ভ্রাতৃহত্যা আটকেছিলেন মহামায়া স্বয়ং, কোচবিহার রাজবাড়িতে আজও কিংবদন্তির হাতছানি

কোচবিহার মানেই 'রাজতন্ত্র'। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ সিংহর হাত ধরে গড়ে উঠেছিল অবিভক্ত ভারতের প্রথম পরিকল্পিত শহর।

পালবংশের শেষ রাজা 'দেবপাল' মারা যাওয়ার পর কামরূপ-সহ গোটা বাংলায় বিচ্ছিন্নভাবে কিছু গোষ্ঠী মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এরা নিজেদের শক্তি বাড়ানোর উদ্দেশ্যে পরস্পরের ওপর আঘাত হানতে থাকে বারবার। সাধারণ প্রজাদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে মেচ (কোচ) জনগোষ্ঠীর নেতা হাড়িয়া মন্ডলের সন্তান 'বিশু মন্ডল' বিভিন্ন ছোট ছোট জনগোষ্ঠীকে একত্রিত করে শক্তিশালী জনগোষ্ঠীগুলির পরাজয় ঘটান এবং সমগ্র কামরা রাজ্যের শাসনভার নিজের হাতে তুলে নেন। তিনি নিজের নাম বিশু মন্ডল থেকে পরিবর্তন করে বিশ্ব সিংহ করেন এবং নিজের নামের সাথে নারায়ণ যুক্ত করে,'বিশ্বনারায়ণ সিংহ' নাম নিয়ে বংশপরম্পরায় এই নারায়ণযুক্ত নাম নিয়ে রাজত্ব করতে থাকেন।

১৮৮৭ সালে 'কোচবংশের' রাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ লন্ডনের বাকিংহাম প্যালেসের আদলে কোচবিহারের রাজবাড়িটি তৈরি করান। ক্লাসিক্যাল ওয়েস্টার্ন শৈলীর ধাঁচে তৈরি এই বাড়িটি ৫১,৩০৯ বর্গফুট (৪,৭৬৬.৮ মিটার) এলাকাজুড়ে অবস্থান করছে। ৩৯৫ ফুট (১২০মিটার) দীর্ঘ ও ২৯৬ (৯০ মিটার) প্রশস্ত বাড়িটির উচ্চতা ৪ ফুট ৯ ইঞ্চি (১.৪৫ মিটার)।ভবনের কেন্দ্রে একটি সুসজ্জিত ১২৪ ফুট (৩৮মিটার) উঁচু ও রেনেসাঁ শৈলীতে নির্মিত দরবার হল রয়েছে। এছাড়া বাড়িতে রয়েছে ড্রেসিং রুম, শয়ন কক্ষ, বৈঠকখানা, গ্রন্থাগার, তোষাখানা, লেডিজ গ্যালারি ও ভেস্টিবিউল। বর্তমানে ঘরগুলিতে আসবাবপত্রর কিছুই নেই, কিন্তু তবুও রাজবাড়ির ঐতিহ্য বহন করে চলেছে এই ঘরগুলি। রাজবাড়িটি 'ভিক্টর জুবিলি প্যালেস' নামে খ্যাত।

কোচবিহার মানেই 'রাজতন্ত্র'। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ সিংহর হাত ধরে গড়ে উঠেছিল অবিভক্ত ভারতের প্রথম পরিকল্পিত শহর। এই শহর তৈরি করার জন্য ইউরোপ থেকে নামীদামি শহর পরিকল্পনাকারীদের আনা হয়েছিল। এখানকার ইতিহাস, স্থাপত্য, জনপদ সবকিছুর সঙ্গেই মানুষের আবেগ জড়িয়ে রয়েছে। বিশেষত, আসাম ও উত্তর-পূর্ব ভারতের।

