আজ ধ্বংসস্তূপ, এই বাড়িতেই একদিন লেখা হয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামের মহাকাব্য

এ-বাড়ির উত্তর-পশ্চিম কোণের ঘরে থাকতেন অরবিন্দ। তাঁর বসবাসকালীন সেই সময় বহু বিশিষ্ট ব্যক্তির নিত্য আগমন লেগেই থাকত এখানে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এখানে এসে কবিতা পাঠ করেন সেই সময়ে।

আজ ভারতের ৭৫তম স্বাধীনতা দিবস পূর্ণ হলো। ভারতের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির ইতিহাস যতখানি রক্তাক্ত ও কলঙ্কিত, ঠিক ততখানিই গর্বিতও বটে। ৭৫ বছরের এই দীর্ঘ কালক্ষয়ের পথজুড়ে আমরা ফিরে ফিরে নানাভাবে জেনেছি পরাধীনতার শিকড় জড়ানো সংগ্রামের বিবিধ কাহিনি। শুনেছি কতশত মানুষের মৃত্যুবরণের কথা, আর এভাবেই ক্রমশ একটু একটু করে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ কী?

আজকের দিনে যেমন প্রথমবার দেশের মাটিতে ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল, তেমনই আজকের দিনে জন্মেছিলেন সংগ্রামী ও সাধক অরবিন্দ ঘোষ। তাঁর জীবনযাত্রার সঙ্গে আমাদের স্বাধীনতা প্রাপ্তি বৃহৎভাবে জড়িয়ে।

একটা সাহেবি শহর বনেদিয়ানার মোড়ক ছেড়ে যখন ধীরে ধীরে তার সংগ্রামী চেহারাটা দেখাতে শুরু করে, তখন নেহাতই ভয় পেয়ে ক্ষমতা হারানোর উৎকণ্ঠায় কতই ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে শাসক দল, যার মাশুল গুনতে হয় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতিটি বিদগ্ধ নাগরিককে। এসবের হিসেব আজ আমরা আর রাখি না। তবু, তার মধ্যেই যে বাড়িটা আমাদের অনেকের মনেই বিষাদের কালো দাগ রেখে দিয়েছে বরাবরের জন্য, তার কথা আজকের দিনে স্মরণ করা বড় জরুরি মনে হয়।

আরও পড়ুন: একসময় স্বাধীনতা সংগ্রামের আখড়া, আজ কলকাতার রাজপথে অবহেলিত হয়ে দাঁড়িয়ে এই বাড়ি

১৯০৬ সাল। সবে বঙ্গভঙ্গ হয়েছে, বছরখানেক হলো। কলকাতার বিপ্লবীগণ তখন নরমপন্থা ও চরমপন্থা- এই দুই দলে ভাগ হয়ে নিজের নিজের লড়াই চালাচ্ছেন। এমন সময় সুবোধ মল্লিক বরোদা থেকে ডেকে আনলেন অরবিন্দ ঘোষকে তাঁর নিজের বাড়িতে। নিজের বাড়ি বলতে বউবাজারের জেলেপাড়ার ক্রিক রো পেরিয়ে ওয়েলিংটন স্কোয়ারের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাসাদোপম বাড়িটা। তখন এই বাড়িজুড়ে বিশাল রমরমা। একে তো ইউরোপীয় স্থাপত্যে মোড়া আদ্যোপান্ত একটি সাহেবি রুচির বাড়ি, উপরন্তু রক্ষণশীল প্রথাকে ভেঙে ফেলার একের পর এক কর্মকাণ্ড হয়েই চলেছে ওই সুদৃশ্য বাগানঘেরা অট্টালিকার অভ্যন্তরে।

এ-বাড়ির উত্তর-পশ্চিম কোণের ঘরে থাকতেন অরবিন্দ। তাঁর বসবাসকালীন সেই সময় বহু বিশিষ্ট ব্যক্তির নিত্য আগমন লেগেই থাকত এখানে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এখানে এসে কবিতা পাঠ করেন সেই সময়ে। ১৯০৬ সালের অক্টোবর মাসে এখানেই প্রকাশিত হয় 'বন্দেমাতরম্' পত্রিকা। এই পত্রিকার লক্ষ্য ছিল কংগ্রেসের মধ্যস্থতাকারীদের বিরুদ্ধে চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা পূর্ণ স্বরাজের লক্ষ্যে, নতুন দলের মুখপত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা। সে লক্ষ্যেই এগোচ্ছিল কাজকর্ম। এমনকী, ১৯০৬-'০৭ সালে কংগ্রেস পার্টির কনফারেন্সের সময় আলোচনাসভাও বসে এই বাড়িটিতেই। এরকমই একটা সময় ১৯০৬ সালের ১৪ অগাস্ট বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজের উন্নয়নকল্পে এক লক্ষ টাকা দান করলেন সুবোধ মল্লিক, আর এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই পরবর্তীকালে পরিচিত হলো যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে।

