আত্মহত্যা না খুন? স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও রহস্যে মোড়া প্রফুল্ল চাকীর মৃত্যু

প্রফুল্ল চাকী আত্মহত্যা করেছিলেন- প্রচলিত এই কথাটি আজও কি বিনা সংশয়ে মেনে নেবে দেশ? তাঁর দেহে হত্যার লক্ষণই প্রকট। সঙ্গে নির্যাতন।

রমরমিয়ে স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব পালন করছে দেশ। পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ, কাতারে কাতারে মানুষ সেদিন যোগ দিয়েছিলেন ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে। ব্রিটিশদের দাসত্ব থেকে ভারতে মুক্ত করতে মুক্তিযোদ্ধা ও বিপ্লবীদের অবদান অনস্বীকার্য। তাঁদের আত্মবলিদান স্বাধীনতার সোপান গড়েছে ধীরে ধীরে। নৃশংস ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার প্রয়াসে ঝাঁপিয়ে পড়া মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন প্রফুল্ল চাকী। মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেন। ১৯০৮ সালে মোকামা স্টেশনে প্রফুল্ল চাকীকে পুলিশ ঘিরে ফেলায় তিনি আর কোনও উপায় না আত্মহত্যা করেন। এটাই প্রচলিত তথ্য। কিন্তু পুলিশের রেকর্ড দেখে এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, আদৌ তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন, না কি তাঁকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছিল। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও তাঁর মৃত্যুরহস্যের জট কাটেনি। উল্টে মাথাচাড়া দিয়েছে ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব।

প্রফুল্ল চাকীর মৃত্যুর পর কত বছর কেটে গেছে। এখনও সাধারণ মানুষের ধারণা, কিংসফোর্ড হত্যা-প্রয়াসে বোমাবর্ষণের পর পালাতে গিয়ে মোকামায় পুলিশের হাতে ধরার পড়ার আগে তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন। এমন তত্ত্বই তাঁর মৃত্যুর পর থেকে প্রচার করা হয়ে এসেছে। তবে তা কতটা বিশ্বাসযোগ্য, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। কারণ আলিপুরের 'স্মরণীয় বিচার সংগ্রহশালা'-য় রক্ষিত প্রফুল্ল-র মৃতদেহের ছবি দু'টিতে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে- নিজের ওপর গুলি চালনার ফলে আত্মহত্যা। এই ছবি বেশ কিছু প্রশ্নের জন্ম দেয়। তাই মনে হয়, সম্ভবত 'আত্মহত্যা'-র তত্ত্ব কর্তৃপক্ষর নিজস্ব ব্যাখ্যা। বিষয়টি আজও আলোচনার দাবি রাখে। প্রফুল্ল চাকীর মৃতদেহের ছবির দৃষ্টান্তে গুলি চালানোর তত্ত্ব প্রশ্নের অতীত নয়।

১৯০৮ সালে মাত্র আঠারো বছর বয়সে যে কিশোর ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে নেমে হাসিমুখে ফাঁসির মঞ্চে আরোহণ করেছিলেন, তাঁর নাম ক্ষুদিরাম বসু। তাঁর সহযোগী ছিলেন প্রফুল্ল চাকী। ক্ষুদিরামের ফাঁসির মাসতিনেক আগেই পুলিশের হাতে ধরা দেবেন না, তাই রগে রিভলভার ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন তিনি (প্রচলিত প্রচার)। দিনটি ছিল ১৯০৮ সালের ২ মে। ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল একই বছরের ১১ অগাস্ট। এই দুই বিপ্লবীর মৃত্যু হয়েছিল, একটি বিশেষ ঘটনা বা অপারেশনকে কেন্দ্র করে। সেটা কী?

