একসঙ্গে চার দেশের গুপ্তচর! নেতাজিকে বর্ডার পার করানো এই 'স্পাই' ছিলেন বাস্তবের জেমস বন্ড

Spy Bhagat Ram Talwar: অনেকের মতে, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে আসলে ঠকিয়েছিলেন ভগতরাম।

২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪১। কাবুলের এঁদো, ঘিঞ্জি গলি পেরিয়ে এক ব্যক্তি এগিয়ে চলেছেন নিজের গন্তব্যে। ভিড় ঠেলে কিছুক্ষণ পর তিনি এসে দাঁড়ালেন ইতালিয়ান এম্বাসির বাইরে। দরজায় পাহারারত প্রহরীরা তাঁকে আসার কারণ জিজ্ঞেস করায় ব্যক্তিটি জানালেন, তাঁকে পাঠানো হয়েছে জার্মান এম্বাসি থেকে এবং তিনি আসার কারণ শুধুমাত্র বলবেন ইতালির এম্বাসেডরকেই। যথারীতি জার্মান এম্বাসিতে ফোন করা হলো। সেখান থেকে সবুজ সংকেত পাওয়ার পর ঢুকতে দেওয়া হয় ওই ব্যক্তিকে। ইতালির রাজদূত পেট্রো কারোনির কাছে ওই ব্যক্তি নিজের পরিচয় দেন রহমত খান নামে। রহমত খান এসেই সাফ জানিয়ে দেন তিনি আদৌ কাবুলিওয়ালা নন, বরং একজন ভারতীয়। তিনি ইতালির এম্বাসিতে এসেছেন ছদ্মবেশে। এবার চমকানোর পালা কারোনির। রহমত জানান, তিনি পেশোয়ার থেকে কাবুল পর্যন্ত পায়ে হেঁটে এসেছেন এবং তাঁর সঙ্গে আরও একজন ভারতীয় এসেছেন। সেই ভারতীয়কে কাবুল বর্ডার পার করিয়ে দিতে হবে। সঙ্গী ভারতীয়টি আর কেউ নন, স্বয়ং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। জার্মান এম্বাসি থেকে রহমত খান এবং নেতাজিকে জানানো হয়েছিল ইতালিয় এম্বাসি তাঁদের কাবুল বর্ডার পার করতে সাহায্য করবে। নেতাজি কলকাতার বাড়ি থেকে ব্রিটিশদের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই পাসপোর্ট নেই। সুতরাং ইতালির এম্বাসির সাহায্য ছাড়া কাবুল বর্ডার পার করে মস্কো যাওয়া অসম্ভব। সমস্যার গুরুত্ব বুঝে সাহায্য করতে রাজি হয়ে যান কারোনি। কারোনির সাহায্যেই নেতাজির নকল পাসপোর্ট তৈরি হয় এবং তিনি কাবুল বর্ডার পেরিয়ে মস্কোর ট্রেনে চেপে বসেন। এরপর কী হয়েছিল তা আমরা ইতিহাস বইতে কমবেশি সকলেই পড়েছি। নেতাজি তো ট্রেন ধরে মস্কো চলে গেলেন, কিন্তু স্টেশনে দাঁড়িয়ে রইলেন রহমত খান। নেতাজি হয়তো জানতেনও না যে ওই ব্যক্তির আসল নাম রহমত খান নয়ই, তিনি কোনও সাধারণ মানুষও নন। আসলে কে ছিলেন এই রহমত খান? কীই বা তাঁর আসল পরিচয়?

১৯৩১ সালে পঞ্জাবের এক বিপ্লবী হরিকিষণ তলোয়ার, পঞ্জাবের তৎকালীন গভর্নরকে হত্যা করতে গিয়ে ধরা পড়েছিলেন। বিচারে ফাঁসির সাজা হয় তাঁর। তাঁর সঙ্গী ছিল এক কিশোর। ১৯৩১ সালের ৯ জুন হরিকিষণকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় কিশোরটিকে। এই কিশোর আসলে ছিল হরিকিষণের ভাই ভগতরাম তলোয়ার। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলেও ১৯৪০ সালে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে যান ভগতরাম। জেল থেকে ছাড়া পেয়েই একটি বামপন্থী রাজনৈতিক দল, কীর্তি কিষাণ পার্টির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ভগতের প্রথম রাজনৈতিক মিশন ছিল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে কাবুল বর্ডার পার করিয়ে মস্কো পৌঁছনোয় সাহায্য করা। এই মিশনের সুবাদে ভগতরাম নিজের নাম পাল্টে রহমত খান করে নেন এবং নেতাজিকে মস্কো পৌঁছতে সাহায্য করেন।

