ভারতে হু হু করে বাড়ছে আত্মহত্যার অন্ধকার, কোন ভবিষ্যৎ অপেক্ষায়
Suicide Prevention Day 2022: আত্মহত্যা আটকাতে কোন পথ বেছে নেবে মানুষ?
আমরা প্রত্যেকেই আমাদের সম্ভাব্য মৃত্যুর তারিখটা জানি। জানি, তবে সচেতনভাবে নয়। কারণ মৃত্যু এমন এক অপ্রত্যাশিত তারিখকে স্মরণীয় করে দেয় আমাদের জীবনে, যাকে দূর থেকে চেনা মনে হলেও কাছে গেলে মনে হয় কই এখনও তো চিনতে পারিনি। কী অদ্ভুত ভাবুন! যে ব্যক্তি জীবনের প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে শারীরিক অবনতির কারণে কিংবা কঠিন রোগাবস্থার শেষ পর্যায়ে দাঁড়িয়ে ধুঁকছেন, তিনি প্রতিদিনই আধো ঘুমে আধো জাগরণে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছেন, এই বুঝি দিন ঘনিয়ে এলো, যে কোনো দিনই যে আমার মৃত্যুদিন হয়ে উঠতে পারে, তা তো আমি নিজেও জানি। কিন্তু ঠিক কোন তারিখটা আমার মৃত্যুদিবস হিসেবে চিহ্নিত হতে চলেছে জনসমক্ষে, তা তো আমার আর জেনে যাওয়া হলো না?
মুদ্রার ও-পিঠেরও একটা গল্প আছে। ধরা যাক, এই মৃত্যুদিন জেনে বুঝে, ভেবে চিন্তে আমি নিজেই ঠিক করলাম। সাত পাঁচ হিসেব কষে রাস্তা সাজালাম, কোন পথে কেমন করে এগোলে আমার মৃত্যু সুনিশ্চিত হবে। ফলে, ওরেবাবা এ জীবন ভাল্লাগছেনা, আর এই পোড়া জীবন রেখে কি হবে এই জ্বালা যন্ত্রণা নিয়ে প্রতিদিন এক ঢোল এক করতাল বাজাতেই হলোনা। মনে হলো, মরেই বুঝি নতুন করে বাঁচতে পারা যায়। অর্থাৎ আত্মহননকেই নতুন জীবন গড়ে তোলার সুনিশ্চিত উপায় হিসেবে ঠিক করে নিলাম।
ব্যাপারটা যেমন সহজ, সাদামাটা শোনাচ্ছে; তেমনটা না হলেও, পরিসংখ্যানের হিসেবে বিষয়টি আজ ঘরে ঘরে পরিচিত খাদ্যাভ্যাসের মতোই নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছে। গোটা পৃথিবীর কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, ভারতে গত দু' বছরে আত্মহত্যার সংখ্যা একলাফে ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কথা যেমন সত্যি, তেমনই এও সত্যি যে সাম্প্রতিক কালে আত্মহত্যা নিয়ে সচেতনতা, প্রচার, কর্মসূচি ইত্যাদিও বেড়েছে। বেড়েছে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজকর্মও। মেট্রো স্টেশন, রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় আত্মহত্যা বিরোধী ক্যাম্পেইন, টোল ফ্রি নম্বর সহ পাশে থাকার নানান বার্তা ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন জনমুখে। তা সত্ত্বেও, ইদানীং কেন বারবার আত্মহত্যার খবর জলজ্যান্ত হয়ে ওঠে পর্দায়?