আরও পড়ুন: চে নয়, বাঙালির এক মরণজয়ী মাস্টারদা ছিল, সূর্য সেনকে ফিরে দেখা

অপারেশন কিংসফোর্ড
বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন তুমুল আকার ধারণ করেছিল, ঠিক সেই সময় ব্রিটিশরা 'বন্দে মাতরম’ নিষিদ্ধ করে দেয়। সেই সময় বাংলার প্রেসিডেন্সি ম্যাজেস্ট্রেট ছিলেন কিংসফোর্ড। এমনকী, অন্য ব্রিটিশদের চেয়ে বেশিমাত্রায় বেপরোয়া ছিলেন কিংসফোর্ড। ইংরেজ শাসনের নির্যাতন তো ছিলই, সঙ্গে কিংসফোর্ডের অত্যাচার। ফলত যুগান্তর সমিতির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হলো, কিংসফোর্ডকে শাস্তি দেওয়া হবে। আর তাঁর উপযুক্ত শাস্তি হলো মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে এমন কাউকে চাই, যিনি একসঙ্গে বুদ্ধিদীপ্ত ও তেজি। এর আগে হেমচন্দ্র কানুনগো একবার চেষ্টা করেছিলেন কিংসফোর্ড হত্যার। সেই চেষ্টা তখন ব্যর্থ হয়। এই ১৯০৮ সালের হত্যাপ্রয়াসে বারীন ঘোষ ও হেমচন্দ্র কানুনগোর যৌথ ভাবনায় ক্ষুদিরামকে এই কাজের উপযুক্ত বলে মনে করা হয়। সঙ্গে সহযোগী হন প্রফুল্ল চাকী।

১৯০৮ সালে ১৫ এপ্রিল কিংসফোর্ড হত্যার উদ্দেশ্যে মুজফফরপুর রেলস্টেশনে মিলিত হলেন প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম বসু। স্টেশন থেকে ক্লাবহাউসের পথে রওনা দেন দুই বিপ্লবী। কারণ প্রতিদিন সন্ধ্যার পর সাদা ফিটন গাড়িতে চেপে ইউরোপিয়ান ক্লাবে তাস খেলতে যেতেন কিংসফোর্ড। ফিরতেন রাত সাড়ে আটটায়। তাই সেখানেই বোমা ও রিভলভার নিয়ে সতর্কতার সঙ্গে অপেক্ষা করতে থাকেন প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম বসু। কোনওভাবেই সুবিধে করা যাচ্ছিল না। অবশেষে ১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল অমাবস্যার রাতেই কিংসফোর্ডকে হত্যার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। ঠিক রাত আটটায় অন্ধকার পথ ধরে এগিয়ে আসা সাদা ফিটন গাড়িটি কাছে আসতেই বোমা ছুড়ে মারেন তাঁরা। সেবারও কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে ব্যর্থ হন তাঁরা। কারণ সেদিন কিংসফোর্ডের বদলে গাড়িতে ছিলেন মিসেস কেনেডি ও তাঁর কন্যা সন্তান। তখনও ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকী জানেন না, সেই অভিযান ব্যর্থ হয়েছে। ২টি আলাদা পথ দিয়ে পালিয়ে যান তাঁরা। পরে একটি দোকানে জল খেতে গিয়ে কনস্টেবলের হাতে ধরা পড়েন ক্ষুদিরাম। সেবার বেঁচে গেলেও রেহাই পাননি প্রফুল্ল চাকীও।

