রিফিউজি মিষ্টি বিক্রেতার ছেলে ১১০০ কোটির ব্যাঙ্কের মালিক, কোন স্ট্রাটেজিতে সাফল্য বন্ধনের?

মাইক্রোফিন্যান্স ইন্ডাস্ট্রি প্রথম থেকেই ভারতের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে এসেছে। অন্ধ্রপ্রদেশের মাইক্রোফিন্যান্স ইন্ডাস্ট্রির হাব হোক অথবা সারা ভারতে ছড়িয়ে থাকা মাইক্রোফিন্যান্স ইন্ডাস্ট্রির রমরমা বাজার, ভারতীয় অর্থনীতিতে এই জিনিসের অবদান কখনোই ভুললে চলবে না। ১৯৯১ সালে তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিং ভারতের অর্থনৈতিক সংস্কার করলেন, তখন থেকেই ভারতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করল এই মাইক্রোফিন্যান্স ইন্ডাস্ট্রি। একটা সময় পর্যন্ত ভারতের মাইক্রোফিন্যান্স ইন্ডাস্ট্রিতে শেষ কথা ছিল অন্ধ্রপ্রদেশ। হায়দরাবাদে প্রথম থেকেই মাইক্রোফিন্যান্স ইন্ডাস্ট্রি রমরমা ব্যবসা করতে শুরু করেছিল, যা ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে রীতিমতো ফুলে-ফেঁপে হয়ে উঠেছিল একটি মাইক্রোফিন্যান্স হাব।

কিন্তু চিত্রটা পাল্টালো ২০১০ সালে। সেই বছর, হায়দরাবাদের মাইক্রোফিন্যান্স ইন্ডাস্ট্রির মালিকদের চাপানো অতিরিক্ত করের বোঝায় নিমজ্জিত হয়ে এবং তাদের বলপূর্বক টাকা আদায় করার পদ্ধতিতে অতিষ্ঠ হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হলেন হাজার হাজার ঋণগ্রহীতা। প্রশ্ন উঠল, অন্ধ্রপ্রদেশের মাইক্রোফিন্যান্স ইন্ডাস্ট্রির স্বচ্ছতা এবং নিয়মনীতিগুলি নিয়েও। ঘটনা প্রবাহের চাপ বুঝতে পেরে, একটি অর্ডিন্যান্স জারি করতে বাধ্য হলো অন্ধ্রপ্রদেশের তদানীন্তন সরকার। অর্ডিন্যান্স পাস হতে না হতেই, ব্যাপকভাবে ধাক্কা খেলো অন্ধ্রপ্রদেশের সমস্ত মাইক্রোফিন্যান্স অপারেশন। রাজ্যের বাইরে থাকা ঋণগ্রহীতারাও মাইক্রোফিন্যান্স অপারেশনে অনুভব করলেন চাপ। এক লহমায় কার্যত স্তব্ধ হয়ে গেল সারা ভারতের মাইক্রোফিন্যান্স ইন্ডাস্ট্রি। দেউলিয়া ঘোষিত হল অন্ধ্রপ্রদেশের একাধিক বেসরকারি মাইক্রোফিন্যান্স সংস্থা। অনেক সংস্থার অপারেশন নিয়ন্ত্রণ করতে হলো নতুন আদেশনামা মোতাবেক।

আরও পড়ুন-বরিসের আগমনে কি আদৌ লক্ষ্মীলাভ হবে ভারতের?

কালেকশন রেট ৯৯ শতাংশ থেকে সোজা নেমে এলো ২০ শতাংশের গন্ডিতে। ঠিক সেই জায়গা থেকেই জন্ম হলো একটি চারাগাছের, যা পরের ১২ বছরে হয়ে উঠেছে মহীরুহ। বাঙালি কখনো ব্যবসা করতে পারে না, এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে আজ মাইক্রোফিন্যান্স সংস্থা থেকে সংস্থাটি তৈরি করেছে, তাদের নিজস্ব ব্যাঙ্ক, বন্ধন ব্যাঙ্ক। বাঙালি উদ্যোগপতি চন্দ্রশেখর ঘোষের তৈরি এই সংস্থাটি বর্তমানে ব্যাঙ্কের মর্যাদা পেলেও, এই সংস্থার উত্থানের পিছনে রয়েছে অনেকগুলি আলাদা আলাদা কাহিনি এবং মাইক্রোফিন্যান্স সংস্থার কিছু নিজস্ব সমস্যা।

কী ভাবে শুরু হলো বন্ধন?

