মফস্সলের শানু-সন্ধ্যা এবং এক গিটারবাজিয়ের গল্প

Kumar Sanu and his magic at Barbil: কলকাতা থেকে ডবল নেক একটা ইলেকট্রিক স্টিল গিটার কিনে দিয়েছে বাবা। সে ব্যাপার একটা। ঢাউস একটা বাক্স ও কালো আরও ঢাউস একটা অ্যাম্প্লিফায়ার নিয়ে গাড়িতে চললাম আমরা।

সে বার জন্মদিনে লাল্টু দাদা, ‘দিল হ্যায় কে মানতা নহি’-র একটা ক্যাসেট দিল। কভারে সেই আইকনিক ছবি, চেন দেওয়া একটা টুপি পরে আমির খান আর পূজা ভাট। আমি তো যাকে বলে, উড়ছি। আসলে তার কিছু দিন আগেই, নোয়ামুণ্ডিতে অনেকটা জঙ্গল কেটে রাস্তা পেরিয়ে গিয়েছিলাম বাবা-মায়ের সঙ্গে অনুপ জলোটা শুনতে। গিয়েছিলাম মানে অবভিয়াসলি আমার কোনও চয়েস ছিল না। তো হুমড়ি খেয়ে সমস্ত বাঙালি গেছে। স্বাভাবিক। অমন নামজাদা এক শিল্পী আসছেন অনুষ্ঠান করতে, আশপাশ থেকে অনেকেই আসবেন। এর আগে এক বার আনন্দশঙ্কর এসেছিলেন, আমার যে খুব কিছু মনে আছে তা নয়। শুধু মনে আছে বাবা এবং আরও কয়েকজন একটি ঘটনায় রেগে বেশ গুম মেরে বসেছিল। হয়েছিল কী, তিনি তো দর্শকের দিকে পেছন ফিরে অর্কেস্ট্রা কন্ডাক্ট করছিলেন, এ বার অনেকক্ষণ অমন চলার পর, গান-টান পাচ্ছেন না বলে পাশ থেকে উড়িয়ায় কয়েকজন বিরক্ত হয়ে বলেছিল, ‘কী শুধু শুধু পেছন হিলাউছি…’ (মানে পেছন ঠিক বলা হয়নি, আরও ছোট্ট একটি শব্দ বলা হয়েছিল আসলে)। সে দিন ফেরার সময় বাবা প্রায় প্রতিজ্ঞা করেছিল আর এসব জায়গায় অনুষ্ঠান দেখতে আসবে না, কলকাতায় হলে দেখা যাবে নয়। কিন্তু তার কিছু দিন পরেই আবার আমরা চললাম। অনুপ জলোটা। পৌঁছে দেখি বসার জায়গা পাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। অগত্যা আমায় জিপের বনেটে বসিয়ে, বাবা-মা ওখানেই হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে শুনতে লাগল, ‘ম্যায়নে মাখন নহি খায়োওওওওওওওও…’।

আমার কাছে গোটা ব্যাপারটাই শকিং ছিল, এখন আর মনে পড়ছে না ঠিক কেন, কিন্তু ছিল এইটা মনে আছে। শকের প্রাণ গড়ের মাঠে আরও চৌচির হলো যখন খেয়াল হলো অকস্মাৎ ওই ক্যান্টিলিভার ব্রিজ-সম মাখন খায়োওওওও-র মধ্যেই কেমন করে যেন শ্বাস-টাস না হারিয়ে অনুপ জলোটা বলে বসলেন, ‘আরে তনিক হেডলাইট তো বুঝাইয়ে নহি তো বাকি কা মক্খন কওন খা ভাগেগা, পতা ভি নহি চলেগা!’, বলেই আবার ব্যাক টু মাখন খায়োওওওওওওওও…হঠাৎ খেয়াল হলো, আরে কিছুক্ষণ আগে তো আমাদেরও গাড়ির হেডলাইট জ্বলছিল! হ্যাঁ, তখন আর জ্বলছিল না এবং তিনি পাশের এক গাড়িকে উদ্দেশ্য করেই তা বলেছিলেন কিন্তু আমায় কে আর সেটা বোঝায়! বাড়ি ফেরার পথে, জিপের পেছনে বসে অল্প ঝুঁকে মুখে জঙ্গলের হাওয়া লাগাতে লাগাতে অবশ্য বোধ হয়েছিল, কানে পার্মানেন্ট ঝিঁঝিঁ হয়ে আছে ম্যায়নে মাখন নহি… বিশ্বাস করবেন না তা-ও বলছি, দিন দুই পর মায়ের কী একটা কোথায় রেখেছি প্রশ্নে, মুখ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল, বললাম যে ম্যায়নে মাখন নহি…

