অবশেষে জামিন শার্জিল ইমামের, তবু কেন জেলের অন্ধকারেই দিন কাটাতে হবে মেধাবী গবেষককে

Sharjeel Imam: বুধবার দিল্লি হাইকোর্টে জামিন মিলল দেশদ্রোহ মামলায় ধৃত জেএনইউয়ের গবেষক শার্জিল ইমামের। তবে সবকটি মামলায় নয়। দিল্লি হিংসার মামলা থেকে রেহাই দেওয়া হয়েছে তাঁকে।

একদিন আগেই জামিনের আবেদন খারিজ হয়ে গিয়েছে ইউএপিএ মামলায় ধৃত উমর খলিদের। তবে বুধবার দিল্লি হাইকোর্টে জামিন মিলল দেশদ্রোহ মামলায় ধৃত জেএনইউয়ের গবেষক শার্জিল ইমামের। তবে সবকটি মামলায় নয়। দিল্লি হিংসার মামলা থেকে রেহাই দেওয়া হয়েছে তাঁকে। অভিযোগ, সিএএ বিরোধী বিক্ষোভের সময় নাকি শাহিনবাগ প্রতিবাদের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন শার্জিল। সে সময় তাঁর বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহ-সহ একাধিক মামলা দায়ের হয় পাঁচ রাজ্যে। সেই মামলায় ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে গ্রেফতার হন শার্জিল ইমাম।

অনৈতিক ইউএপিএ মামলায় এতদিন ধরে পুলিশি হেফাজতেই রয়েছেন দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষক। ট্রায়াল কোর্টে খারিজ হয়ে যায় শার্জিলের জামিনের আবেদন। সেই আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে ফের নতুন করে জামিনের আবেদন করেন শার্জিল। আদালতকে তিনি জানান, তাঁর বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ, তাতে দোষীসাব্যস্ত হলে যে সর্বোচ্চ সাজা মিলতে পারে, তার অর্ধেকেরও বেশি সময় ইতিমধ্যেই জেলে কাটিয়ে ফেলেছেন তিনি। প্রায় সাড়ে চার বছর পর অবশেষে মিলল মুক্তি। দিল্লি হাইকোর্ট বুধবার মঞ্জুর করেছে তাঁর জামিনের আবেদন। যদিও তাঁর অন্ধকার দিন এখনও শেষ হয়নি। বাদবাকি মামলাগুলি এখনও ঝুলছে তাঁর কাঁধে। সেই সব মামলাগুলির শুনানি আগামী ৪ জুলাই।

আরও পড়ুন: প্রাপ্য শুধুই সহমর্মিতা! উমরের মুক্তি চেয়ে কি আদৌ জোট বাঁধবে দেশ?

সিএএ বিরোধী বিক্ষোভে তখন ফুটছে দেশ। দিল্লির শাহিনবাগে প্রতিবাদে জড়ো হয়েছেন অজস্র মানুষ। সেই আন্দোলনকে দিশা দেখিয়েছেন শার্জিল। আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির সামনে দাঁড়িয়ে শার্জিল যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন সে সময়ে, তার ভিত্তিতে শার্জিলের বিরুদ্ধে প্রাথমিক ভাবে পাঁচটি মামলা দায়ের করা হয়। এর পরে দায়ের করা হয় আরও তিনটে। অসম, অরুণাচল, উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি, মণিপুর- এই পাঁচ রাজ্য থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের হয় মামলা। প্রথম মামলাটি হয় ২০২০ সালের ২৫ জানুয়ারি নাগাদ। তাঁর খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরছিল দিল্লি পুলিশের অপরাধ দমন শাখার পাঁচটি দল। মুম্বই, দিল্লির পাশাপাশি বিহারের জহানাবাদে তাঁর পৈতৃক ভিটেতেও হানা দেয় পুলিশ। জেরার জন্য তুলে আনা হয় তাঁর ছোট ভাইকেও। ২৮ জানুয়ারি আত্মসমর্পণ করেন শার্জিল।