বন্ধন এর সূত্রপাত ১৯৯০ সালে কলকাতার একটি অত্যন্ত ক্ষুদ্র মাইক্রোফিন্যান্স ইন্ডাস্ট্রির গলি থেকে। সেই সময় কলকাতার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সাহায্য করার জন্য না ছিল কোনো ব্যাঙ্ক, আর না ছিল কোনো মাইক্রোফিন্যান্স সংস্থা। তাই তাদেরকে লোন নিতে গেলে শুধুমাত্র ভরসা করতে হতো মহজনদের উপরেই। এই বিষয়টিকে পরিবর্তন করতে চাইলেন চন্দ্রশেখর ঘোষ। কলকাতার সব থেকে গরিব এবং সাহায্য না পাওয়া সাধারণ মানুষকে নতুন ব্যবসা গড়ে তোলার জন্য কম সুদে ঋণ দেওয়ার পরিকল্পনা করলেন তিনি। তৈরি করলেন বন্ধন।

২০০১ সালে মহিলাদের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করতে শুরু করল বন্ধন। মহিলাদের সামগ্রিক উন্নয়নে তাদের স্বনির্ভর করা ছিল অত্যন্ত প্রয়োজন। তাই তাদেরকে কম সুদে ঋণ দিয়ে তাদের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন আনতে চাইলেন চন্দ্রশেখর ঘোষ। বাংলার সবথেকে নিম্নমধ্যবিত্ত এলাকায় শুরু করলেন সংস্থা। ২০০৬ সাল আসতে আসতে এই সংস্থার পরিধি অনেকটাই বৃদ্ধি পেল। এনবিএফসি থেকে লাইসেন্স গ্রহণ করার পরে নাম পরিবর্তন হলো বন্ধনের। এই সংস্থার নতুন নাম হল বন্ধন ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস প্রাইভেট লিমিটেড। তাদের কাজ তখনও একই রকম, তবে এবারে চন্দ্রশেখর ঘোষ এর সংস্থা পেল সরকারি মান্যতা। ২০০৯ সালে এই মাইক্রোফিন্যান্স পোর্টফোলিও পরিবর্তিত হলো নন ব্যাঙ্কিং ফাইনান্সিয়াল কোম্পানিতে। ঠিক তার পরের বছরই বন্ধন হয়ে উঠল ভারতের সবথেকে বড় মাইক্রোফিন্যান্স ইন্ডাস্ট্রি হোল্ডার।

অন্ধ্রের সমস্যার পরেও কী ভাবে টিকে রইল বন্ধন?

অন্ধ্রপ্রদেশে মাইক্রোফিন্যান্স সংস্থার সমস্যার পরেও বন্ধনের টিকে থাকার দুটি প্রধান কারণ ছিল। প্রথম কারণটি হলো, অন্ধ্রপ্রদেশে বন্ধন ব্যাঙ্কের তেমনভাবে কোন প্রভাব ছিল না। আর দ্বিতীয় কারণটি হলো, ফান্ডিং এর সমস্যা বন্ধন ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রে তেমন ভাবে কোনও দিন হয়নি। অন্ধ্রপ্রদেশের যখন মাইক্রোফিন্যান্স সংস্থার সমস্যা হয়েছিল সেই সময়ে ব্যাঙ্কগুলি তাদেরকে সাহায্য করতে আসেনি, বরং যে সমস্ত মাইক্রোফিন্যান্স সংস্থা ব্যাংকের কাছে সাহায্য চাইতে চায় তাদেরকে ফিরিয়ে দিয়েছিল সমস্ত ব্যাংক। কিন্তু চন্দ্রশেখর ঘোষ এর ক্ষেত্রে সেরকমটা হয়নি। তিনি, ভারতের মাইক্রোফিন্যান্স সংস্থার এপিসেন্টারে তেমন ভাবে যুক্ত ছিলেন না। এই কারণে, তাকে কোনোদিন ফান্ডিং নিয়ে খুব একটা সমস্যায় পড়তে হয়নি।

