পালকি চেপে যুদ্ধ- ময়দানে যেতেন মুঘল রমণীরাও, হারিয়ে যাওয়া সেই যানের গল্প...

‘পালকি চলে!/ পালকি চলে!/ গগন তলে/আগুন জ্বলে!/ স্তব্ধ গাঁয়ে/ আদুল গায়ে/ যাচ্ছে কারা/ রোদ্র সারা...’


কোথায় হারিয়ে গেল বেহারার দল? ইতিহাসের দায় মিটিয়ে আজ হারিয়ে গেছে পালকি, তবে রয়ে গেছে বাংলা সাহিত্যের পাতায়। এ দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতিতেও পালকি আছে বিশেষ মর্যাদা নিয়ে। ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর বিখ্যাত ‘পালকির গান’ কবিতায় তুলে ধরেছেন এ দেশের গাঁয়ের পথে চলা পালকির এক অবিস্মরণীয় চিত্র। যেখানে তিনি বলছেন,

কাজ্লা সবুজ/ কাজল প'রে/ পাটের জমী/ ঝিমায় দূরে!/
ধানের জমী/ প্রায় সে নেড়া,/ মাঠের বাটে/
কাঁটার বেড়া...!


যাঁরা পালকি বহন করেন তাঁদের বলে বেহারা। কোথাও কোথাও আবার বলে কাহার। বিখ্যাত ঔপন্যাসিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের `হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যে নতুন ধারার জন্ম দেয়। উপন্যাসটিতে হতদরিদ্র কাহার সমাজের এক করুণ চিত্র তুলে ধরেছেন তারাশঙ্কর। রবীন্দ্রনাথের ‘বীরপুরুষ’ কবিতার সেই ছোট্ট ছেলেটির মা-ও চলছিল পালকিতে চড়ে,

তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে, দরজাটুকু একটুকু ফাঁক করে...। 

রবীন্দ্রনাথ নিজেও পালকিতে চড়ে ঘোরাঘুরি করতেন। তিনি যখন শিলাইদহের জমিদার, তখন প্রজাদের খোঁজখবর নেওয়ার জন্য ব্যবহার করতেন পালকি। কুষ্টিয়ার শিলাইদহের রবীন্দ্রকুঠিতে আজও রাখা আছে রবীন্দ্রনাথের ব্যবহার করা বেশ কিছু পালকি। কুষ্টিয়ারই আরেক বিখ্যাত সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেনও চড়তেন পালকিতে।`বিষাদ-সিন্ধু’ উপন্যাসের জন্য খ্যাত এই লেখকের ব্যবহৃত একটা ভাঙাচোরা পালকি রাখা আছে তাঁর লাহিনীপাড়ার বাড়িতে।

সত্যজিতের সিনেমায় স্বমহিমায় ঠাঁই পেয়েছে পালকি। তিনি গুপি গাইন বাঘা বাইন – ছবির চিত্রনাট্যে পালকির কথা উল্লেখ করেছিলেন। চিত্রনাট্যের ভাষায়: 'দূর থেকে ওস্তাদি গানের শব্দ ভেসে আসে। দু'জনের দৃষ্টি ঘুরে যায় সেই দিকে। পালকি চেপে ওস্তাদ গাইতে গাইতে চলেছেন। তাঁর সঙ্গে বাজিয়ের দল এবং অন্যান্যরা মিছিল করে চলেছেন। মিছিল গুপী-বাঘার সামনে দিয়ে চলে যায়।'

আরও পড়ুন-বামেরা চেয়েছিল বাদ দিতে || কেন আজও প্রাসঙ্গিক ‘সহজ পাঠ’?

গানবাজনার অপরাধেই তাঁদের গ্রামছাড়া করেছে রাজার লোকেরা। কিন্তু ওস্তাদের লোকেদের সময় নেই রাস্তার ছেলেদের কথা শোনার। দ্রুতপায়ে দিগন্তের দিকে ছুটে চলে ছয় বেহারার পালকি। বাঘা বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে বলে, ‘বাপরে বাপরে বাপ, কী দাপট!’

শুধু সত্যজিতের সিনেমাতেই নয়, সত্যি সত্যিই দাপুটে লোকেরা পালকিতে চড়তেন। বড্ড গরিব ছিলেন সেকালের সাধারণ মানুষ। পায়ে হেঁটেই চলতেন দূরের যাত্রা। কিন্তু যাঁরা দাপুটে জমিদার, কিংবা রাজা-মহারাজা, পালকি ছিল তাঁদের অন্যতম বাহন। ঘোড়া ছিল, ঘোড়ার গাড়িও ছিল, কিন্তু ধনীদের আভিজাত্যের প্রতীক ছিল পালকি।