প্রফুল্ল চাকীর আত্মহত্যার তত্ত্ব
ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী- দু’জনেই পালানোর জন্য ধরলেন দু’টি আলাদা রাস্তা। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল সমস্ত স্টেশনের রাস্তা। ক্ষুদার্থ ক্ষুদিরাম দোকানে জল খেতে ঢোকেন। অপরদিকে প্রফুল্ল চাকীকে ধরে ফেলেন এএসআই নন্দলাল ভট্টাচার্য। এক বাঙালির দেওয়া নতুন জামাকাপড় ও জুতো দেখে এএসআই প্রফুল্ল চাকীকে সন্দেহ করেন। ধরা পড়ার পর তিনি নিজেই আত্মহত্যা করেন। অন্তত এমনটাই প্রচার করা হয়। তবে থেকে যায় নানা প্রশ্ন। চিবুকের নিচে দু’টি গুলি বিদ্ধ হওয়ায় মৃত্যু হয় তাঁর। সরকারি তরফে এটিকে আত্মহত্যা বলা হলেও, ছবি অন্য ব্যাখ্যা দেয়। অনেকেরই ধারণা, মৃত্যু-পরবর্তী ছবিতে আত্মহত্যার কোনওরকম চিহ্নমাত্র পাওয়া যায়নি। বরং পুলিশের নির্যাতনে হত্যার তত্ত্ব প্রকট হয়েছে।

মৃত্যু ঘিরে রহস্য ও প্রশ্ন
প্রফুল্ল চাকীর শরীরে দৈহিক পীড়নের ফলে ঠোঁটে গভীর ক্ষত দেখা যায় এবং কান-মুখ দিয়ে রক্ত বেরনোর অস্পষ্ট দাগ দেখা যায়, ফলে আত্মহত্যার তত্ত্ব মানতে নারাজ অনেকেই। প্রফুল্লর কীভাবে মৃত্যু হলো, এই প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর জানা নেই দেশের। বিভিন্ন লেখা ও সমসাময়িক পত্রিকায় অসংগতি প্রচুর। ভরসাস্থল হলো কোর্টের কাছে পেশ করা তথ্য, সাক্ষীদের জবানবন্দি, লেখকদের বিভিন্ন বিবৃতি। সাধারণত এই সব তথ্য ও সূত্রাবলির প্রতি যথেষ্ট মান্যতা দিতে হয়েছে। প্রফুল্ল আত্মহত্যা করেছেন, ব্রিটিশ পুলিশের রেকর্ড অনুযায়ী এই মত জোরালোভাবে প্রচার করা হয়েছে, তবে তা কতটা বিশ্বাসযোগ্য, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে দেশ। কেন তাঁর আত্মহত্যার তত্ত্বকে মানা যায় না? এর সপক্ষে এই যুক্তিগুলি সামনে আসে।

দু’টি গুলির ক্ষতের স্থান নির্দেশ করে একজন বাঁ-হাতির পক্ষেই এই স্থানে গুলি করে আত্মহত্যা করা সম্ভব। প্রফুল্ল ডানহাতি ছিলেন।

তাঁর কাঁধে সজোরে লাঠির আঘাত করা হয়েছিল। নিচের ঠোঁটে ছিল গভীর ক্ষত। কান-মুখ দিয়ে রক্ত বেরোনোর অস্পষ্ট দাগ নিয়েও সন্দেহ রয়েছে

প্রফুল্লর সঙ্গে গুলিভরা পিস্তল থাকতে বিনা বাধায় তিনি আত্মসমর্পণ করে আত্মহত্যা করবেন কেন?

Vital organ-এ একাধিক গুলিতে আত্মহত্যা কতটা সম্ভব?  কারণ প্রথম গুলির পর আর তেমন শারীরিক ক্ষমতা থাকে না।

কেন কোনও ডাক্তারের দেওয়া মৃত্যুর সার্টিফিকেট নেই?

অতএব প্রফুল্ল চাকী আত্মহত্যা করেছিলেন- প্রচলিত এই কথাটি আজও কি বিনা সংশয়ে মেনে নেবে দেশ? তাঁর দেহে হত্যার লক্ষণই প্রকট। সঙ্গে নির্যাতন। ফলে প্রফুল্ল চাকীর মৃত্যু ঘিরে রহস্য জিইয়ে রাখার দায় ছিল ব্রিটিশ সরকারের। আজ কোনও সরকারই কেন সেই রহস্যের জট কাটাতে সদিচ্ছা দেখাচ্ছে না?

More Articles