সত্যজিতের চিত্রনাট্য চুরি করে সোজা অস্কার মঞ্চে! স্বীকৃতিতেও ঢাকেনি যে আঁধার
Satyajit Ray: বাঙালির নিজস্ব গল্পবুড়ো, কাছের চরিত্র তারিণীখুড়ো সহজেই মন জয় করল দুনিয়ার, এখানেই লুকিয়ে সত্যজিতের জাদু।
সত্যজিৎ রায়ের ছবি না দেখা আর চন্দ্রসূর্য না দেখা সমান- বলেছিলেন জাপানি পরিচালক আকিরা কুরোসাওয়া। বাঙালির কাছে সত্যজিৎ রায়ের আইকনিক গুরুত্ব আজও প্রশ্নাতীত। কিন্তু ভেবে দেখলে, আন্তর্জাতিক স্তরে সত্যজিৎ রায়ের অবস্থান সম্পর্কে বঙ্গজনের ধারণা সীমিত। লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্টের অস্কার বা লিজিয়ন দ্য অনারের মতো পুরস্কারের তালিকা বাদ দিলেও, আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র নির্মাতাদের চোখে সত্যজিৎ রায় কেমন, তা সরেজমিনে দেখলে বিস্মিতই হতে হয়।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে সত্যজিৎ রায়ের এই তাৎপর্য আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন তাঁর জন্মশতবর্ষে নেটফ্লিক্স তাঁর ছোটগল্প নিয়ে সিরিজ নির্মাণ করে। সম্প্রতি পরিচালক অনন্তনারায়ণ মহাদেবনের ‘দ্য স্টোরিটেলার’ সত্যজিৎ রায়ের প্রতি আরও একটি শ্রদ্ধা অর্পণ করেছে। ‘গল্পবলিয়ে তারিণীখুড়ো’ গল্পটির ওপর ভিত্তি করে পরিচালক ছবিটি তৈরি করেছেন। ছবিটি বুসানের ‘কিন-সি-জিওক’ পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে। পরিচালক মহাদেবনের মতে, এই ছবিটি সত্যজিৎ রায় তথা 'মাস্টার'-এর শৈলীর অনুকরণেই নির্মাণ করার চেষ্টা তিনি করেছেন। ছবিটিতে অভিনয় করেছেন পরেশ রাওয়াল, আদিল হোসেন, অনিন্দিতা বসু প্রমুখ। এই তালিকায় আছেন পরিচালক আদুর গোপালকৃষ্ণনও। মালায়ালম এই চলচ্চিত্র নির্মাতাকে রায়ের চলচ্চিত্র নির্মাণের ঐতিহ্যের প্রকৃত উত্তরাধিকারী হিসেবে মানা হয়। তাঁর বিখ্যাত সিনেমা ‘স্বয়ম্বরম’ অনেকটাই সত্যজিৎ রায়ের আদলে নির্মিত। এই সিনেমাটি জাতীয় চলচ্চিত্রের পুরস্কারে সেরা চলচ্চিত্র, সেরা পরিচালক, সেরা চিত্রগ্রাহক ও সেরা অভিনেত্রী- এই চারটি বিভাগে জিতে ইতিহাস রচনা করেছিল।
আরও পড়ুন: টাইটানিক থেকে অবতার, সত্যজিৎ লুকিয়ে ছিলেন সর্বত্র
শুধুই তো চলচ্চিত্র নির্মাতা ছিলেন না সত্যজিৎ। তাঁর দক্ষতা ওই রোল-ক্যামেরা-অ্যাকশনের থেকেও ছিল অনেক গুণ বেশি। নিজের সিনেমার জন্য গান কম্পোজিশন থেকে পোস্টার ডিজাইন, গল্প লেখা থেকে প্রচ্ছদ অঙ্কন- সবেতেই সেরার শিরোপা বারবার জিতে নিয়েছেন তিনি। তাঁর ক্যামেরার রিলে গল্প যেমন হৃদয়স্পর্শী বাস্তবতায় বদলে যেত, তেমনই গল্প বুননেও হৃদয়কে সবসময় এগিয়ে রেখেছেন তিনি, সে রহস্য হোক বা ভূত।
মজার বিষয় হলো, নবাগত সত্যজিৎ রায় 'পথের পাঁচালী' শুটিংয়ের সময় জানতেনই না যে, ছবির জন্য আলাদা করে স্ক্রিপ্ট তৈরি করতে হয়। শুটিং সেটে সহ পরিচালক এসে স্ক্রিপ্ত চাইলে রায় উত্তর দেন ‘স্ক্রিপ্টের কী দরকার। আমি যা বলব ওরা তাই করবে।’ এই শুনে সবাই হতবাক হয়ে যান। কিন্তু সবার কথা রাখতে অবশেষে তিনি পেন ধরতে বাধ্য হন ও সঙ্গে সঙ্গে লিখে ফেলেন ‘পথের পাঁচালী'-র স্ক্রিপ্ট। চলচ্চিত্র নির্মাণশৈলী নিয়ে যাঁর তেমন ধারণা ছিল না, সেই মানুষটাই তাঁর প্রথম ছবিতে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন বিশ্বকে।
১৯৫৫ সালে 'পথের পাঁচালী' মুক্তি পেলে ছবির জনপ্রিয়তাই ইন্দিরা গান্ধী ও সত্যজিৎ রায়ের মধ্যে আলাপ করায়। ইন্দিরা গান্ধী নিজেও ছিলেন সিনেমার সমঝদার, তিনি বুঝেছিলেন, ভারতের সিনেমাকে সত্যজিৎ রায়ের মাধ্যমেই তিনি বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে পারবেন। ইন্দিরা গান্ধীর মাধ্যমেই সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে আরেকজনের আলাপ হয়েছিল, তিনি মেরি সিটন। সিটন ছিলেন একজন ব্রিটিশ চলচ্চিত্র পরামর্শদাতা। 'পথের পাঁচালী' নিয়ে বিন্দুমাত্র সমালোচনাও সিটন এবং ইন্দিরা গান্ধী ধোপে টিকতে দেননি, এতটাই প্রভাব ছিল তাঁদের ওপর সত্যজিৎ রায়ের।