মুঘল আমলে রাজপরিবারের নারীদের মধ্যে পালকি বেশ জনপ্রিয় ছিল। বিশেষ করে যুদ্ধের সময়। মুঘল রাজবংশের একটা রীতি ছিল। যুদ্ধের সময় মুঘল রমণীরাও সম্রাটের সঙ্গে যুদ্ধের ময়দানে যেতেন পালকি চড়ে। সম্রাট হুমায়ুন সিংহাসনে বসার কিছুদিন পরেই ক্ষমতাচ্যুত হন বাংলার শাসক শের শাহের কাছে পরাজিত হয়ে। তারপর বহুদিন তিনি ফেরারি ছিলেন। অল্প কিছু সৈন্যসামন্ত নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন গুজরাট-মহারাষ্ট্রের পথে-প্রান্তরে। হুমায়ুনের স্ত্রী তাঁর সঙ্গে সঙ্গে চলতেন পালকিতে চড়ে। তিনি তখন সন্তানসম্ভবা। পালকিতে ঘুরতে ঘুরতে গুজরাতের মরুপ্রান্তরে জন্ম বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম প্রভাবশালী সম্রাট আকবরের।

পালকি শব্দটি সংস্কৃত ‘পালঙ্ক’ বা ‘পর্যঙ্ক’ থেকে এসেছে। পালি ভাষায় এই যানের নাম ‘পালাঙ্কো’। হিন্দি ও বাংলায় এটি পালকি নামে পরিচিত। অনেক জায়গায় এই যানকে ডুলি, শিবিকা প্রভৃতিও বলা হয়। পর্তুগিজরা এর নাম দেয় পালাঙ্কুয়িন। রামায়ণে পালকির উল্লেখ রয়েছে। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা এবং চতুর্দশ শতকের পর্যটক জন ম্যাগনোলি ভ্রমণের সময় পালকি ব্যবহার করতেন বলে জানা যায়। সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে এবং পরবর্তী সময়ে সেনাধ্যক্ষদের যাতায়াতের অন্যতম বাহন ছিল পালকি। আধুনিক যানবাহন আবিষ্কৃত হওয়ার আগে অভিজাত শ্রেণির লোকেরা পালকিতে চড়েই যাতায়াত করতেন। বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে বিয়ে ও অন্যান্য শুভ অনুষ্ঠানে বর-কনের জন্য পালকি ব্যবহারের প্রথা চালু ছিল। 

পালকি বিভিন্ন আকৃতি ও ডিজাইনের হতে পারে। সবচেয়ে ছোট ও সাধারণ পালকি (ডুলি) দুইজনে বহন করতেন। সবচেয়ে বড় পালকি বহন করতেন চার থেকে আটজন পালকি বাহক। পালকি বাহকদের বলা হয় বেহারা বা কাহার। হাড়ি, মাল, দুলে, বাগদি, বাউড়ি প্রভৃতি সম্প্রদায়ের লোক পালকি বহন করতেন। এঁরা দিনমজুরের কাজ এবং মাছের ব্যবসাও করতেন। বেহারারা পালকি বহন করার সময় নির্দিষ্ট ছন্দে পা ফেলে চলতেন। এই রীতি তাঁরা ওস্তাদের কাছ থেকে শেখেন। পালকি বহনের সময় তাঁরা বিশেষ ছন্দে গানও গেয়ে থাকেন। তাঁদের চলার গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে গানের তাল-লয় পরিবর্তিত হয়।

উনিশ শতকের চতুর্থ দশকে দাসপ্রথা বিলোপের পর বিহার, উড়িষ্যা, ছোটনাগপুর এবং মধ্যপ্রদেশ থেকে পালকি বাহকরা বাংলায় আসতে থাকেন। বহু সাঁওতাল পালকি বাহকের কাজ নেন। শুষ্ক মৌসুমে তাঁরা নিজেদের এলাকা থেকে এদেশে আসতেন এবং বর্ষা মৌসুমে আবার চলে যেতেন। কোথাও কোথাও অস্থায়ী কুঁড়েঘর বানিয়ে সাময়িক আবাসের ব্যবস্থা করে নিতেন। বাংলায় সতেরো ও আঠারো শতকে ইউরোপীয় বণিকরা হাটে-বাজারে যাতায়াত এবং তাঁদের মালপত্র বহনের জন্য পালকি ব্যবহার করতেন। তাঁরা পালকি ব্যবহারে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েন যে, কোম্পানির একজন স্বল্প বেতনের সাধারণ কর্মচারীও এদেশে যাতায়াতের জন্য একটি পালকি রাখতেন ও তার ব্যয়ভার বহন করতেন। কিন্তু পালকির ব্যয় বহন করতে গিয়ে কর্মচারীরা অবৈধ আয়ের নানাবিধ পন্থা অবলম্বন করতে থাকেন। ফলে কোর্ট অব ডিরেক্টরস ১৭৫৮ খ্রিস্টাব্দে সাধারণ কর্মচারীদের পালকি ক্রয় ও ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

পৃথিবী বদলে গিয়েছে, রাজাদের রাজত্ব গিয়েছে, গিয়েছে জমিদারের জমিদারিও। যানবাহনে এসেছে বিবর্তন। রেলগাড়ি, মোটরগাড়ি, রিকশা ইত্যাদি কত রকমের যানবাহন গ্রাম-শহরের পথে পথে। এসব যানবাহনে ধনী-গরিব সবাই চলাচল করতে পারেন। ইতিহাসের দায় মিটিয়ে তাই হারিয়ে গেছে পালকি। শেষ হয়েছে কাহারদের রোদে পোড়া, বৃষ্টিতে ভেজা কষ্টের জীবন। পালকির স্থান এখন ইতিহাসের পাতায়, সিনেমার পর্দায় আর জাদুঘরে।

More Articles