প্রয়াত সাহারাশ্রী সুব্রত রায়! গরিবদের টাকা দ্বিগুণ থেকে জেল, বিতর্কই ছিল ছায়াসঙ্গী

Sahara Owner Subrata Roy Passed Away : সাহারাকে ৩৬০ কোটি টাকা ডলার জরিমানা করে সুপ্রিম কোর্ট, ভারতের ইতিহাসে এত টাকা জরিমানার নজির আর নেই।

সাফল্য-বিতর্ক-জটিলতা এবং সমস্তটা নিয়েই একদিন অন্তরালে চলে যাওয়া। অথচ আড়ালে থেকেও নিজের পরিচিতিকে বিন্দুমাত্র ক্ষয়ে যেতে দেননি যিনি, তিনিই সুব্রত রায়। সাহারা ইন্ডিয়ার নাম ভোলেনি দেশ, ভোলেনি তার স্রষ্টা সুব্রত রায়কেও। দীর্ঘকাল চর্চার বাইরে থেকেও মানুষ ভোলেনি তাঁকে। দীর্ঘদিনের অসুস্থতা শেষে ৭৫ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন সাহারা ইন্ডিয়ার সুব্রত রায়। বহু দিন ধরেই ক্যানসার, উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট, মধুমেহ ছাড়াও হৃদযন্ত্রের সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। মুম্বইয়ের কোকিলাবেন ধীরুভাই অম্বানী হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সেখানেই মঙ্গলবার তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বাংলায় চিটফান্ড শব্দটির সঙ্গে দুর্নীতি জড়িয়ে যাওয়ার বহুকাল আগেই, চিটফান্ড বিষয়টিকে প্রথম এত জনপ্রিয় করেন সুব্রত। ধুঁকতে থাকা সংস্থাকে করে তোলেন ভারতের অন্যতম বিখ্যাত বাণিজ্যিক নাম!

১৯৪৮ সালে বিহারের আরারিয়াতে জন্ম সুব্রত রায়ের। গোরক্ষপুর টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক তিনি। সাহারা ফাইন্যান্স নামের চিটফান্ড সংস্থাটিকে ১৯৭৬ সালে অধিগ্রহণ করেন সুব্রত। সাহারা ফাইন্যান্সের অবস্থা তখন মোটেও ভালো না। সুব্রত অধিগ্রহণের ঠিক দু'বছর পর ১৯৭৮ সালে সেটির নাম বদলে করে দেন সাহারা পরিবার। দিন-আনা দিন-খাওয়া দরিদ্র মানুষরাই ছিল সুব্রতর সাফল্যের সিঁড়ির এক একটি ধাপ। সাহারা পরিবার এই দরিদ্র মানুষদের থেকে টাকা তুলত। ন্যূনতম টাকা দ্বিগুণ করে ফেরত দেওয়া হতো এই মানুষদের। ক্রমেই এই সাহারা পরিবারের হাত ধরেই ভারতের বিশিষ্ট ব্যবসায়ীদের তালিকায় নিজের জায়গা পাকা করে নেন সুব্রত। আবাসন শিল্প, সংবাদমাধ্যম, হোটেল ব্যবসা-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাহারা পরিবারের দাপট ছড়িয়ে পড়ে।

সুব্রত রায়ের উত্থানের কাহিনি আক্ষরিক অর্থেই সিনেমার মতো। স্কুটারে করে নোনতা খাবার বিক্রি করতেন একসময়। ধীরে ধীরে দেশের প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের তালিকায় দীর্ঘকাল নিজের জায়গা অটুট রেখেছিলেন তিনি। দীর্ঘদিন ভারতীয় ক্রিকেট দলের স্পনসর ছিল সাহারা গ্রুপ। ভারতীয় ক্রিকেটারদের জার্সিতে সাহারার নাম জ্বলজ্বল করত একসময়। ভারতীয় রেলের পর সাহারা ইন্ডিয়াই ছিল ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম কর্মসংস্থানের মাধ্যম। সেই সময় সাহারা ইন্ডিয়ায় কাজ করতেন ১২ লক্ষ মানুষ। মানুষের টাকা নিয়ে মানুষকেই প্রতারণার দায়ে শেষে আদালতের রায়ে সোজা হাজতবাসও জোটে সুব্রতর।

আরও পড়ুন- আম্বানি, আদানিদের থেকেও বেশি মোট সম্পত্তির পরিমাণ! চেনেন বিশ্বের ধনীতম এই মহিলাকে?

১৯৯২ সালে ‘রাষ্ট্রীয় সহারা’ নামে হিন্দি সংবাদপত্র চালু করেন সুব্রত। তার কয়েক বছর পরে পুণেতে ১০ হাজার একরেরও বেশি জায়গা জুড়ে শুরু করেন ‘অ্যাম্বি ভ্যালি প্রকল্প’। সাহারার টিভি চ্যানেলও চালু করেন তিনি। লন্ডনের গ্রসভেনর হাউস হোটেল এবং নিউ ইয়র্কের প্লাজা হোটেলের মতো নামী হোটেলও অধিগ্রহণ করেন সুব্রত রায়। একের পর এক খ্যাতি জোটে যেমন, ছায়ার মতো আসে বিতর্কও। দুর্নীতির অভিযোগে জেলও খাটেন সুব্রত।

২০০২ সালে সেবি সুপ্রিম কোর্টে জানায় সহারা গ্রুপ অফ কোম্পানিজ বেআইনিভাবে ৩৫০ কোটি ডলার তুলেছে বাজার থেকে। সাহারা কর্তৃপক্ষ জানায়, লক্ষ লক্ষ ভারতীয় ব্যাঙ্কিং পরিষেবা গ্রহণই করেননি। এই মানুষদের বিনিয়োগের সুযোগ করে দিয়েছিল সাহারা। কারা এই বিনিয়োগকারী? অধিকাংশ বিনিয়োগকারীর অস্তিত্বই নেই বাস্তবে। সাহারা দুর্নীতি মামলায় দরিদ্র-মধ্যবিত্তের থেকে নেওয়া টাকা ফিরিয়ে দিতে নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট। সাহারাকে ৩৬০ কোটি টাকা ডলার জরিমানা করে সুপ্রিম কোর্ট, ভারতের ইতিহাসে এত টাকা জরিমানার নজির আর নেই। ২০১৪ সালের কারাদণ্ড হয় সুব্রত রায়ের। ২০১৬ সালে প্যারোলে মুক্তি পান। তারপর জেলে আর ফিরতে হয়নি ঠিকই তবে সুব্রত চলে যান অন্তরালে। ভারতের ব্যবসার মানচিত্র থেকে ক্রমেই ফিকে হতে থাকে সাহারার নামও। সুব্রত রায়ের মৃত্যু প্রমাণ করল, নাম ফিকে হলেও বিতর্ক ও খ্যাতির ইতিহাস মানুষ মনে রেখেছিল। মৃত্যু সেই ইতিহাসের শেষ পাতা, বলাই যায়।

More Articles