১৯০৭ সালের মাঝামাঝি সময় ব্রিটিশ সরকারের নজরে পড়ল এই বাড়ি এবং 'বন্দেমাতরম' পত্রিকার যাবতীয় কার্যকলাপ। এই পত্রিকার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সকল সদস্যকে ঘোষণা করা হলো রাজদ্রোহী হিসেবে। ফলত ২৩ অগাস্ট পত্রিকার সম্পাদক অরবিন্দ ঘোষ, ম্যানেজার হেমেন্দ্র বাগচী ও প্রিন্টার অপূর্বকৃষ্ণ বসুকে চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার কিংসফোর্ডের এজলাসে হাজিরা দিতে হলো এবং এরপর শুরু হলো একে একে গ্রেফতার হবার কাহিনি। তখনও উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে শ্রী অরবিন্দকে পুলিশ ধরতে পারেনি পাকাপাকিভাবে। তাই ১৯০৮ সালের ১০ মে তাঁর বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় করার জন্য চিরুনিতল্লাশি চালানো হলো ওয়েলিংটন স্কোয়ারের এই বাড়িতে। তখন তিনি লোকমুখে পরিচিত আলিপুর বোমা মামলার একজন দাগী আসামী হিসেবে।

এরপর অনেক ঝড় বয়ে যায় বাংলাজুড়ে। বিপ্লবীরা হত্যা করলেন নন্দলাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে। জনমানবের উন্নয়নের 'রাজা'-ও তাঁর ব্রিটিশবিরোধী ক্রিয়াকলাপের জন্য ধরা পড়েন পুলিশের হাতে। সুবোধ মল্লিক ও তাঁর বাড়ি ব্রিটিশ সরকারের চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়ায় একটা সময়ে। এরপর 'বন্দেমাতরম' মামলায় মুক্তি পাওয়ার পর কবিগুরু অরবিন্দর সঙ্গে দেখা করতে আসেন এই বাড়িতেই এবং ১৯১০ সালে রাজা সুবোধ মল্লিক জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর শেষবারের মতো সাক্ষাৎ করেন অরবিন্দর সঙ্গে। এই বাড়ির ঠিক পাশের গলিতে একটু এগোলেই দেখা যাবে, হলদে-সাদা একটি ছোটখাটো বসতবাড়ি। বাড়িটির ফলক থেকে জানা যায়, ২/১, ক্রিক রো অধুনা ৪/১-এ গঙ্গারাম পালিত লেনের এই বাড়িটিই ছিল 'বন্দেমাতরম' পত্রিকার কার্যালয়।

বর্তমানে বাড়িটির স্বত্ব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে লেখা। বাড়ির বাইরে শ্বেতপাথরের ওপর ইতিহাসের টুকরো নিদর্শন হিসেবে জ্বলজ্বল করলেও, বাড়িটিতে জনসাধারণের প্রবেশ সর্বসম্মতভাবে নিষিদ্ধ। যে বাড়ির প্রতিটি ঘরে আজও হয়তো গিলবার্ট স্টুয়ার্ট কিংবা ওয়েলিংটনের তৈলচিত্র প্রজ্বলিত, যে বাড়ির নাচঘরের মেঝেতে পা রাখলে আজও শিহরণ জাগে, যে বাড়ির প্রতিটি কোণে আজও লুকিয়ে রয়েছে স্বাধীনতার ইতিহাসের অসংখ্য তথ্য, গল্প, ঘাম, রক্ত ও চিৎকার- সেই বাড়ির প্রতি ন্যূনতম কর্তব্যবোধেও আজ প্রত্যেকে উন্নাসিক। সাধারণ নাগরিকের হাজারও চিঠি, প্রতিবাদ ও ক্ষোভের পরেও আজকের শাসনকর্তারা নির্বিকার। শরিকি মামলা, ব্যক্তিগত জেদাজেদির টানাপোড়েন আর স্থবিরতা- নষ্ট হতে দেখার অভ্যাসে পরিণত করছে কলকাতার এই সম্পদটিকে।

বাড়ির নিচে আজ খুব স্বাভাবিকভাবেই সংসার বেঁধেছে বাস্তুহারা মানুষের দল। এটাই তাদের স্থায়ী আস্তানা। পুজোর সময় বক্স চলে, বেলুন ওড়ে, শিশুরা খেলা করে, লালচে রঙের বাড়ির দেওয়ালজুড়ে অশ্বত্থর গুঁড়ি ক্রমশ শক্ত হতে হতে দেওয়ালের ফাটল চওড়া করে। আর এক প্রহরী নির্লিপ্ত মুখে নকশাকাটা লোহার ফটকের ওপারে সারাদিন পায়চারি করে চলে। সবই বুঝি অভ্যেস?

এই বাড়িতে প্রবেশের স্বাধীনতা আজও মেলেনি নগরবাসীর। বাড়ির ফটকের বাইরে দাঁড়িয়ে গোল গোল নকশাকাটা চাকতি আর লোহার রড দেখলে ভেতরটা সত্যিই কারাগার বলে মনে হয়। যে কারাগারের বাসিন্দারা হয়তো সবাই মৃত অথবা জীবিত থাকাকালীন সকলেই কারাগারের দরজা ভেদ করে বাইরে বেরিয়ে এসেছেন, যাতে স্বাধীনতার নিঃশ্বাস বুকে নিয়ে প্রাণত্যাগ করতে পারেন নিজের দেশের মাটিতে শুয়ে। এঁদের মতো আমরাও আজ ফেলে আসা স্মৃতি আর ধসে পড়া বাড়ির ইতিহাসের গন্ধের ভেতর অন্ধকারে হাত ডুবিয়ে খুঁজে চলেছি, "স্বাধীনতার মানে কী?"

More Articles