আরও পড়ুন: পরবাসে আগমনীর জলছাপ এঁকে গেলেন বাণীকুমার

তো এমনই আবহে এন্ট্রি নিলেন কেদারনাথ ভট্টাচার্য ওরফে কুমার শানু। তার আগে ‘কয়ামত সে কয়ামত তক’ শুনেছি, উদিত নারায়ণ, উফ! উফ! আবার মাঝেমাঝেই ‘জিলে লে জিলে লে আয়ো আয়ো…’ গাই, হাসান জাহাঙ্গীর তুলকালাম করেছেন ‘হাওয়া হাওয়া অ্যায় হাওয়া, খুশবু লুটা দে…’ বা ‘আ জানা না, দিল হ্যায় দিওয়ানা…’ গেয়ে। কিন্তু কুমার শানু কিছুতেই আর মনে ধরেন না। সমস্যা হচ্ছে, তখন যা-ই শুনছি, হয় বিশ্বকর্মা পুজোর প্যান্ডেলে বা ক্যাসেট কিনতে গেলেই, দেখি বাজছে শানু। আর কী সব সুর, বাপ রে! ‘আশিকি’, আহ! ‘সাঁসো কি জরুরত হ্যায় জ্যায়সে…’, আবার ‘অব তেরে বিন জি লেঙ্গে হম…’, সে বছরই তো এল ‘ফুল অওর কাঁটে’, ‘ধীরে ধীরে প্যায়ার কো বঢ়ানা হ্যায়…’, শুনতে অবশ্য লাগত ‘ধীঁরে ধীঁরে পেয়ার কোঁ বঢ়ানাঁ হ্যাঁয়, হদ্ সেঁ গুজর জাঁনা হ্যাঁয়…’

ওই একটা হয় না, অনেকদিন কারও সঙ্গে ঘর করতে করতে খেয়ালই থাকে না কখন যেন সহজ করে — আহা সবটা আমায় কেন, তুমিও নাও না, ভাগ করে হয়ে যাবে — বলে ফেলা হয়! শানুর সঙ্গে আমারও যেন তেমন হলো। আর লাল্টু দাদা ওই ‘দিল হ্যায় কে…’ ধরাতেই, ব্যাপারটা আরও হাওয়া পেল। ‘তু প্যায়ার হ্যায় কিসি আওর কা, তুঝে চাহ্তা কোই অওর হ্যায়…’ (এনাফ চন্দ্রবিন্দু লাগিয়ে গাইতে হবে) বাজছে ‘চিত্রহার’-এ, শুক্রবার, রাত ৮-টা। আমাদের নীল দেওয়ালে ল্যামিনেট করা মিষ্টি দুটো সাদা বেড়ালের ছবি আমার দিকে তাকিয়ে, আর আমি টিভির শাটার খোলা মাত্রই ভেতর থেকে লাফিয়ে বেরনো টিকটিকির দিকে। ওদিকে কোনও কিছুর পরোয়া না করে কুমার শানু, অনুরাধা পোড়ওয়াল গেয়ে চলেছেন ‘তু প্যায়ার হ্যায়…’। বাবা অফিসে গল্প করছে আন্টি কাকুর সঙ্গে আর মা ওখান থেকে একবার উঠে এসে আমায় মৃদু ভর্ৎসনা করে গেল, দিন দুই পরে আমার গিটার বাজানো চাইবাসার একটা মস্ত প্রোগ্রাম আর আমি বসে টিভি দেখে যাচ্ছি। খুব চালাক চতুর তখন আমি ছিলাম কি না আর মনে পড়ে না কিন্তু তখন মাকে আমি বলেছিলাম যে, ‘সাঁসো কি জরুরত’ যদি দেয় ‘চিত্রহার’-এ, সে জন্যই বসে আছি!’ আসলে, আমি হাওয়াইয়ান গিটার বাজাতাম, ক্লাসিকাল শিখতাম প্রয়াগ সঙ্গীত সমিতিতে আর পাশে চলত ‘আলো আমার আলো ও গো…’, ‘জাগো, তুমি জাগো…’-র সঙ্গেই ‘সাঁসো কি জরুরত’, ‘নীলে নীলে অম্বর…’, এ সব বাজনো-ও। তো সত্যিই সেবার, ওই গানটা বাজানোর ছিল, ফলে শুনে প্র্যাকটিসের একটা বাহানা, মা নির্ঘাৎ ধরেছিল, খুব একটা কিছু আমায় বলেনি। কিন্তু সেই চাইবাসার অনুষ্ঠানে গিয়ে শানুর অন্য এক রূপ দেখেছিলাম।

