সমকামিতা, উভকামিতার ইঙ্গিত ছিল গানেই, দেশের প্রথম 'ক্যুইয়ার' আইকন ছিলেন ফাল্গুনী পাঠক
Falguni Pathak Queer: সূক্ষ্ম সমকামিতার ইঙ্গিত ছিল ফাল্গুনীর বহু গানেই। ১৯৯০-২০০০-এর দশকে সরাসরি হোমোসেক্সুয়ালিটি বা বাইসেক্সুয়ালিটি নিয়ে কথা বলা ছিল দুরূহ।
'বয়েজ কাট' চুল, বক্সি জ্যাকেট, প্যান্ট শার্টে স্মার্ট ঝকমকে একজন সঙ্গীতশিল্পী। নব্বইয়ের দশকে বড় হওয়া মানুষ দীর্ঘদিন মেতেছিলেন তাঁর নতুন ধরনের গানের আঙ্গিকে। বিশেষ করে উঁচু ক্লাসের স্কুল পড়ুয়া আর কলেজের ছাত্রছাত্রীরা। ১৯৯০-৯১ ভারতীয় উদার অর্থনীতির সূচনা মহিলাদের কাছে বিশ্বের এক অন্য দরজা খুলে দিয়েছিল। ৬০ থেকে ৮০-র দশক জুড়ে হিন্দি গান বা সিনেমার সংস্কৃতিতে যে প্রেম, যে ভালোবাসাবাসি মানুষ দেখে ফেলেছে, সেই মানুষ খুঁজেছে অন্যতর কিছু। বিশেষ করে মহিলারা। ১৯৯৫ সালে আলিশা চিনয় গাইলেন 'মেড ইন ইন্ডিয়া'। পছন্দের পুরুষ বেছে নেওয়ার সেই স্বয়ম্বর, মিলিন্দ সোমানের অনাবৃত দেহে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত যৌনতার ইঙ্গিত বুঝিয়ে দিল ভারতীয়দের পছন্দ পাল্টাচ্ছে। "অস্ট্রেলিয়া সে লেকে আমেরিকা" অবধি পুরুষ বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা ও সুযোগ প্রমাণ করল কীভাবে পালটে যাচ্ছে প্রেমের ধারণা। এই পাল্টানোর পথেই হেঁটে এলেন ফাল্গুনী পাঠক। নব্বইয়ের দশকের শেষার্ধে এসে ইন্ডি-পপের নেশায় বুঁদ হলো একাংশের শ্রোতা। ফাল্গুনী পাঠকের ব্যক্তিগত স্টাইল ছিক অ্যান্ড্রোজিনির সঙ্গে দর্শকদের প্রথম সাক্ষাৎ।
১৯৯৮ সালে ফাল্গুনী পাঠকের গলায় মুক্তি পেল 'ইয়াদ পিয়া কি আনে লগি' ('চুড়ি') গানটি। এক নজরে দেখলে মনে হবে মিউজিক ভিডিওটি আসলে সেক্স অ্যান্ড দ্য সিটির ভারতীয় সংস্করণ। সেই ভিডিওতে ফাল্গুনী পাঠক এলেন ব্লু ব্লেজার ও প্যান্টে। ধীরে ধীরে হয়ে উঠলেন নতুন প্রজন্মের পছন্দের এক আইকন। একে একে 'ম্যায়নে পায়েল হ্যায় ছনকাই', 'মেরি চুনর উড় উড় জায়ে' নয়া প্রজন্মকে প্রেম এবং বন্ধুত্বের রূপ দেখাল ভিন্ন চশমা দিয়ে৷ ভারতের 'ডান্ডিয়া কুইন' ফাল্গুনী পাঠকের বেড়ে ওঠা এমন একটি পরিবারে যেখানে রেডিও সবসময় বাজতেই থাকত। সঙ্গীতপ্রেমী সেই পাঠক পরিবারের পাঁচ কন্যার মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন ফাল্গুনী। শুধু ইয়ুথ আইকন নন, ফাল্গুনী হয়ে উঠেছিলেন 'ক্যুইয়ার' আইকনও!
