সাহিত্যে উপেক্ষিত, পৃথিবীর প্রথম মহিলা গোয়েন্দার গল্প চমকে দেবে আপনাকেও

পৃথিবীর সমগ্র সাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতে এখনও পর্যন্ত যে সমস্ত গোয়েন্দাকাহিনি লেখা হয়েছে, তা সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে, সেখানে বেশ কয়েক ধরনের বিভাজন বিদ্যমান। কেউ যেমন অপরাধীকে শায়েস্তা করেছে তার মগজাস্ত্রের সাহায্যে, কেউ আবার সাহায্য নিয়েছে শারীরিক শক্তির। আবার কেউ অপরাধীকে জালে তুলতে সাহায্য নিয়েছে শরীরের, অর্থাৎ, এক্ষেত্রে অপরাধের বিরুদ্ধে অন্যতম অস্ত্র হয়ে উঠেছে যৌনতা। ঠিক একইভাবে আমরা যদি সমগ্র গোয়েন্দাজগৎকে পুরুষ এবং মহিলা- এই দু'টি ভাগে বিভক্ত করি তবে দেখা যাবে, দুই ক্ষেত্রেই বেশ কিছু মিল এবং অমিল বর্তমান। একই সঙ্গে যে কোনও গোয়েন্দাকাহিনি পড়তে পড়তে এই প্রশ্নও আমাদের মনে জেগে ওঠা খুব স্বাভাবিক যে, পুরুষ গোয়েন্দার তুলনায় মহিলা গোয়েন্দারা কম জনপ্রিয় কেন? এ কি দিনের শেষে আমাদের পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার উৎকট প্রকাশ নাকি পুরুষ গোয়েন্দাদের অবলম্বন করে যে সমস্ত কাহিনি রচিত হয়, তার তুলনায় মহিলা গোয়েন্দাকাহিনির বুনট বা চরিত্রায়নের ক্ষেত্রে সত্যিই থেকে গেছে কোন বড় ধরনের ফাঁক? বাংলা সাহিত্যে কি এখনও কোন আদর্শ মহিলা গোয়েন্দা তৈরি হয়নি? তাই যদি হয়, তবে আদর্শ মহিলা গোয়েন্দার সংজ্ঞাই বা কী? এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতেই আমাদের ফিরে যেতে হবে গোয়েন্দাকাহিনির শেকড়ে। সেখানেই লুকিয়ে আছে এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর।

ঠিক কবে গোয়েন্দাকাহিনি উঠে এল সাহিত্যের পাতায়?এ-সম্পর্কে নানা মতভেদ রয়েছে। ঊনবিংশ শতকের ঊষালগ্নে গোয়েন্দাকাহিনির জন্ম বলে অধিকাংশ সমালোচক মনে করেন। তবে সুকুমার সেন তাঁর ‘ক্রাইম কাহিনীর কালক্রান্তি’ বইটিতে দাবি করেছেন হাজার হাজার বছর পূর্বেও অস্বিত্ব ছিল গোয়েন্দাকাহিনির। উদাহরণস্বরূপ তিনি ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’-এর ড্যানিয়েলের ঘটনার উল্লেখ করেছেন। গোয়েন্দাকাহিনির শেকড় খুঁজতে গিয়ে সুকুমার সেন তাঁর বইতে লিখছেন,

ক্রাইম কাহিনী অর্থাৎ ডিটেকটিভ গল্প-উপন্যাস আধুনিক কালে, ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে সৃষ্টি, সে ধারণা বোধকরি অনেকেরই আছে। এ ধারণা যথার্থ বলব যদি সে গল্পকাহিনি পুলিশি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পরে রচিত হয়ে থাকে, নইলে নয়।

