আজ থেকে গোটা পৃথিবীতে এই ১৪ ফেব্রুয়ারি পালিত হবে ভ্যালেন্টাইনস ডে হিসেবে। খ্রিস্টীয় শ্রদ্ধা, বিষাদ ছাপিয়ে কখন যে সমস্ত ধর্মের বাঁধ ভেঙে দিল এই ১৪ ফেব্রুয়ারি। সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুর পর রোমেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। কিন্তু তাঁর শরীরের অবশেষ পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে। যেমন, রোমের ব্যাসিলিস্কা অফ সেন্ট মেরি-তে সংরক্ষিত আছে ভ্যালেন্টাইনের মাথার খুলি।
সেরকমই রোমের সেন্ট হিপ্পোলিটাস সিমেট্রিতে রক্ষিত ছিল সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের হৃদপিণ্ড। উনিশ শতকে পোপ ষোড়শ গ্রেগরি ডাবলিনের হোয়াইটফ্রায়ার স্ট্রিট কার্মেলাইট চার্চকে এই বিশেষ জিনিসটি উপহার দেন। তখন থেকে এই গির্জাতেই রয়েছে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের হৃদয়। আজও বহু মানুষের কাছে গির্জার এই বিশেষ জায়গাটি প্রেমের প্রতীক। সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের হৃদয়ের সামনে দাঁড়িয়েই অনেকে প্রেম নিবেদন করেন, অনেকে বিয়েও করেন। অনেকে আবার নিজের নিজের মাতৃভাষায় প্রেমের কথা লিখে যান। মৃত্যুর দেড় হাজার বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর সেন্ট ভ্যালেন্টাইন আজও অজস্র প্রেমের আশ্রয়দাতা।