সিটন সত্যজিৎ রায়ের দ্বারা এতটাই উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন যে, ১৯৭১ সালে সত্যজিতের প্রথম ইংরেজি জীবনী ‘পোর্ট্রেট অফ এ ডিরেক্টর- সত্যজিৎ রায়’ বইটি লেখেন তিনি। ইন্দিরা গান্ধী তাঁর পিতা জওহরলাল নেহরুকে নিয়ে ছবি করতে বললে সত্যজিৎ রায় স্পষ্ট তাঁর মুখের ওপর 'না' বলেছিলেন। তিনি যে কতটা স্পষ্টবক্তা ও ব্যাক্তিত্বময় ছিলেন, তা আরও পরিষ্কার হয়ে যায় এই ঘটনায়, ইন্দিরা গান্ধীকে প্রত্যাখ্যান করতেও পিছপা হননি তিনি।
মার্টিন স্করসেসির মতো বিশ্ববন্দিত মার্কিন চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের গুণমুগ্ধ। স্করসেসি একাধিক অস্কার-বিজয়ীও বটে। তাঁর প্রথম দেখা ছবি সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’, সিনেমার এমন বাস্তবতাই তাকে সিনেমা তৈরির মঞ্চে আহ্বান জানায়। স্করসেসি তাঁর একাধিক সাক্ষাৎকারে তাঁর ওপর রায়ের প্রভাব ব্যক্ত করেছেন। এছাড়াও পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলানও থাকবেন এই তালিকায়। তাঁর মতে সত্যজিৎ রায়ের ছবি বিশ্বসেরা চলচ্চিত্রর তালিকায় থাকবে। আমেরিকান পরিচালক ওয়েস অ্যান্ডারসন ২০০৭ সালে সত্যজিৎ রায়ের শ্রদ্ধাজ্ঞাপনে 'দার্জিলিং লিমিটেড' নামে একটি ছবি তৈরি করেন। সত্যজিৎ রায়ের অনুগামীদের সংখ্যাটা নেহাত কম না, তালিকায় আরও অনেকে আছেন যেমন- জুলিয়া রবার্টস, বিখ্যাত এই মার্কিন অভিনেত্রী মনে করেন রায়ের শ্রেষ্ঠত্বের সঙ্গে আর কারও তুলনা হয় না। আকিরা কুরোসাওয়া সত্যজিৎ রায়কে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির ‘দৈত্য’ বলেও অভিহিত করেছেন বারবার।
কিন্তু এতকিছুর মধ্যেও যে দাগটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে বারবার, তা একটি মারাত্মক অভিযোগ। নামকরা পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গের বিরুদ্ধে অভিযোগ সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য ‘দ্য এলিয়েন’ তিনি একরকম চুরি করেন। ইউনিভার্সাল স্টুডিওজ-এর সঙ্গে সেই ছবি করার কথা ছিল সত্যজিতের। অভিনয় করার কথা ছিল খোদ মার্লন ব্র্যান্ডো-র। ইউনিভার্সাল-এই নাকি স্পিলবার্গ খুঁজে পান এই চিত্রনাট্য। 'দ্য এলিয়েন'-এর অনুসরণেই তিনি নির্মাণ করেন তাঁর জনপ্রিয় ছবি ‘ইটি: এক্সট্রা টেরেস্ট্রিয়াল’, যা পরিচালককে এনে দেয় অস্কার। ১৯৮২-তে এই সিনেমা মুক্তি পেলে স্টিভেনের বিরুদ্ধে চিত্রনাট্য চুরির অভিযোগ ওঠে। স্পিলবার্গ তা উড়িয়ে দিলেও এই বিষয়ে সত্যজিৎ রায় বলেন, "আমার চিত্রনাট্য ছাড়া ইটি সম্ভব নয়।" তাঁর নিজের ওপর এই আত্মবিশ্বাসই ছিল স্পিলবার্গের মুখের ওপর যোগ্য জবাব। রায় ভেবেওছিলেন যে, স্পিলবার্গের বিরুদ্ধে তিনি আইনি লড়াইয়ে নামবেন, কিন্তু তখন 'ঘরে বাইরে'-র শুটিং-এ ব্যাস্ত থাকায় তিনি আর মামলার বিষয় নিয়ে এগোননি। কে বলতে পারে এই সিনেমা যদি স্পিলবার্গের আগে সত্যজিৎ রায় বানাতেন, তাহলে হয়তো আরও একটা অস্কার ভারতের ঝুলিতে আসত।
যে-সময় ভারতীয় চলচ্চিত্রকে সবাই একঘেয়ে মেলোড্রামা বলে মুখ ফিরিয়ে নিত, সেই সময় সত্যজিৎ রায় বিশ্বের দরবারে ভারতীয় সিনেমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। অভিনেতা শাহরুখ খান বলেছেন, সত্যজিৎ রায় শুধুই চলচ্চিত্র পরিচালক নন, বরং তিনি স্বয়ং চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠান। এই কথা প্রমাণিত হচ্ছে আজও, যখন তাঁর কাহিনি নিয়ে ছবিতে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পালক জুড়ছে। বাঙালির নিজস্ব গল্পবুড়ো, কাছের চরিত্র তারিণীখুড়ো সহজেই মন জয় করল দুনিয়ার, এখানেই লুকিয়ে সত্যজিতের জাদু।