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা চলে, অপরাধীদের ঢিট করার জন্য পুলিশি ব্যবস্থার প্রয়োগ প্রথম হয় ১৮৪২ সাল নাগাদ। সেই বছরই প্রতিষ্ঠিত হয় স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড, যার কর্মদক্ষতা আজকের দিনে দাঁড়িয়েও বিশ্ববন্দিত। এর ঠিক এক বছর পরে ‘গোয়েন্দা’ বা ‘ডিটেকটিভ’ কথাটি স্থান পায় অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে। তার মানে কি তার আগে গোয়েন্দা গল্প বা উপন্যাস রচিত হয়নি? একথা ভাবলে কিন্তু সম্পূর্ণ ভুল ভাবা হবে। সালটা ১৭৪৭, দার্শনিক ভলতেয়ার ‘জাদিগ উ লা ডেস্টিনি’ নামক একটি বই রচনা করেন, যেখানে কোনও আদর্শ গোয়েন্দাকাহিনির সন্ধান না মিললেও গল্পটিতে অনুসন্ধান এবং সাধারণ মানুষের তুলনায় ভিন্ন দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণের উদাহরণ মেলে। সুতরাং, এ-সম্পর্কে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই যে, পুলিশি ব্যবস্থা প্রয়োগের বহু পূর্বেই গোয়েন্দাকাহিনির বীজ বপন হয়েছিল।

আরও পড়ুন: কেন বারবার ব্যোমকেশই জিতে যায়? ফেলুদা-কিরীটির থেকে কোথায় এগিয়ে সে!

গোয়েন্দাকাহিনি সত্যি সাহিত্য-পদবাচ্য কি না, প্রশ্নটি বর্তমান সময়ের নিরিখে কিছুটা হলেও বোধহয় অপ্রাসঙ্গিক। তবে একথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বহু সাহিত্য সমালোচক হয়ে পড়েছেন দ্বিধাবিভক্ত। লেখিকা সায়ন্তনী পুততুণ্ড একবার তাঁর একটি সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে বলেছিলেন গোয়েন্দাকাহিনি সাহিত্য হলেও সাহিত্যের এই ধারাটি যেন ঠিক সেই অর্থে জাতে ওঠেনি এখনও। অবশ্য শুধু সায়ন্তনী পুততুণ্ড নয়, এই বিতর্ক চলছে বহুদিন আগে থেকেই। এ-প্রসঙ্গে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের উক্তিটি উল্লেখের দাবি রাখে। ‘ব্যোমকেশের ডায়েরী' নামক বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৩৩ সালে। বইটিতে শরদিন্দুবাবু বলছেন,

ডিটেকটিভ গল্প সম্বন্ধে অনেকের মনে একটা অবজ্ঞার ভাব আছে- যেন উহা অন্ত্যজ শ্রেণির সাহিত্য। আমি তাহা মনে করি না। Edgar Allan Poe, Conan Doyel, G.K Chesterton যাহা লিখিতে পারেন, তাহা লিখিতে আমার লজ্জা নাই।

শরদিন্দুবাবুর এই উক্তি থেকেই ধারণা করা যায়, গোয়েন্দাকাহিনি আদপেই সাহিত্য কি না, এ বিতর্কে দাঁড়ি টানতে আসরে নামতে হয়েছিল ব্যোমকেশের স্রষ্টাকেও। একথা সঠিক, গোয়েন্দাকাহিনির শিকড় প্রোথিত ইতিহাসের অনেক গভীরে। আগেই বলা হয়েছে, গোয়েন্দাকাহিনির উল্লেখ মেলে ঋকবেদেও। সুতরাং, গোয়েন্দাকাহিনির প্রাচীনত্ব নিয়ে কোনও সংশয় নেই। তারপরেও গোয়েন্দাকাহিনি সাহিত্য কি না এই প্রশ্ন উঠছে কেন? বস্তুতপক্ষে গোয়েন্দাকাহিনিগুলিকে বিচার-বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, গোয়েন্দাকাহিনি প্রকৃত অর্থে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে গোয়েন্দা সিরিজগুলির মাধ্যমে। উদাহরণস্বরূপ বলা চলে, ফেলুদা বা ব্যোমকেশের কথা। ছোটগল্প কিন্তু কখনওই সেই অর্থে গোয়েন্দাকাহিনিকে মাইলেজ দিতে পারেনি। প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় থেকে স্বর্ণকুমারী দেবী- গোয়েন্দাকাহিনিকে সেভাবে জাতে তুলতে পারেননি কেউই।

নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত গোয়েন্দাকাহিনিগুলি ছিল শুধুমাত্র অবসর বিনোদন উদযাপনের মাধ্যম। পরবর্তী সময় ব্যোমকেশ এবং ফেলুদা- এই দুই তরুণ তুর্কি এক লহমায় পাল্টে ফেললেন সমগ্র পরিস্থিতি। ব্যোমকেশের কাহিনিগুলির মধ্যে শুধু নিছক অপরাধের তদন্ত অথবা অপরাধীর শাস্তিবিধান নয়, তার সঙ্গে স্থান পেল ব্যোমকেশ ও সত্যবতীর প্রেমের রসায়ন, সঙ্গে শরদিন্দুর কলমে উঠে এল সম্পর্কের টানাপোড়েন, যৌনতা, মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণ, আবার একইসঙ্গে হাস্যরস। ফলে ব্যোমকেশের একের পর এক উপন্যাস, যাকে বলে এককথায়, হিট। তার সঙ্গেই ব্যোমকেশের অন্যতম বড় অস্ত্র ছিল তার বাঙালিয়ানা। এই অস্ত্রেই মাত আট থেকে আশির পাঠক-পাঠিকারা। বস্তুতপক্ষে শরদিন্দুর মতো অন্য কোনও লেখক-লেখিকা পুরোপুরি বাঙালিয়ানার মোড়কে তাঁদের সৃষ্ট গোয়েন্দা চরিত্রগুলিকে এর আগে পাঠকের সামনে হাজির করেননি কোনওদিন। আবার আমরা ফেলুদার গল্পের দিকে তাকালে বুঝতে পারি, শারীরিক বলের তুলনায় সত্যজিৎ তাঁর প্রত্যেকটি কাহিনীতে মগজাস্ত্রের প্রয়োগকে বেশি গুরুত্ত্ব দিয়েছেন। হ্যাঁ, শরদিন্দুর ব্যোমকেশের মতোই সত্যজিতের ফেলুদাতেও হাস্যরস বা সর্বক্ষণ টানটান উত্তেজনার মধ্যেও কমিক রিলিফের অভাব হয়নি এক মুহূর্তের জন্যও। সৌজন্যে লালমোহন গাঙ্গুলি ওরফে জটায়ু, যার ভুল ইংরেজি অথবা তাঁর প্রকাশিত বইয়ে ভুল তথ্য শিশু-কিশোরদের সঙ্গ দিয়ে গেছে আজীবন। সুতরাং, এর থেকেই বোঝা যায় শরদিন্দু এবং ফেলুদা ছিল রহস্য-রোমাঞ্চ, প্রেম, যৌনতা, মনস্তত্বের জটিল সমীকরণে ঠাসা গোয়েন্দাকাহিনি।

শরদিন্দুবাবু একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন,

 

রহস্য রোমাঞ্চ গল্প নিশ্চয়ই সাহিত্যে স্থান পেতে পারে। কারণ এখানেও মনুষ্যচরিত্র এবং মানবীয় ধর্ম নিয়ে রচনা। শুধু একটু রহস্য থাকে বলেই কেন নিম্নশ্রেণীর হবে? নোবেল পুরস্কার পাওয়া কোন কোন লেখকও এই জাতের লেখা লিখেছেন। ভাষা হচ্ছে গল্পের বাহন। সেই বাহন যদি ভাল না হয় তাহলে গল্পও ভালভাবে বলা যায় না। হোক না গোয়েন্দা গল্প, তবু সেটা গল্প তো! সুতরাং মনোজ্ঞ করে বলা চাই।

এ প্রসঙ্গে বলা চলে শরদিন্দু বা সত্যজিতের মতো গুটিকয়েক লেখক-লেখিকা নন, নারায়ণ সান্যাল, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ বসু, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, প্রেমেন্দ্র মিত্র-সহ আরও অনেক প্রথম সারির লেখক-লেখিকা গোয়েন্দা গল্পকে তাঁদের সাহিত্যের অন্যতম মূল উপজীব্য করে তুলেছিলেন। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবে তাঁদের ভাষা সম্পর্কে কোনও সংশয় থাকার কথা না। এই কারণে গোয়েন্দাকাহিনি সাহিত্য পদবাচ্য নয় এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল।