ভগতরাম তলোয়ার

এই মিশন চলাকালীন ভগতের পরিচয় হয় পেট্রো কারোনির সঙ্গে। কীভাবে হয়েছিল সেই প্রসঙ্গে আপনাদের আগেই বলেছি। কারোনি ভগতের সাহস এবং বুদ্ধি দেখে বেশ প্রসন্ন হয়েছিলেন। তিনি এমন কারও খোঁজেই ছিলেন যিনি ভারতের মাটিতে বসে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি করতে পারবেন। যথারীতি তিনি ভগতকে গুপ্তচর হওয়ার জন্য রাজি করিয়ে নেন। এই ভাবেই ধীরে ধীরে একজন গুপ্তচর হয়ে ওঠেন ভগতরাম তলোয়ার। কয়েক মাস আফগানিস্তানে ইতালিয়দের জন্য কাজ করার পর ভগতকে পাঠানো হয় জার্মানি। সেখানে জার্মানদের থেকে গুপ্তচরবৃত্তির প্রশিক্ষণ নেন তিনি। এই যুবকের দুর্দান্ত বুদ্ধি এবং অপরিসীম সাহস দেখে মুগ্ধ হয় নাৎসিরাও। ফলস্বরূপ ভগতকে দেওয়া হয় নাৎসি বাহিনীর সবচেয়ে বড় সামরিক পদক, দ্য আয়রন ক্রস। শোনা যায় ভগত রাম তলোয়ারকে আজকের হিসেবে নগদ ২৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল নাৎসিদের তরফ থেকে। জার্মানিতে অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়ে আবার কাবুল ফিরে আসেন ভগত। ফিরে আসার সময় তাঁকে দেওয়া হয় একটি ট্রান্সমিটর, যার মাধ্যমে ভগত নাৎসিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। হিটলার এবং নাৎসিরা মনে করেছিল ভগতের দৌলতে ব্রিটেন এবং মিত্রশক্তির সব রকম গোপন খবর তারা জানতে পারছে। এটিই ছিল নাৎসিদের বিশাল বড় ভুল।

হিটলারের সঙ্গে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এমন অনেক গুপ্তচর ছিলেন যারা একই সঙ্গে দু'টি দেশের জন্য কাজ করতেন। এদের বলা হতো ডবল এজেন্ট। ভগত ছিলেন এরকমই একজন ডবল এজেন্ট। অবশ্য ডবল এজেন্ট বলা কতটা সঠিক তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কেননা ভগত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় একসঙ্গে চারটি দেশের হয়ে কাজ করেছিলেন। নাৎসিদের কাছে যে তথ্য পৌঁছচ্ছিল তা ছিল আদ্যোপান্ত মনগড়া। দিল্লির ভাইসরয় ভবনের (বর্তমানে রাষ্ট্রপতি ভবন) নির্দেশে মিত্রশক্তি সম্পর্কে ভুয়ো খবর পাঠাতেন তিনি। আগেই বলেছি, জেল থেকে ছাড়া পেয়ে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন ভগত। তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণ ভালোভাবে নেননি তিনি। ফলত জার্মানদের ছেড়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের হয়ে কাজ শুরু করেন ভগত। সোভিয়েতের সঙ্গে কাজ করাকালীন ভগতের আলাপ হয় ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স অফিসারদের সঙ্গে। ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স অফিসার পিটার ফ্লেমিং এবং তাঁর ভাই ইয়ান ফ্লেমিংয়ের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে ভগতের। পিটার ফ্লেমিংই তাঁকে দিয়েছিলেন তাঁর কোড নেম ‘সিলভার’। সমস্ত মিত্রশক্তির কাছে ভগত রাম তলোয়ার পরিচিত ছিলেন এজেন্ট সিলভার নামে এবং অক্ষশক্তির কাছে পরিচিত ছিলেন রহমত খান নামে।