ব্যাঙ্কিং সেক্টরে প্রবেশ

২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া নন-ব্যাংকিং ফাইন্যান্সিয়াল কোম্পানীগুলির জন্য নিয়ে এলো একটি নতুন আদেশনামা। সেই সমস্ত সংস্থাকে ব্যাংকের মর্যাদা দেওয়া ছিল এই আদেশনামা প্রধান লক্ষ্য। এই আদেশনামা অনুসারে আরবিআই এর কাছে আবেদন জমা দিয়েছিল ২৬টি মাইক্রোফিন্যান্স সংস্থা। তাদের মধ্যে মাত্র দু'টির ভাগ্য খোলে এবং তারা পেয়ে যায় ব্যাঙ্কের মর্যাদা। এই দুটি কোম্পানি ছিল বন্ধন এবং আইডিএফসি।

আরও পড়ুন-বাজারে কাগজ বাড়ন্ত, এই নববর্ষে খেরোর খাতার ব্যবসায় ক্ষতি

ব্যাঙ্কের মান্যতা লাভের পরেই তাদের মূল লক্ষ্য ছিল কিভাবে তারা ভারতের ব্যাঙ্কিং সেক্টরে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। সেখানেও তারা কাজে লাগাল নিজেদের পুরনো ট্যাকটিকস। ২৩ আগস্ট ২০১৫ থেকে পুরোদমে একটি ব্যাঙ্ক হিসেবে কাজ করতে শুরু করলো বন্ধন। এটি ছিল ভারতের প্রথম নন-ব্যাঙ্কিং অরগানাইজেশন, যেটি কিনা ব্যাংকের মর্যাদা পেয়েছে। আদিত্য বিড়লা, লারসেন এন্ড টার্বো ফিনান্স হোল্ডিং, টাটা সন্স, বাজাজ ফিনসার্ভ এবং শ্রীরাম ক্যাপিটাল এর মত বড় বড় সংস্থা ওই ২৬টি আবেদনের মধ্যে থাকলেও আরবিআই ভরসা করেছিল বন্ধনকে। এই মুহূর্তে, বন্ধন ব্যাঙ্কে সব মিলিয়ে কাজ করেন ১৩,০০০ জন কর্মী। ভারতের ২২টি রাজ্যে বন্ধন ব্যাঙ্কের ২,০১৬ এর উপর শাখা রয়েছে। এছাড়াও, বিশ্বব্যাঙ্কের ইন্টারন্যাশনাল ফিনান্স কর্পোরেশন এই বন্ধন ব্যাঙ্কের ১০.৯৩ শতাংশ অংশীদারিত্বের অধিকারী। পাশাপাশি, ২০১৫ সালে যখন তারা ব্যাঙ্ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে তখন তাদের কাছে ক্যাপিটাল এর পরিমাণ ছিল ১১০০ কোটি টাকা, যা একটি মাইক্রোফিন্যান্স সংস্থার ক্ষেত্রে অনেক বেশি।

রিফিউজি মিষ্টি বিক্রেতার ছেলে থেকে বন্ধন লিমিটেডের মালিক - চন্দ্রশেখর ঘোষ

উত্থানের এই কাহিনি শুধুমাত্র বন্ধন ব্যাঙ্কের নয়, তা এই সংস্থার কর্ণধার চন্দ্রশেখর ঘোষ সাফল্যের। তাঁর সংস্থার নামের মধ্যেই তার কর্মকাণ্ডের অনেকটা ছাপ রয়েছে। ভারতের সবথেকে গরিব, সবথেকে নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষদের সঙ্গে তার বন্ধন, পূর্ব ভারতের মানুষদের সঙ্গে তার একাত্মতা সবকিছু মিলিয়েই আজ এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে বন্ধন ব্যাংক। মাত্র ২ লক্ষ টাকার প্রাথমিক ক্যাপিটাল দিয়ে নিজের জার্নি শুরু করেছিলেন চন্দ্রশেখর ঘোষ। সেই সময় একটি ছোট মাইক্রোফিন্যান্স সংস্থা খুলে বাংলার এবং পূর্ব ভারতের সবথেকে নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষদের ঋণ দেওয়ার পরিকল্পনা করলেন তিনি। সংস্থার নাম দিলেন বন্ধন ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড। ১৫ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে সকলের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠল এই সংস্থাটি।