প্রথাগত তালিম ছিল না ফাল্গুনী পাঠকের। বোন যখন গান গাইতে বসত, তিনিও সঙ্গে বসতেন কিন্তু কখনই কোনও প্রশিক্ষণ নেননি তিনি। প্রথম গাইলেন নয় বছর বয়সে, স্বাধীনতা দিবসের এক অনুষ্ঠানে। গেয়ে ২৫ টাকাও পেয়েছিলেন। কিন্তু ফাল্গুনীর বাবার ভীষণ না-পসন্দ ছিল এই গান গাওয়া, মারধর খেলেন ফাল্গুনী। নিরুৎসাহিত হয়েও গানের প্রতি নিজের ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন তিনি। গাইতেন, বাড়িতে এসে মারও খেতেন। ১৯৮৯ সালে একটি ডান্ডিয়া দলের সঙ্গে গান গাওয়া শুরু করলেন ফাল্গুনী। ১৯৯৪ সালে, নিজের ব্যান্ড 'তা থেইয়া' গড়লেন। এরপর থেকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ফাল্গুনীর প্রথম ইন্ডিপপ অ্যালবাম 'ইয়াদ পিয়া কি আসে লাগি' চার বছর পর মুক্তি পায় এবং অসম্ভব জনপ্রিয় হয়। জনপ্রিয়তার জেরেই বলিউডের বিভিন্ন গান গাওয়ার অফার আসতে থাকে স্বাভাবিকভাবেই। রাজি হন না ফাল্গুনী।
হিন্দুস্তান টাইমসকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমি বলিউডকে কখনই সিরিয়াসলি নিইনি। আমি অফার পেয়েছি, কিন্তু বলিউডে প্রবেশ মানেই আপনাকে দ্বিগুণ পরিশ্রম করতে হবে। আমি আমার শো এবং অ্যালবাম করতে পেরেই খুশি ছিলাম।"
ক্যুইয়ার আইকন
'ক্যুইয়ার আইকন' ফাল্গুনীর গানগুলি সমকামী আকর্ষণ, সম্পর্কের বন্ধন এবং উদযাপনগুলিকে খুব স্পষ্টভাবে উল্লেখ না করেই মূর্ত করে তুলেছে৷ টমবয় আচরণ, পোশাক, শরীরী ভাষা সবই ছিল প্রচ্ছন্ন ও অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই। আসলে, এই একই সময়ে নারীত্ব এবং সৌন্দর্যের এক অন্য সংজ্ঞা লিখতে শুরু করেছিল দেশ। চিরকালই অবশ্য করেছে। ফাল্গুনী প্রথা ভেঙেছেন, অথচ কোনও উচ্চকিত প্রকাশ না রেখেই। ফাল্গুনী এমন একজন গায়িকা হিসাবে এলেন, যাকে দেখেই বোঝা যায় তিনি প্রথার বাইরে। ছোট করে কাটা চুল এবং ঢিলেঢালা জামাকাপড় আর নো-মেকআপ লুক দেখে এখন অনেকেই বলেন, এটিই ছিল অ্যান্ড্রোজিনি ফ্যাশনের প্রথম প্রকাশ।
ফাল্গুনীর এইভাবে বেড়ে ওঠার নেপথ্যে রয়েছে একটি কাহিনি। “চারটি মেয়ের পরে, আমার বাবা-মা ভেবেছিলেন ছেলে হবে। আমার দিদিরা আমার চেয়ে অনেক বড় ছিল এবং তারাই আমাকে শার্ট এবং ট্রাউজার পরিয়েছিল। সেই থেকে স্কুলের ইউনিফর্ম ছাড়া আমি যা পরেছি সবই এই শার্ট ও ট্রাউজার,” ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেছিলেন তিনি।
অনিশ্চিত প্রেম এবং সম্পর্কের ধারণাকেই নিজের গানে খুঁজে ফিরেছেন ফাল্গুনী। মেরি চুনর উড় যায়ে গানটি মুক্তি পায় চলচ্চিত্র নির্মাতা দীপা মেহতার সিনেমা ফায়ার মুক্তি পাওয়ার ঠিক তিন বছর পর। বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গিতে সম্পর্ক ও ক্যুইয়ার প্রেমের কথা বলেছিল ফায়ার। ফাল্গুনীও নিজের গানে মিষ্টি প্রেমের সম্পর্কে আবৃত সমকামিতার ইঙ্গিত দিলেন। ত্রিকোণ প্রেমের গল্প বলা এই গানটির ভিডিও কেউ ভালো করে দেখলেই বুঝবেন ফাল্গুনী আসলে তাঁর যৌন পরিচয়ই খুঁজে বেরিয়েছেন।
একজন মহিলার সঙ্গে অন্য মহিলার বিশেষ বন্ধুত্ব, বাইসেক্সুয়ালিটির নানা ঘটনা অত্যন্ত সারল্য মেখে রয়েছে তাঁর এই গানের ভিডিওতে। শকুন্তলার ছবির সঙ্গে মহিলা চরিত্রটির বন্ধুত্ব, শেষ দৃশ্যে এক পুরুষের প্রবেশ এবং পুরুষকে এই গোপন সম্পর্ক ঢেকে রাখার অনুরোধ সবটাই বলে অন্য এক সম্পর্কের কথা।
সূক্ষ্ম সমকামিতার ইঙ্গিত ছিল ফাল্গুনীর বহু গানেই। একজন সঙ্গীতশিল্পী এবং একজন অনুসন্ধিৎসু হিসেবে ফাল্গুনী পাঠকের বলা সমস্ত গল্প, চরিত্রের বিশ্লেষণের নেপথ্যে যৌনতার ভিন্ন দিক খোঁজার চেষ্টা চোখে পড়েই। তবে হ্যাঁ, ১৯৯০-২০০০-এর দশকে সরাসরি হোমোসেক্সুয়ালিটি বা বাইসেক্সুয়ালিটি নিয়ে কথা বলা ছিল দুরূহ। ফলে নিজের যৌন পরিচয়কে ঢেকে রেখেছিলেন প্রতীকে, কাহিনিতে, নানা রকমের বিষমকামিতার আড়ালে। যেভাবে এখনও রেখে যেতে হয় রূপান্তরকামী, সমকামী বা অন্য যৌনপরিচয়ের মানুষদের।