সুফি সাধকদের রাতের ওষুধ! কীভাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে জন্মাল বিশ্ববিখ্যাত কফি 'মোকা'?
History of Mocha Coffee: ১৪৫০ সালে, ইয়েমেনের ইসলামিক সুফিরা গভীর রাতের প্রার্থনার সময় জেগে থাকার জন্য প্রথম মোকা কফি খেতে শুরু করেছিলেন।
এমনিতে বাঙালি চা-খোর। তবে মাঝেসাঝে কফির কাপেও তুফান ওঠে। তুফান বলতেই মনে আসে, এখন সবচেয়ে বেশি চর্চা তো মোকা তুফান নিয়ে। অনেকে মোচা ডেকে তৃপ্তি পাচ্ছেন ঠিকই, তবে তথ্য ও ইতিহাস বলছে বাংলার কলার মোচার সঙ্গে আসন্ন ঘূর্ণিঝড় মোকার কোনও সম্পর্কই নেই, সে যতই ইংরেজি ফোনেটিক্স তাকে 'মোচা' বলে ডাকিয়ে বিভ্রান্ত করুক না কেন। কফিপ্রেমীরা জানেন, মোকা আসলে এক বিখ্যাত কফি। এবার ঘূর্ণিঝড়ের নাম দিয়েছে ইয়েমেন। আরব সাগরের প্রান্তে অবস্থিত এই ইয়েমেনের বন্দর শহরের নাম 'মোখা' বা ‘মুখা’, যদিও উচ্চারণ অনুযায়ী সে 'মোকা। ১৯ শতক পর্যন্ত মোখাই ছিল ইয়েমেনের রাজধানী সানার প্রধান বন্দর। এই মোখা শহরেই চাষ হয় বিখ্যাত কফি ‘মোকা’র। কফিটির নামও দেওয়া হয়েছে বন্দর শহরটির নামেই। কেন এত জনপ্রিয় হলো এই কফি? ইতিহাস খুঁড়তে গেলে দেখা যাবে, সুফি সাধকদের রাতজাগানিয়া ওষুধ ছিল এই মোকা!
মোকা আসলে মিষ্টি চকলেটের মতো এক কফি। চকলেট সিরাপ বা কফির সঙ্গে পাউডারের মিশ্রণ এই কফির ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ। মোকা কফির আসল স্বাদ পেতে পয়সাও খসবে বেশ! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কিছুকাল আগেও ইয়েমেনি কফির দাম ছিল প্রতি পাউন্ড ১৭৩ ডলার! যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেনের উপকূলীয় শহর মোখাতে লুকিয়ে রয়েছে এই বিশ্ববিখ্যাত কফির শিকড়।
ইয়েমেন কফির ইতিহাস
২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ইয়েমেনের একচেটিয়া বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল মোখা। ইথিওপিয়ান যাযাবর পর্বতবাসীরাই প্রথম নাকি এই মোকা কফির উদ্দীপক প্রভাব টের পান। তারপর সেই মধ্যযুগ থেকে ইয়েমেনে মোকা কফির ব্যবহার শুরু। ওয়ার্ল্ড কফি রিসার্চের তথ্য বলছে, ইয়েমেনের জাবিদ শহরে মোকা কফি খাওয়ার প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণও পাওয়া গিয়েছে।
আরও পড়ুন- সেলিব্রিটিদের পছন্দ, মল থেকে তৈরি এই কফির নেপথ্য ইতিহাস জানলে শিউরে উঠবেন
১৫ শতকে স্থানীয় চাহিদা মেটাতে ইয়েমেনে কফি চাষ শুরু হয়। ১৪৫০ সালে, ইয়েমেনের ইসলামিক সুফিরা গভীর রাতের প্রার্থনার সময় জেগে থাকার জন্য প্রথম মোকা কফি খেতে শুরু করেছিলেন। বলা হয়, ১৫ শতকে এই সুফি সন্ন্যাসীরাই নাকি ইয়েমেনে কফি আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁরা ইয়েমেন কফির বীজগুলিকে শুকিয়ে কালো করে সেগুলি পিষে এমন একটি পানীয় তৈরি করতেন যা তাদের রাতভর জাগিয়ে রাখত, রাত জেগে পড়াশোনা করতেন তাঁরা। এই প্রথা দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে যায় এবং ইস্তাম্বুল, কায়রো, দামেস্ক, মক্কায় ছড়িয়ে পড়ে।
ধীরে ধীরে ইয়েমেনের পাহাড়ের ধাপে ধাপে কফি চাষ শুরু হয় ঢালাওভাবে। ইয়েমেনের মোখা বন্দর থেকেই টন টন জীবাণুমুক্ত কফি বিনস বিদেশে পাঠানো হতো। ১৬৫০ সালে প্রথম ইউরোপে কফি শপ খোলার সঙ্গে সঙ্গে মোকা কফির জনপ্রিয়তা হু হু করে বেড়ে যায়।
কীভাবে তৈরি হয় ইয়েমেনি মোকা কফি?
