চুলে ফুলের মালা, পরনে সুইম স্যুট, কেমন ছিলেন সেকালের 'মিস ইন্ডিয়া'?
সাতের দশকে তিনি নিউ ইয়র্কে চলে যান এবং পরবর্তী সময়ে তিনি আমেরিকার বিখ্যাত ‘জুলিয়ড স্কুল’-এ নাচ শেখান।
২০২১ সালে ১০ বছর পর ভারতকে ‘মিস ইউনিভার্স’-এর মুকুট এনে দিয়েছিল পঞ্জাবের মেয়ে হরনাজ সিন্ধু। এর আগে এই খেতাব জিতেছিলেন সুস্মিতা সেন এবং লারা দত্ত। এদের কথা হয়তো কমবেশি আমাদের সকলেরই জানা, কিন্তু আমরা হয়তো অনেকেই জানি না, ভারত থেকে কে সর্বপ্রথম এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। আজ জানাব সেই ইন্দ্রাণী রহমানের কথাই।
‘মিস ইউনিভার্স’ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল আজ থেকে ৬৭ বছর আগে, ১৯৫২ সালে। সেই বছরই ইন্দ্রাণী রহমান ‘মিস ইন্ডিয়া’-র খেতাব জিতে পাড়ি দিয়েছিলেন ক্যালিফোর্নিয়ায়, কারণ সেখানেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রথম ‘মিস ইউনিভার্স’ প্রতিযোগিতা। যদিও এই প্রতিযোগিতায় ইন্দ্রাণী জয়লাভ করতে পারেননি, কিন্তু গোটা বিশ্বের দরবারে তিনি ভারতকে সেদিন যে মর্যাদা লাভ করাতে সক্ষম হয়েছিলেন, তা কোনও খেতাবের থেকে কম নয়।
মাত্র ২২ বছর বয়সে এক সন্তানের মা হয়েও, তিনি সেদিন ভারতীয় সমাজের চোখরাঙানির তোয়াক্কা না করে অংশগ্রহণ করেছিলেন এই প্রতিযোগিতায়। পরণে সুইম স্যুট ও চুলের খোঁপায় সাদা ফুলের মালা আর কপালে বড় টিপ– সেদিনকার তাঁর এই রূপে, তিনি যেন প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যকে মিলিয়ে মিশিয়ে এক করে দিয়েছিলেন। বিশ্বের তামাম সুন্দরীদের ভিড়েও ভারতীয় সভ্যতা এবং রীতিনীতি সেদিন সবার নজর কেড়েছিল।
আরও পড়ুন: সচিন-কন্যাকে ভালবাসেন, দাবি করেছিলেন বাংলার যুবক || সারা তেণ্ডুলকরের জীবন কতটা রঙিন?
রক্তেই ছিল পাশ্চাত্য এবং প্রাচ্যের সংমিশ্রণ
ইন্দ্রাণী রহমানের জীবনে তাঁর সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণাকারী ছিলেন তাঁর মা রাগিণী দেবী, যিনি ছিলেন তৎকালীন সময়ের একজন বিখ্যাত শাস্ত্রীয় নৃত্যশিল্পী। ইন্দ্রাণীর বাবা রামলাল বাজপেয়ী পেশায় ছিলেন একজন ইঞ্জিনিয়ার। পড়াশোনার সূত্রে তিনি আমেরিকায় গেলে সেখানে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় এক বিদেশিনীর। সেই বিদেশিনীর নাম ছিল এস্টার শেরমান। ১৯২০ সালে তাঁরা বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হন এবং কিছুকাল পরে, ১৯২০ সালে তাঁরা পুনরায় দেশে ফিরে আসেন। এস্টার শেরমান ভারতে ফিরে হিন্দু ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে হিন্দুধর্ম গ্রহণ করেন এবং তখন থেকেই তিনি রাগিণী দেবী নামে পরিচিতি লাভ করতে থাকেন। ক্রমেই রাগিণী দেবীর নৃত্যের প্রতি ঝোঁক এবং ভালবাসা তাঁকে ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নৃত্যশিল্পীতে পরিণত করে। অন্যদিকে রামলাল, লালা লাজপত রায়ের পত্রিকা ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’-য় সহ সম্পাদক হিসাবে কাজ করতে থাকেন। রাগিণী দেবী মাদ্রাজের গৌরী আম্মার থেকে ভারতনাট্যম শেখেন। তিনি ছিলেন প্রথম আমেরিকান মহিলা, যিনি ভারতের কথাকলি নৃত্য সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে কেরালার ‘কলামন্ডলম’-এ পা রেখেছিলেন। তিনের দশকে এই রাগিণী দেবীর হাত ধরেই ভারতের শাস্ত্রীয় নৃত্য ক্রমে বিশ্বের দরবারে, বিশেষত আমেরিকা এবং ইউরোপে স্থান পেতে থাকে। নৃত্যের প্রতি মায়ের এই গভীর অনুরাগ যে মেয়ের হৃদয়ও স্পর্শ করবে– একথা বলার অবকাশ রাখে না।
১৯৩০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর জন্মলাভ করেন ইন্দ্রাণী রহমান। শৈশব থেকেই নৃত্যের প্রতি গভীর অনুরাগ তাঁরও ছিল। ছোট্ট ইন্দ্রাণী ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে, কখনও দর্শকের আসনে আবার কখনও বা স্টেজের উইংসে বসেই মায়ের অনুষ্ঠান মগ্ন হয়ে দেখতেন।