একটি বাংলাদেশি রিফিউজি পরিবারে তাঁর জন্ম হওয়ার কারণে প্রথম থেকেই গ্রামীণ ভারতের সমস্যাগুলো তিনি নিজের চোখে দেখেছেন। তাঁর পিতা ছিলেন সামান্য একজন মিষ্টি বিক্রেতা। তাকে ভালো শিক্ষা দেওয়ার জন্য তাকে অত্যন্ত পরিশ্রম করতে হয়েছিল। ভারতে উচ্চমাধ্যমিকের পড়াশোনা শেষ করার পরেই, তাকে চলে যেতে হয় বাংলাদেশ। সেখানে ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে স্ট্যাটিসটিকস নিয়ে পড়াশোনা করেন তিনি। ১৯৮৫ সালে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি BRAC এর সঙ্গে যুক্ত হন চন্দ্রশেখর ঘোষ। বাংলাদেশের এই সংস্থাটি ছিল তার উন্নতির পথে প্রথম মাইলফলক। এই সংস্থাতে ফিল্ড অফিসার হিসেবে কাজ করতেন চন্দ্রশেখর ঘোষ। বাংলাদেশের সব থেকে নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং সব থেকে গরিব এলাকায় ফিল্ড অফিসারের কাজ করতেন তিনি। তাদের সমস্যাগুলি বুঝে সেগুলো সমাধান করতে করতেই একদিন তার মনে হয় নিজের একটি কোম্পানি তৈরি করার কথা।

সেখান থেকেই সূত্রপাত বন্ধন ব্যাঙ্কের চিন্তাধারার। কলকাতায় এসে বিভিন্ন এনজিওর সাথে যুক্ত হয়ে চলতে থাকে সমাজকল্যাণের কাজ। ঠিক সেই সময়ই ভারতে মাথাচাড়া দিতে শুরু করে মাইক্রোফিন্যান্স ইন্ডাস্ট্রি। কয়েকদিনের মধ্যেই এই মাইক্রোফিন্যান্স ইন্ডাস্ট্রি হয়ে ওঠে ভারতের আগামী ভবিষ্যৎ। কিন্তু, অন্ধ্রপ্রদেশের এপিসেন্টারে গিয়ে মাইক্রোফিন্যান্স ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করার ক্ষমতা তার ছিল না। তাই তিনি বেছে নিলেন কলকাতাকে। কলকাতার লাগোয়া ছোট শহর কোন্নগরে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কম সুদে ঋণ দিতে শুরু করলেন ঘোষ। কিন্তু সেই সময় কোন কমার্শিয়াল ব্যাঙ্ক তাকে কোন সাহায্য করতে চায়নি। সেই সময় তাঁর প্রধান সাহায্যকারী হিসেবে এগিয়ে আসেন তার বোন এবং ভগ্নিপতি। তারাই নিজেদের টাকা দিয়ে সাহায্য করেন চন্দ্রশেখরকে। এছাড়াও ৭.৫ শতাংশ সুদে ১.৭৫ লক্ষ-টাকা চন্দ্রশেখর ঘোষ জোগাড় করেন স্থানীয় এক ঋণদাতার কাছ থেকে। শুরু হয় বন্ধন ব্যাঙ্কের যাত্রাপথ।

প্রথমদিকে তার কাছে শুধু মাত্র দু'জন স্টাফ মেম্বার ছিল। একজন হলেন পার্থ সামন্ত এবং আরেকজন হলেন ফটিক বেরা। এই তিনজন একসঙ্গে কোন্নগরের বিভিন্ন ছোট ছোট ব্যবসায়ীকে ঋণ দেওয়া শুরু করলেন। ১,০০০ টাকা থেকে শুরু হতো তাদের ঋণের পরিমাণ। ধীরে ধীরে কোন্নগর ছাড়িয়ে এই সংস্থা নিজের পসার জমাতে শুরু করল বাগনান এবং কলকাতার আশেপাশের কিছু শহরতলী এলাকায়।

চন্দ্রশেখর জানান, প্রথমদিকে তারা ফ্ল্যাট ১৫ শতাংশ সুদ গ্রহণ করতেন ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে। সেই সময় খুব কম মানুষ ছিলেন যারা এই দিনের ব্যাপারটা বুঝতেন। তার উপর ব্যাংকে গিয়ে ঋণ নেওয়া, অনেকের ক্ষেত্রে সমস্যা হয়ে যেত। আয়করের ফাইল ভাল না থাকায় তাদের কোন ব্যাংক ঋণ দিতে চাইতো না। অনেকে আবার ব্যাংকের ঋণের সুদের চাপে পড়ে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করতেন। এই সমস্ত সমস্যার সমাধান করতেই চালু হয়েছিল বন্ধন ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস। এই সংস্থা থেকে ঋণ দেওয়া হতো অত্যন্ত কম সুদে, আয়করের ফাইল নিয়েও কোন সমস্যা হতো না। তাই তাদেরকে অনেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করেন খুব কম সময়ের মধ্যেই।

কী ভাবে সাফল্য পেল বন্ধন?