কফি গাছ থেকে চেরি বাছাই করার পরে, এগুলি রোদে শুকনোর জন্য রেখে দেওয়া হয়। একবার নরম রসালো সেই চেরি রোদ, হাওয়ার স্পর্শে শক্ত হয়ে গেলেই সেটি সঙ্কুচিত হয়ে গাঢ় বাদামী থেকে কালো হয়ে যায়। ফলটি ছাড়িয়ে নিয়ে ভেতরের বীজ বের করে নেওয়া হয়। অনেকেই বলেন, শুকনোর এই প্রক্রিয়াই কফিকে মিষ্টি এবং তীব্র করে তোলে। মোকা কফির স্বাদ বেশ জটিল, বেশ সোঁদা এবং স্বতন্ত্র।
ইয়েমেনে বিভিন্ন ধরনের কফি মেলে। এখানে কফির এমন বৈচিত্র রয়েছে যা বিশ্বের অন্য কোথাও নেই এবং সেই কারণেই ইয়েমেনি কফির স্বাদ বিচিত্র থেকে বিচিত্রতর হয়। ওয়ার্ল্ড কফি রিসার্চ বলে, অ্যারাবিকা কফি বিনের উৎপত্তি ইথিওপিয়া থেকে, এই বোর্বন জেনেটিক কফি বিন মোখা শহরে পাওয়া কফি গাছ থেকে উদ্ভূত। বোর্বন কফি বিনস গাঢ়, মাখনের মতো চকোলেটের স্বাদে ভরপুর। এই কফির ফল মিষ্টি এবং খুব হালকা।
ইয়েমেনের পশ্চিমাঞ্চলীয় পার্বত্য অঞ্চলে চারটি প্রধান কফি উৎপাদক অঞ্চল রয়েছে- হিরাজি, মাত্তারি, সানানি এবং ইসমালি। এই অঞ্চলে তিনটি জনপ্রিয় ইয়েমেন কফি বিনস জন্মায়- মোকা খুলানি ন্যাচারাল, মোকা হাজ্জাহ ন্যাচারাল, এবং রেড সি ব্লেন্ড - ইথিওপিয়ান এবং ইয়েমেনি কফি বিনের এক জটিল মিশ্রণ৷
আরও পড়ুন- মোচা নয়, আসন্ন ঘূর্ণিঝড়ের আসল নামের আড়ালে রয়েছে বিশ্ববিখ্যাত এক কফি!
জনপ্রিয়তার পথে মোকা
মোখা থেকে ধীরে ধীরে মোকা হলো কীভাবে? কফি বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, ২০ শতকের শুরুতে একটি ভাষাগত পরিবর্তন হয়েছিল। কফি এবং চকলেট মেশানোর প্রথম নথিভুক্ত উল্লেখ মেলে ১৮৯২ সালে। মোকা কফি ব্যবহার করে 'মোকা কেক' তৈরির একটি রেসিপিতে প্রথম এর উল্লেখ পাওয়া যায়। দ্বিতীয় উল্লেখ মেলে ১৯২০ সালে। ওয়াশিংটন পোস্ট 'চিল্ড মোকা'-র একটি রেসিপি প্রকাশ করে যাতে দুধ, কফি, কোকো, চিনি এবং ভ্যানিলা মেশানো ছিল।
১৯০০-এর দশক পর্যন্ত, চা এবং কফি ট্রেড জার্নালের মতো পুরনো কফি প্রকাশনাগুলি ইয়েমেন থেকে আসা মোকা কফির নামোল্লেখ করেছে এবং এই একই সময়ে, কফি ও চকলেটের রেসিপিগুলি একসঙ্গে মিশ্রিত হতেও শুরু করে। তবে, ইয়েমেনি কফি উৎপাদন কমে যাওয়ায় এবং বিশ্বের অন্যান্য অংশে এই কফির নিজস্ব উৎপাদন শুরু হওয়ায় কফি বাণিজ্যের উপর ইয়েমেনের একচেটিয়া আধিপত্য শেষ হয়ে যায়।
১৭ শতক নাগাদ ইয়েমেনি বন্দর শহর আল মোখা আন্তর্জাতিক কফি বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল। সেই মোখা থেকেই কফির নামও হয়ে যায় মোকা। পরবর্তী শতাব্দী জুড়ে, ইয়েমেনই মোকা কফির একমাত্র সরবরাহকারী দেশ ছিল। কিন্তু ১৭২৬ সালে, জাভার ডাচ উপনিবেশ ইয়েমেনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু করে, তাদের নিজস্ব সরবরাহ বৃদ্ধি করে এবং কফি বাজারে ইয়েমেনের একচেটিয়া আধিপত্যকে টলিয়ে দেয়। পরবর্তী কয়েক বছরে ইয়েমেনের বাজারের দাপট খানিক কমলেও দেশটি বরাবরের মতোই কফি উৎপাদন বৃদ্ধি ও রপ্তানি অব্যাহত রেখেছে। কফির তৃতীয় ঢেউ যখন এল, ইয়েমেন তখন গৃহযুদ্ধে জর্জরিত। কফি বিনের চাষ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেই সময়।
আসলে ইয়েমেনি কফি উৎপাদনের মূল চ্যালেঞ্জই দেশের নাগরিক অস্থিরতা। যুদ্ধ দেশটির কফি উৎপাদনকে মারাত্মক প্রভাবিত করেছে। গৃহযুদ্ধের পাশাপাশি, রোগ, বিশেষ করে, কলেরা, ইয়েমেনের কফি উৎপাদনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।