আরও পড়ুন: রাজবাড়ির প্রতিটি ইটে জীবিত ইতিহাস, এখনও রোমাঞ্চের ঠিকানা ইটাচুনা

হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত কোচবিহার এক সময় ছিল ভারতের অন্যতম রাজ্য। এর রাজধানী ছিল 'বিহার ফোর্ট'। পূর্বে বৃহত্তর কামরূপ রাজ্যের অন্তর্গত ছিল বর্তমানের এই কোচবিহার জেলা। এখানে কোচবংশ প্রায় ৫০০ বছর রাজত্ব করেছে। ১৫৩০ সালে বিশ্বনারায়ণ সিংহ প্রতিষ্ঠা করেন এই রাজ্য, এবং তাঁর সুযোগ্য পুত্র নরনারায়ণ সিংহ এই রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটান। এরপর ১৭৭২ সালে ভুটানের রাজার সঙ্গে যুদ্ধের ফলে কোচবিহারের তৎকালীন রাজা ধৈর্যনারায়ণ ও ওয়ারেন হেস্টিংসের মধ্যে চুক্তি হয় এবং কোচবিহার ব্রিটিশদের 'করদ' রাজ্যে পরিণত হয়।এর ফলে কোচবিহারের অর্ধেক রাজস্ব ব্রিটিশদের করায়ত্ত হতে থাকে। ১৭৭৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির ফলে এই স্থানের নতুন নামকরণ হয় 'কোচবিহার' এবং এই স্থান 'কোচ' জাতির বাসস্থান হিসেবে পরিচিত লাভ করে। সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে রচিত 'শাহজাহাননামা' গ্রন্থে কোচবিহার নামটি উল্লেখ আছে। জয়পুরের বিখ্যাত মহারানি 'গায়ত্রী দেবী' এই কোচ রাজবংশের কন্যা। মহারানি গায়ত্রী দেবী বিখ্যাত হয়েছিলেন তাঁর রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও ভুবনমোহিনী সৌন্দর্যের জন্য।

Coochbehar

কোচবিহার রাজবাড়ির চমকে দেওয়া অন্দরমহল

পূর্ব ভারতের একটি বড় অংশজুড়ে ছিল কোচ রাজাদের শাসন। বাংলা এবং আসামে বিস্তৃত ছিল তাঁদের রাজ্য। কামরা রাজ্যে ১২৫৭ সাল নাগাদ শক্তিশালী হয়ে ওঠে 'কোচ বংশ'। প্রথম কোচ রাজা বিশ্বসিংহ এবং তাঁর ছেলে নরনারায়ণ সিংহ এবং সেনাপতি চিলারাই মিলে দখল করে নেন তখনকার কামরূপ রাজ্যের পশ্চিম অংশ এবং দক্ষিণ আসাম। নরনারায়ণের মৃত্যুর পর রাজবংশ নানা ভাগে ভাগ হয়ে যায়। একটি শাখা কোচবিহার শাসন করত এবং অপর শাখাটির অধীনে ছিল 'কোচ হাজো'। কোচ হাজো দখল করে নিয়েছিলেন অহম শাসকরা। এরপর স্বাধীন রাজ্য কোচবিহারের নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এরই মধ্যে মুঘল আগ্রাসন 'সমস্যা'-র সৃষ্টি করে। ওপরদিকে ভুটান ও তিব্বতি আক্রমণের আশঙ্কা দেখা দেয়। প্রতিনিয়ত তাদের সঙ্গে যুদ্ধ লেগেই থাকত। এরই মধ্যে ভুটানের একজন 'রাজ-প্রতিনিধি' জাঁকিয়ে বসেন দরবারে। উপায়ান্তর না দেখে কোচ রাজা ব্রিটিশ সরকারের সাহায্য প্রার্থনা করেন। শেষ পর্যন্ত 'ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি'-র হস্তক্ষেপে সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু পূর্বের স্বাধীন রাজ্যের মর্যাদা আর বজায় থাকে না, কারন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে হয় কোচ রাজাকে। ১৭৭০ সালে স্বাক্ষরিত হয় 'The Anglo-Cooch Behar Treaty (1770)'.

১৭৭০ সাল থেকে ১৯৪৭ (স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত) ব্রিটিশ-ভারতীয় সরকারের করদমিত্র হিসেবে কোচবিহার তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছিল। ব্রিটিশ সরকারের তত্ত্বাবধানে কোচবিহারে পাশ্চাত্য সভ্যতা ও শিক্ষার প্রসার ঘটেছিল। পাঁচটি মহকুমায় (তুফানগঞ্জ, কোচবিহার সদর, মেখলিগঞ্জ, মাথাভাঙ্গা ও দিনহাটা) ভাগ করে রাজনৈতিক চেতনা, সমাজব্যবস্থা, ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা, শাসক-শাসিত সুসম্পর্ক ইত্যাদি বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের থেকে অনেকাংশে ভিন্ন ছিল। কোচবিহারে নির্মিত বিভিন্ন দেবদেবীর মন্দির যেমন দেবী বাড়ি, মদনমোহন মন্দির, ব্রাহ্ম মন্দির, বাণেশ্বর মন্দির, জল্পেশ মন্দির, বড় মহাদেব মন্দির) দর্শনীয়। এখানে সাগরদিঘি, রাজমাতা দিঘি, বৈরাগী দিঘি ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে জেকিন্স স্কুল, সুনীতি অ্যাকাডেমি, ইন্দিরা দেবী স্কুল, নৃপেন্দ্রনারায়ণ বিদ্যালয় এছাড়া মহারাজা জিতেন্দ্রনারায়ণ হাসপাতাল, কোচবিহার বিমানবন্দর, নারায়ণী সেনা, চিলারায় বারাক, কোচবিহারের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রজাদের রাজভক্তির ধারাকে বহন করে চলেছে।