শিল্পী জীবন
ইন্দ্রাণী রহমানের নৃত্যজীবনের হাতেখড়ি হয় তাঁর মা রাগিণী দেবীর কাছেই। ছোট থেকেই তিনি এক সাংস্কৃতিক পরিবেশে বড় হয়ে উঠেছিলেন। মাত্র ৯ বছর বয়সে ইন্দ্রাণী দেবী যে জীবনে পা রেখেছিলেন, সেই নৃত্যই তাঁর সমস্ত জীবনের প্রধান উপজীব্য ছিল। ছোট থেকেই তিনি আমেরিকা এবং ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় মায়ের সঙ্গে ভ্রমণের সুযোগ পান এবং অতি অল্প বয়সেই মায়ের সঙ্গে তিনি নৃত্যের মাধ্যমে অপার বিশ্ববাসীর মন জয় করতে থাকেন। ওই বয়সেই চার-চারটি ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। চারের দশকে তিনি গুরু চোক্কালিঙ্গম পিল্লাই-এর কাছে ভরতনাট্যমের পান্ডনাল্লুর ভাগের শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। ভরতনাট্যমের শিক্ষা সম্পূর্ণ হওয়ার পর তিনি বিজয়ওয়াড়ার কোরাদা নরসিংহ রাওয়ের কাছে ভারতীয় নৃত্যের অন্যতম শাখা, কুচিপুড়ি নৃত্যের পাঠ গ্রহণ করেন। পরবর্তী সময় তিনি এই গুরুর সঙ্গেই নৃত্যের সুবাদে পৃথিবীর নানা স্থানে ভ্রমণ করেন।
ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যে পারদর্শিতার কারণেই তিনি ১৯৪৭ সালে, তৎকালীন ভারতের বিখ্যাত শিল্পী এবং সমালোচক ড. চার্লস ফ্যাব্রির নজরে আসেন। ড. চার্লস ইন্দ্রাণী রহমানকে ভারতীয় শাস্ত্রের অন্য একটি শাখা, ওড়িশি নৃত্যের সঙ্গে পরিচিতি লাভ করান এবং তাঁর অনুপ্ররণাতেই ইন্দ্রাণী দেবী পরবর্তী সময়ে, উড়িষ্যায় গুরু শ্রীদেবদাসের কাছে তিন বছর অক্লান্ত চর্চার মাধ্যমে একজন অতি দক্ষ একজন ওড়িশি নৃত্যশিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁর হাত ধরেই স্বল্প-পরিচিত ওড়িশি নৃত্য বিশ্ববাসীর নজরে আসে। ১৯৬১ সালে তিনি ছিলেন প্রথম নৃত্যশিল্পী, যিনি এশিয়া সোসাইটির দ্বারা আয়োজিত জাতীয় সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই সম্মেলনে তিনি তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি জন এফ. কেনেডি এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সম্মুখে তাঁর নৃত্য পরিবেশনের সুযোগ পান।
ইন্দ্রাণীর কন্যা সুকন্যা রহমান ‘ডান্সিং ইন দ্যা ফ্যামিলি: দ্যা এক্সট্রাঅর্ডিনারি স্টোরি অব ইন্ডিয়ান ক্ল্যাসিক্যাল ডান্স’ বইতে লিখেছেন, ‘মিস ইউনিভার্স’ প্রতিযোগিতায় অসাধারণ কৃতিত্ব রাখার পর, বলিউড এবং নানা ইন্টারভিউ থেকে ইন্দ্রাণী রাহমানের কাছে অসংখ্য আবেদনপত্র আসলেও, তিনি কেবল নৃত্যের প্রতি ভালবাসার কারণেই সেইসব আবেদনপত্রগুলো ডাস্টবিনে ফেলে দিতেন।
ব্যক্তিগত জীবন
মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে সুপরিচিত আর্কিটেক্ট হাবিব রহমানের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হন। বয়সে দ্বিগুণ হাবিবের সঙ্গে তাঁর দাম্পত্য জীবন বেশ সুখময়ই ছিল। এরপর তিনি এক পুত্র এবং কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। কিন্তু সাংসারিক জীবন কখনওই ইন্দ্রাণীর জীবনের অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বিয়ে এবং সন্তান জন্ম দেওয়ার পরেই তিনি ‘মিস ইন্ডিয়া’ কিংবা ‘মিস ইউনিভার্স’-এর মতো প্রতিযোগিতাগুলিতে স্বতস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
শেষ জীবন
সাতের দশকে তিনি নিউ ইয়র্কে চলে যান এবং পরবর্তী সময়ে তিনি আমেরিকার বিখ্যাত ‘জুলিয়ড স্কুল’-এ নাচ শেখান। এছাড়াও আমেরিকার হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়-সহ অন্যান্য অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃত্য শিক্ষা দিতে থাকেন। ১৯৯৯ সালে, মাত্র ৬৮ বছর বয়সে তিনি পরলোকগমন করেন। তিনি শুধুমাত্র একজন নৃত্যশিল্পী কিংবা সৌন্দর্যের প্রতীক ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন আধুনিক ভারতের পথিকৃৎ।