পিটার ফ্লেমিং

তবে হিটলার অচিরেই বুঝতে পারেন যে ভগতরামের উপর বিশ্বাস করে তিনি ভুল করেছেন। আফগানিস্তানের সামরিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি এলাকা ছিল ওয়াজিরেস্তান। ১৯৪১ সালের ডিসেম্বর মাসে জানা যায়, সেখানে একটি বড়সড় বিদ্রোহ হতে চলেছে স্থানীয় আফগান সর্দারদের নেতৃত্বে। আসলে এই বিদ্রোহের জন্য আফগান সর্দারদের অস্ত্র এবং অর্থ যোগাচ্ছিল নাৎসিরা। যথারীতি ভগতরামের উপর দায়িত্ব বর্তায় ওয়াজিরেস্তানে বিদ্রোহকে সফল করার। নাৎসিদের উদ্দেশ্য ছিল ওয়াজিরেস্তানে বিদ্রোহ করিয়ে ব্রিটিশদের নজর বিশ্বযুদ্ধের থেকে ঘুরিয়ে দেওয়া। কিন্তু ভগতরাম তলোয়ার সুচারুরূপে নাৎসিদের ভুল তথ্য দিয়ে এবং নাৎসিদের গোপন তথ্য ব্রিটিশদের দিয়ে সেই প্ল্যান ভেস্তে দেন। হিটলার বুঝতে পেরে যান দলের আসল বিভীষণ কে। যথারীতি আফগানিস্তান ছেড়ে পালান ভগতরাম। শোনা যায়, নাৎসি এবং ব্রিটিশদের থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়ে ইংল্যান্ডে ফ্লেমিং পরিবারের কাছে আশ্রয় নেন ভগত। আগেই বলেছি ফ্লেমিং পরিবারের সঙ্গে ভগতের সুসম্পর্কের কথা। এরপর ১৯৪৫ সালে যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। একইসঙ্গে শেষ হয়ে যায় এজেন্ট সিলভার এবং রহমত খান, শুধু পড়ে থাকেন ভগতরাম তলোয়ার। ১৯৪৭ সালে ভারতে ফিরেছিলেন ভগতরাম তলোয়ার। দেশভাগের পর আজকের উত্তরপ্রদেশে এসে থিতু হন ভগত।

ইয়ান ফ্লেমিং

আমরা প্রত্যেকেই জেমস বন্ডের নাম শুনেছি, সিনেমা দেখেছি। অত্যাধুনিক গাড়ি, দুর্ধর্ষ সব বন্দুক, সুন্দরী মহিলাদের সঙ্গে প্রেম এবং ভদকা মার্টিনির জন্য বিখ্যাত এই গুপ্তচর চরিত্রের নির্মাতা কে ছিলেন জানেন? পিটার ফ্লেমিংয়ের ভাই ইয়ান ফ্লেমিং। মনে করা হয়, ভগতরাম তলোয়ার এবং পিটার ফ্লেমিংয়ের বিভিন্ন কার্যকলাপের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই জেমস বন্ড চরিত্রটি নির্মাণ করেছিলেন ইয়ান ফ্লেমিং। তবে অনেকের মতে, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে আসলে ঠকিয়েছিলেন ভগতরাম। কেননা নেতাজি তো তাঁর আসল পরিচয় জানতেন না। তিনি জার্মানিতে বসে ভগতের পাঠানো ভুল খবরই শুনছিলেন। ১৯৭৩ সালে কলকাতায় নেতাজি সংক্রান্ত একটি সেমিনারে এসে নিজের সাফাই দেন ভগত। ভগতরাম তলোয়ার নিজের বক্তব্যে বলেন, “নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মতো অমন ব্যক্তিত্ববান মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। তাঁর প্রতি আমার অসীম শ্রদ্ধা রয়েছে। কিন্তু আমি কোনও মূল্যেই নাৎসিদের জিততে দিতে পারতাম না।” এই সেমিনারেই ভগতরাম নিজের লেখা একটি পেপার প্রকাশ করেন যার শীর্ষক ছিল ‘My 50 Days with Netaji’। পরবর্তীকালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে নিয়ে ‘Swords of Pathanland and Great Escape of Netaji’ নামে একটি বইও লিখেছিলেন ভগতরাম। ১৯৮৩ সালে প্রয়াত হন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই প্রবাদপ্রতিম গুপ্তচর। 

More Articles