সালটা ১৮৫৬। ভারতের নিরিখে সময়টা উত্তাল। ভারতের আকাশে বারুদের গন্ধ তখনও টাটকা। স্বাধীনতার যুদ্ধ ভারতের বুকে তখন পুরোদমে বর্তমান, সিপাহি বিদ্রোহের সলতে পাকানোর কাজও সেই সময় শুরু হয়েছে ভারতের মাটিতে। অন্য একটি দিকেও ১৮৫৬ সালটি ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যাসাগরের হাত ধরে ১৮৫৬ সালের ২৬ জুলাই প্রনয়ণ করা হল 'দ্য হিন্দু উইডোজ রিম্যারেজ অ্যাক্ট'। ভারতের বুকে সুত্রপাত হল এক নবযুগের। লর্ড ডালহৌসির সহযোগিতায় বিদ্যাসাগরের হাতে নতুন জীবন পেলেন ভারতের অসংখ্য বিবাহিত নারী। অবশ্য শুধু ভারত নয়, বিশ্ব-ইতিহাসের দিকে তাকালে বোঝা যায় ১৮৫৬ সাল আপামর বিশ্বের জন্যও কম সংঘাতপূর্ণ ছিল না। রাশিয়া–ক্রিমিয়ার যুদ্ধ, প্যারিস চুক্তি প্রভৃতি ঘটনায় পরিপূর্ণ ছিল বিশ্ব ইতিহাসের প্রতিটি পাতা। কিন্তু এরই মধ্যে প্রায় সবার অলক্ষে ঘটে গিয়েছিল আরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। না, বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে ঠাঁই হয়নি সেই ঘটনার। কিন্তু গোয়েন্দাসাহিত্যের ইতিহাসের দিকে তাকালে বোঝা যায়, ঘটনাটি নেহাত হেলাফেলা করার মতো নয়। হ্যাঁ, ১৮৫৬ সাল নাগাদ পৃথিবীর বুকে আত্মপ্রকাশ ঘটল প্রথম মহিলা গোয়েন্দার। আল্যান পিংকারটন নামের এক ভদ্রলোকের ডিটেকটিভ এজেন্সিতে ইন্টারভিউ দিতে এলেন কেট ওয়ার্ন। একটি তহবিল দুর্নীতির মামলায় প্রথম হাতেখড়ি হয় কেটের। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ইতিহাসের পাতায় নাম লেখালেন কেট, বিশ্ব তাকে চিনল ‘পৃথিবীর প্রথম মহিলা গোয়েন্দা’ হিসেবে। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি কেটকে। সাফল্য নিজে এসে ধরা দিয়েছে তাঁর কাছে। অর্থাৎ, গোয়েন্দা বলতেই আগে যে নির্দিষ্ট কোনও পুরুষের ছবি ভেসে উঠত আট থেকে আশির মনে, কেট সেই পিতৃতান্ত্রিক ট্যাবুকে ভেঙ্গে দিলেন একপ্রকার বিনা বাধায়। ইতিমধ্যে কেটের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে বহু দূর, এমনকী, আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন কেট ওয়ার্ন।

সাহিত্যের মহিলা গোয়েন্দারা কেন লাইমলাইটের আলো পায়নি, সেই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, এর পিছনে যে শুধুমাত্র পাঠকের পিতৃ‌তান্ত্রিক মানসিকতা দায়ী, তা নয়। সঙ্গে সঙ্গে মহিলা গোয়েন্দাকাহিনির মধ্যে উপযুক্ত প্লট বা বুননের অভাবও একইভাবে দায়ী। তবে একইসঙ্গে একথাও অস্বীকারের উপায় নেই, মহিলা গোয়েন্দার সংখ্যা সাহিত্যে নেহাত কম নয়, যাদের মধ্যে বিখ্যাত অনেকে। তবে বাংলা সাহিত্যে এর উদাহরণ খুব কম। আবার একই সঙ্গে এমন নয় যে, বাংলা সাহিত্যে মহিলা গোয়েন্দাকেন্দ্রিক কাহিনিগুলির মধ্যে বিষয়বৈচিত্রের অভাব আছে। কিন্তু তারপরেও একথা মেনে নিতে আমাদের অসুবিধে নেই যে, ফেলুদা বা ব্যোমকেশ অথবা অনান্য পুরুষ গোয়েন্দাদের তুলনায় বাংলা সাহিত্যের মহিলা গোয়েন্দারা অনেকাংশেই অন্ধকারে।

 

More Articles