Coochbehar palace

কোচবিহারের বড়দেবী

ইতিহাসের পাতায় উঁকি দিয়ে যায় এখানকার ঐতিহ্যশালী পুজো। আজ থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগে, মহারাজা বিশ্বসিংহ তখন বালক। বাল্যবন্ধুদের সঙ্গে খেলার ছলে একটি ময়নাগাছকে দেবী দুর্গা বানিয়ে এই গাছের সামনে হাঁড়িকাঠে বাঁধা পাঁঠার মতো সাজিয়ে রাখা এক বন্ধুকে সামান্য একটি কুশ দিয়ে গলায় আঘাত করতেই ধড় ও মুণ্ড আলাদা হয়ে যায়।বালক বিশ্বসিংহ তখন সেই ময়নাগাছটির সামনে জোড়হাতে কেঁদে পড়েন। তৎক্ষণাৎ তিনি বন্ধুর প্রাণ ফিরে পান। এমনটাই কিংবদন্তি। পরবর্তীকালে বাল্যকালের কথা মনে রেখে তিনি ময়নাকাঠ দিয়ে দেবী দুর্গার প্রতিমা তৈরি করে পুজোর প্রচলন করেন। এখানে দেবী দুর্গা স্বয়ং 'শতরূপা'। এখানে তিনি 'বড়দেবী' নামে খ্যাত। তিনি এখানে রক্তবর্ণা। এখানে দেবী মাতার দু'পাশে তাঁর চার সন্তান থাকেন না। এখানে তাঁর দুই সখী জয়া ও বিজয়া থাকেন। বাহন হিসেবে সিংহের সঙ্গে বাঘও বিরাজমান। দেবীপক্ষের অনেক আগেই বড়দেবীর আরাধনা শুরু হয়। পুরাতন ঐতিহ্য অনুসারে শ্রাবণ মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে 'ডাঙ্গারাই' মন্দিরে আনা হয় ময়নাকাঠ। সেখানে ময়নাকাঠের মহাস্নান সমাপন করানোর পর একমাস ধরে নিয়মিত চলে বিশেষ পুজো। এরপর রাধাষ্টমী তিথিতে এই ময়নাকাঠটি আনা হয় বড়দেবী মাতার মন্দিরে। সেখানে পুনরায় মহাস্নান করিয়ে পুজোপাঠ হয়। ভিজে কাঠটিকে তিনদিন হাওয়া খাইয়ে তারপর বড় দেবীর প্রতিমা নির্মাণ করা হয়।

এই মূর্তি কখনও সিদ্ধিদাত্রী, কখনও বা দেবী চন্ডী আবার কখনও তিনি একান্তরূপে ঘরের মেয়ে। কথিত আছে, সিংহাসনের লোভে মহারাজা নরনারায়ণের ভাই চিলারায়, (তিনি ছিলেন রাজার সেনাপ্রধান) রাজাকে হত্যার উদ্দেশ্য নিয়ে তাঁর শয়ন কক্ষে প্রবেশ করেন। কিন্তু তিনি হতবাক হয়ে দেখেন রাজাকে স্বয়ং রক্ষা করছেন মহামায়া। তিনি পরবর্তীতে পুনরায় হত্যার উদ‍্যোগ নেন এবং একই দৃশ্য দেখেন। কান্নায় ভেঙে পড়ে দাদার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন চিলারায়।মহারাজ বলেন, তুমি সৌভাগ্যবান, মায়ের দর্শন পেয়েছ। আমি এমন সৌভাগ্যের অধিকারী নই। সেই রাত্রেই বড়দেবী রক্তবর্ণারূপে মহারাজাকে দর্শন দেন।আগে নরবলি প্রথা চালু ছিল। মহাষ্টমীতে মহিষ বলি প্রথা এখনও চালু আছে। এখানে সন্ধিপুজা সাধারণের দেখা নিষিদ্ধ, কারন অষ্টমী ও নবমীর মহা-সন্ধিক্ষণে হয় বিশেষ 'গুপ্ত পুজো'। 'কামনসাইট' উপাধিধারী এক বিশেষ পরিবারের সকল পুরুষ সদস্য নিজেদের আঙুল কেটে রক্ত দেন। পুজোশেষে দশমীর দিনে কুড়ুল দিয়ে প্রতিমা টুকরো টুকরো করে কেটে যমুনাদিঘির জলে বিসর্জন দেওয়া হয়।

কোচবিহারের রাজবাড়ির ঐতিহ্য, বৈশিষ্ট্য, ইতিহাস আজও হাতছানি দেয়।

 

More Articles