২০১০ সালের অন্ধ্রপ্রদেশ ক্রাইসিস এর পরেও বন্ধন ব্যাংক এর মধ্যে একটি মাইক্রোফাইনান্স সংস্থার উপরে কেন বিশ্বাস রাখলেন রেগুলেটররা? এই প্রশ্নের উত্তরটা কিন্তু লুকিয়ে আছে বন্ধন ব্যাংকের ট্র্যাক রেকর্ড এর উপর। সেই সময় পর্যন্ত কখনোই বন্ধন ব্যাংকের নামে কোনো রকম খারাপ রেপুটেশন এর খবর পাওয়া যায়নি। বছরের পর বছর ধরে পরিশ্রম করে, মাইক্রোফাইন্যান্স ইন্ডাস্ট্রিকে পূর্ব ভারতের কোনায় কোনায় পৌঁছে দিতে পেরেছিল বন্ধন। যে সমস্ত জায়গায় ব্যাংকের অত্যন্ত অভাব, যেসব জায়গায় ব্যাঙ্কের কোনো শাখা নেই বললেই চলে, সেসব জায়গাতেও সাধারণ মানুষকে অর্থ সাহায্য করে তাদের আর্থসামাজিক অবস্থা পরিবর্তনের চেষ্টা করেছিল বন্ধন ব্যাংক।

রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার কাছ থেকে মান্যতা পাওয়ার ক্ষেত্রেও ট্র্যাক রেকর্ড ভালো থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। সে দিক থেকে অসুবিধা পেয়েছিল বন্ধন ব্যাঙ্ক।

রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার তরফ থেকে ন্যূনতম এন্ট্রি ক্যাপিটাল সেট করা হয়েছিল ৫০০ কোটি টাকায়। প্রোমোটারদের জানানো হয়েছিল যেন তারা সম্পূর্ণ নন অপারেটিভ ফাইন্যান্সিয়াল হোল্ডিং কোম্পানি নিজের নামে রেজিস্টার করেন এবং তার নিচেই তাদের ব্যাংকিং সেক্টর চালান। সেরকম ভাবেই বন্ধন ব্যাংকের আত্মপ্রকাশ। বন্ধন ফাইনান্সিয়াল লিমিটেডের ফোল্ডিং স্ট্রাকচারের অধীনে এই বন্ধন ব্যাঙ্ক তৈরি হয়েছিল। মুম্বইয়ে তাদের প্রথম প্রেস কনফারেন্সে বন্ধন ব্যাঙ্কের কর্ণধার চন্দ্রশেখর ঘোষ বলেন, এই বন্ধন ব্যাঙ্কের প্রধান ফোকাস থাকবে ভারতের সবথেকে নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের অর্থনীতির দিকে। তারা যেন ভালোভাবে নিজেদের ব্যবসা চালাতে পারেন এবং তারা নিজেদের প্রয়োজন পূরণ করতে পারবেন সেটাই থাকবে বন্ধন ব্যাঙ্কের প্রধান লক্ষ্য। এখনো পর্যন্ত বন্ধন ব্যাঙ্ক তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষায় সফল। ৩০ জুন ২০২০ পর্যন্ত হিসাব দেখলে বোঝা যায়, তাদের ঋণগ্রহীতাদের ৬০ শতাংশ কিন্তু এখনো মাইক্রোফাইন্যান্স ঋণ গ্রহণ করেছেন।