এখন আর মনে পড়ছে না, কিন্তু টিসকো বা ইসকো বা এমন কোনও বড় কোম্পানির অনুষ্ঠান ছিল। ঝাঁ চকচকে একটা হল-এ। চাইবাসা দিয়েই তো যাতায়াত হতো আমাদের যখন কলকাতা থেকে ফিরতাম, চক্রধরপুরে নেমে, চাইবাসায়, রঘুর হোটেলে ফ্ল্যাট করে দেওয়া ভাত, লম্বা পারশে মাছ বা হয়তো মাংস, এ সব খেয়ে তবে বিকেল পেরিয়ে সন্ধেয় ঢুকতাম ঘর। বরবিল। এবার উল্টো, চাইবাসা যাচ্ছি অনুষ্ঠান করতে। কলকাতা থেকে ডবল নেক একটা ইলেকট্রিক স্টিল গিটার কিনে দিয়েছে বাবা। সে ব্যাপার একটা। ঢাউস একটা বাক্স ও কালো আরও ঢাউস একটা অ্যাম্প্লিফায়ার নিয়ে গাড়িতে চললাম আমরা। এখনও মনে আছে যে শার্টটা পরে উঠেছিলাম স্টেজে। একটা হালকা সবুজ রঙের আবার কাঁধে কালো দুটো বোতাম দেওয়া ফ্ল্যাপ, ওই যেমন পুলিশের জামায় থাকে না। ওটা কেন যেন মনে হয়, লাকি শার্ট ছিল আমার। ছোট হয়ে যাওয়ার পরই, ধীরে বরবিল ছেড়ে চিরতরে এখানে। সে যাক…

তো, স্টেজে উঠছি। আমার সঙ্গে আমার গিটার স্যর, সচিন সেনগুপ্ত, না স্যরি, স্যরের সঙ্গে আমি। সচিন স্যরকে নিয়ে একদিন বলতে হবেই। ছ’ ফুট মতো লম্বা, বাইক চালিয়ে ওই চাইবাসা থেকেই শেখাতে আসত আমায়। অনেকটা দূরত্ব। কী করে করত কে জানে। কিন্তু করত। সচিন স্যর সেদিন উড়িয়ে দিয়েছিল, ‘নীলে নীলে অম্বর’-এর সাংঘাতিক ওই প্রিলিউড আর ইন্টারলিউড বাজিয়ে। আমি যখন স্টেজে উঠছি, একজন ঘোষক অবশ্য আরও উড়িয়ে দিয়েছিলেন! আমায় বলেছিলেন, ‘বঙ্গাল, উড়িষ্যা হিলানেকে বাদ ইয়ে ননহে মুন্নে কলাকার অব আয়েঁ হ্যাঁয় বিহার কো হিলানে…’! খুব অ্যাসিডিটি না হলে এমন কেউ যদিও বলেন না, অবশ্য ওটাই তাঁর কাজ। তো সে দিন, বাবার মুখটা মনে আছে, তখনও তো জানি না, ওই গর্ব দেখতে পাব না বেশিদিন…

সেদিন আমি নেমে যাওয়ার পর এক জন বাঙালি গায়ক উঠেছিলেন, তিনি দুটো গান গেয়েছিলেন, বলেছিলেন কুমার শানুর। সত্যি খুব চমকে গিয়েছিলাম, গানটা তখনও কলকাতার বাইরে আসেনি, তিনি কলকাতায় গিয়ে শুনে, গানটা তুলে গেয়েছিলেন আর হল-এর প্রায় ৬০ শতাংশ অবাঙালিকেও মুগ্ধ করে দিয়েছিলেন। গানটা, ‘কত যে সাগর নদী, পেরিয়ে এলাম আমি…প্রিয়তমা মনে রেখো…’। এই ক’দিন আগের কথা, গড়িয়ার একটা সেলুনে চুল কাটছি, পাশেই জগদ্ধাত্রী পুজো হচ্ছে, এই গানটা বাজতে শুনলাম। মনে পড়ে গেল ওই চাইবাসার এপিসোড।

আরও পড়ুন: অপলক সেই বৃদ্ধ এবং হাত ফস্কে যাওয়া একটি রকেট…

শুধু মনে পড়ল না, চাইবাসা থেকে ফেরার পর যখন কানাঘুঁষো শুনেছিলাম আমার স্কুল, সেন্ট মেরিজের এক প্রিয় দিদি/সিনিয়র অঞ্জলি (আসল নামটা দিলাম না) কার সঙ্গে যেন পালিয়ে গেছে, তখন কেমন লেগেছিল। ওর বোন আমাদেরই ক্লাসমেট ছিল। ও-ও স্কুলে আসা বন্ধ করে দিল। শানু’র গলায় ‘বস্ এক সনম চাহিয়ে…’ শুনছি অহরহ কিন্তু কতটা পথ পেরলে তবে পালিয়ে যাওয়া যায়, বুঝেছিলাম কি?

More Articles