Student Activist Sharjeel Imam Gets Bail In 2020 Sedition Case

এর পর একের পর এক মামলায় জুড়ে দেওয়া হতে থাকে শার্জিলের নাম। জামিয়া মিলিয়ার এফআইআর-এ মার্চ ও এপ্রিলে যোগ হয় শার্জিলের নাম। দিল্লি হিংসা মামলাতেও জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয় তাকে। অথচ দিল্লি হিংসা হয়েছিল ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে। শার্জিল তার এক মাস আগে থেকেই জেল হেফাজতে। অথচ সেই হিংসা মামলাতেও জুড়ে দেওয়া হল তাঁর নাম। একে একে অসম, অরুণাচল প্রদেশ এবং এলাহাবাদের মামলায় জামিন পান জেএনইউ পড়ুয়া। মণিপুরে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি না হওয়ায় সেখান থেকে জামিনের প্রয়োজন ছিল না। জামিয়া-মিলিয়া মামলাতেও ইতিমধ্যেই জামিন পেয়েছেন শার্জিল। বাকি ছিল দু'টি মামলা। তার মধ্যে প্রথমটি ছিল তাঁর বিরুদ্ধে জারি হওয়া দেশদ্রোহের মামলা। ঠিক নব্বই দিনের মাথায় যখন শার্জিল জামিনযোগ্য বলে বিবেচিত হওয়ার সম্ভাবনাটুকু তৈরি হল, সেসময়েই তাঁর বিরুদ্ধে রুজু করা হল ইউএপিএ-তে মামলা। সেই সব থেকে রেহাই পেতে নিম্ন আদালতে জামিনের আবেদন করা হয়। সেখানে খারিজ হয়ে যায় আবেদন। এরপর সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন শার্জিল। সেখানে অবশ্য় বছর দুয়েক পড়েই ছিল মামলাটি। অবশেষে এতদিন বাদে বিচারের মুখ দেখল সেই মামলা।  দিল্লি হিংসা মামলায় জামিন মঞ্জুর হল শার্জিলের।

বুধবার দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি সুরেশ কুমার কাইত ও বিচারপতি মনোজ জৈনের বেঞ্চের সামনে প্রসিকিউশন জানায়, শার্জিল তাঁর বক্তৃকায় উত্তর-পূর্বকে দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার হুমকি দিয়েছেন বলে অভিযোগ। তার জন্যই শার্জিলের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রোদ্রোহের মামলা দায়ের করা হয়। এর সাপেক্ষে শার্জিলের আইনজীবী আদালতকে জানান, ইউএপিএ -এর ধারা ১৩-র অধীনে সর্বোচ্চ সাজা ৭ বছর। যার মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি সময় অর্থাৎ চার বছর তিনি এমনিতেই হেফাজতে কাটিয়ে ফেলেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে কোনও অপরাধই প্রমাণিত হয়নি। অথচ বিনা প্রমাণে বিনা অপরাধে এতগুলি বছর জেলের অন্ধকারে নষ্ট হচ্ছে শার্জিলের মতো উজ্জ্বল এক ছাত্রের।

বিহারের জেহানাবাদে জন্ম শার্জিলের। আইআইটি বম্বে থেকে এমটেক করার পর আধুনিক ইতিহাল নিয়ে জেএনইউয়ে স্নাতকোত্তর পাশ করেন তিনি। ২০১৫ সাল নাগাদ সেখানেই শুরু হয় তাঁর পিএইচডি। শার্জিলের ভাই মুজাম্মিল জানান, মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে তাঁর মতো উজ্জ্বল পড়ুয়ার কাছ থেকে চার-চারটি বছর কেড়ে নেওয়া হল। এতদিনে হয়তো পিএইচডির গবেষণাও শেষ হয়ে যেত তাঁর। এতদিন জেলে থাকায় তাঁর মানসিক স্থিতি যেভাবে নষ্ট হয়েছে, বাকি মামলাগুলিতে জামিন পেয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরলেও কতটা পড়াশোনায় মন দিতে পারবেন শার্জিল, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

আরও পড়ুন:দু’বছর পর বেকসুর খালাস, জেল থেকে ছাড়া পাবেন উমর খালিদরা?

সম্প্রতি জামিন পেয়েছেন নিউজক্লিকের কর্ণধার প্রবীর পুরকায়স্থ। তাঁর বিরুদ্ধেও ইউএপিএ মামলায় আনা হয়েছিল সন্ত্রাসমূলক কাজকর্মে জড়িত থাকার অভিযোগ। এর আগে একাধিক বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, পড়ুয়া, অধ্যাপক, সাংবাদিককে এই অনৈতিক মামলায় গ্রেফতার করেছে রাষ্ট্র। কখনও কাউকে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহী নামে, কখনও কারওর গায়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে আরবান নকশালের তকমা। অবশেষে দিল্লি হিংসার মামলায় জামিন পেলেন শার্জিল। তাঁর বাকি মামলাগুলি এখনও ঝুলছে। অন্ধকারে ডুবে রয়েছে এখনও উমর খলিদের মতো ছাত্রনেতার ভবিষ্যৎ। কবে সুবিচার পাবেন তাঁরা? প্রশ্ন থেকেই যায়।

More Articles