প্রোমোটার হোল্ডিং সমস্যা

বন্ধন ব্যাংক তৈরি হওয়ার পরে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তরফ থেকে ঘোষণা করা হয়েছিল, আগামী তিন বছরের মধ্যে সেই সংস্থাকে প্রোমোটার হোল্ডিং ৪০ শতাংশে কমিয়ে আনতে হবে। এই জায়গায় সমস্যায় পড়ে বন্ধন ব্যাঙ্ক। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে তারা কিন্তু প্রোমোটার হোল্ডিং ৪০ শতাংশে কমিয়ে আনতে পারেনি। এর ফলশ্রুতিতে, বন্ধন ব্যাঙ্কের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া। তাদেরকে জানানো হয়, যতদিন না পর্যন্ত বন্ধন ব্যাঙ্ক তাদের প্রোমোটার হোল্ডিং কমাচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত তারা নতুন শাখা খুলতে পারবে না। পাশাপাশি, ব্যাঙ্কিং রেগুলেটরের তরফ থেকে চন্দ্রশেখর ঘোষের পারিশ্রমিক বন্ধ করে দেওয়ারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

তবে সেই সমস্ত সমস্যা কাটিয়ে আবারও নতুন করে ফিরে এসেছে বন্ধন। ২০২০ সালের আগস্ট মাসে বন্ধন ফাইনান্সিয়াল হোল্ডিংস তাদের কোম্পানিতে প্রোমোটার হোল্ডিং কমিয়ে নিয়ে আসে ৪০ শতাংশের গন্ডিতে। অন্যদিকে, তাদের অংশীদারিত্বের বাকি ৬০ শতাংশ এই মুহূর্তে আসছে ব্লগ ট্রেড থেকে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সম্পূর্ণ রিপোর্ট দেখে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া তাদের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা সরায়। আর ২০২০ সালের আগস্ট মাসেই আবারো পারিশ্রমিক পেতে থাকেন চন্দ্রশেখর।

সামনে আছে আরো চ্যালেঞ্জ

ব্যাঙ্ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার মাত্র সাত বছরের মধ্যেই বন্ধন তাদের লোন বুক অনেকটাই বৃদ্ধি করে নিয়েছে। ২০২০ সালের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ৬০,৬০০ কোটি টাকার পরিবর্তে তাদের লোন বুকের ডিপোজিট রয়েছে ৭৪,৩০০ কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক ইনভেস্টরদের কাছ থেকেও বিনিয়োগ গ্রহণে সক্ষম হয়েছে বন্ধন ব্যাঙ্ক। সিঙ্গাপুরের কংগ্লোমারেট সংস্থা ক্যালাডিয়ামের থেকেও আর্থিক বিনিয়োগ জোগাড় করতে পেরেছে বন্ধন ব্যাঙ্ক।

সম্প্রতি, তারা আইডিএফসি মাইক্রোফিন্যান্সকেও ক্রয় করল ৪,৫০০ কোটি টাকার বিড প্রাইসে। বন্ধন ব্যাংক এই মুহূর্তে ভারতের সবথেকে বড় মাইক্রোলেন্ডিং সংস্থা। আইসিআইসিআই, এইচডিএফসি এবং স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়াকে চ্যালেঞ্জ করে নিলামের খেলায় এই মাইক্রোফিন্যান্স সংস্থার বিড জিতে নিয়েছে বন্ধন ফাইনান্সিয়াল হোল্ডিং।

তবে, বন্ধন ব্যাঙ্কের প্রধান নির্ভরশীলতা কিন্তু এখনও রয়েছে মাইক্রোলোন এবং মাইক্রোক্রেডিটের ওপরেই। এই অতি নির্ভরশীলতা বন্ধন ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রে অনেক সময় সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

করোনা পরিস্থিতির পর ভারতের ব্যাংকিং সেক্টর অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে। নিম্ন মধ্যবিত্তদের অর্থনীতি অনেকটাই ধাক্কা খেয়েছে কোভিড পরবর্তী পরিস্থিতিতে। এছাড়াও, সামনে বন্ধন ব্যাঙ্কের কাছে চ্যালেঞ্জ রয়েছে একটি মোরাটোরিয়ামের। পাশাপাশি, ঋণখেলাপির সমস্যা নিয়েও জর্জরিত প্রায় সবকটি ব্যাঙ্ক এবং মাইক্রোফিন্যান্স সংস্থা। এত কিছুর মধ্যে আবার আইডিএফসি মাইক্রোফিনান্সের স্বত্ব গ্রহণ। সবকিছু নিয়ে কোনো সমস্যার মুখে পড়বে না তো বন্ধন ব্যাঙ্ক লিমিটেড?

 

More Articles