মানসিক বিষণ্ণতা, সেখান থেকে ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন এবং সেখান থেকে আত্মহত্যার চিন্তা মাথায় আসা এবং সর্বোপরি সেখান থেকে একদিন এই চিন্তাকে বাস্তবায়িত করে ফেলবার সিদ্ধান্ত নেওয়া- এই প্রতিটি পর্যায় এখন আমাদের অনেকেরই চেনা। এসব কারণে যে সবচেয়ে বেশী মানুষ আত্মহত্যা করেন, সে কথাও আমরা জেনে এসেছি এতোদিন ধরে। এ হিসেব কষে ফেলা খুব সহজ, তালে তাল মিলিয়ে, অসুস্থতার জালে বেঁধে মৃত্যু পরিণতির অনিবার্যতাকে, অবশ্যম্ভাবী ভেবে ফেলার মতো সরলীকরণ আর কিছুতেই বোধহয় হয় না। কিন্তু এর বাইরেও হাজার কারণে মানুষের মনে মৃত্যুচিন্তা আসে। মহামারীর দিনগুলোয় গৃহহিংসার কারণে অত্যাচারিত হয়ে বহু মহিলারা আত্মহত্যা করেছেন। বহু পরিযায়ী শ্রমিক ঘরে ফিরতে পারেননি বলে আত্মহত্যা করেছেন। বহু কৃষক প্রতি বছর ব্যর্থতায়, বিক্ষোভে, অর্থনৈতিক আর সামাজিক গ্লানিতে আত্মহত্যা করেন, বহু স্বতন্ত্র, সক্রিয় কর্মী হঠাৎ করে অন্নসংস্থান হারিয়ে আত্মহত্যা করেন, আত্মহত্যা করেন সেইসব প্রৌঢ় দম্পতি, যাঁরা সারাজীবন পরিবার পরিজনের সব দায়িত্ব পালন করার পরেও জীবনের প্রান্তসীমায় পৌঁছে বড্ড একা হয়ে যান। সবকিছু পাওয়ার পরেও যাঁদের মনে হয় এই একাকিত্বের গ্লানি আর সইছে না, তাঁরা একটু আগেভাগেই ছুটি নিতে চান জীবন থেকে। আর আছেন, বিনোদন জগতের তারকারা। যাঁদের আত্মহত্যার খবর গত বছর থেকে সংবাদ শিরোনামের শীর্ষ স্থানে অবিচল থেকে গেছে একই ভাবে।
কিছু মাস আগেই আমরা একের পর এক অভিনেত্রী এবং মডেলের আত্মহত্যার খবর পেয়েছি। যার প্রতিটি ঘটনাই প্রায় একই সূত্রে গাঁথা। পেয়েছি উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া ছাত্রীর অতি-চর্চিত আত্মহত্যার খবর। পেয়েছি এমন এক লিভ ইন্ দম্পতির আত্মহত্যার খবর, যাঁরা ঋণের দায় মেটাতে না পেরে নিজেদের উদ্যোগেই যৌথ সিদ্ধান্তে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। এছাড়া তো রয়েইছে নিত্যনৈমিত্তিক প্রেম-অপ্রেম, পরিবার, চাকরি, অসুস্থতা ঘটিত আরও পঁচিশ রকমের আত্মহত্যার খবর প্রতিদিন। সেসব কখনও দেখে আবার কখনও না দেখে, না জেনে আমরা যাপন করি নিজেদের জীবন। যতদিন ভালো থাকি, মনে মনে উচ্চারণ করি, বেঁচে থাকার মন্ত্র।
এক অতি সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ভারতে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে মহারাষ্ট্রে। তারপর রয়েছে তামিলনাড়ু, মধ্যপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ এবং কর্নাটক। এই পাঁচটি রাজ্য মিলিয়েই প্রায় ৫০ শতাংশের ওপর মানুষ এই দেশে আত্মহত্যা করেন। বাকি অংশের খবর আসে অন্যান্য পার্শ্ববতী রাজ্য থেকে। অর্থাৎ যে রাজ্যগুলি প্রায় প্রতিদিন শিরোনামে থাকে, সেখান থেকেই আসে বেশি আত্মহত্যার সংখ্যা। বলা যেতে পারে, খাতায়-কলমে বেশি। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রত্যন্ত গ্রামের আত্মহত্যার খবর সংবাদমাধ্যম অবধি পৌঁছয় না। তার মানে আসল সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়াচ্ছে, আরো বেশী। কিন্তু তা হলেও, বারবার ঘুরে ফিরে একটাই বিষয় মাথার মধ্যে পাক খাচ্ছে বারবার। যে সমস্ত শহরাঞ্চলে মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সংখ্যা বেশী, যে সব জায়গায় মানুষের বিনোদনের মাধ্যম হাজারো রকমের, সেখানেই কেন জীবনের প্রতি অসহিষ্ণুতা বেড়ে চলেছে রাতারাতি? কেবলই কি কংক্রিটের জঙ্গলের রোজনমচার একঘেয়েমি? না কি নিজেদের জীবনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা শেষ করে দিচ্ছে নিজেদেরই?
আত্মহত্যা কোনও সহজ উপায় নয়। আত্মহত্যা শুধুমাত্র ব্যর্থতা দিয়ে মোড়াও নয়। বহু ক্ষেত্রে আত্মহত্যা অন্যকে জানান দিয়ে যায়, কেবল দেখিয়ে দিতে, "যে জীবনের খোঁজ তুমি আমায় দিতে পারো নি, সে জীবন ছেড়ে আর এক অন্য নতুন জীবনের দিকে পাড়ি দিলাম আমি, এ বাঁচা অন্য বাঁচা, সবার বোঝা কম্ম না।" ফলে, আত্মহননেও 'আশার আলো' আছে। আছে দেখিয়ে দেওয়ার খেলা।
শিল্পে, সাহিত্যে, সিনেমার পর্দায় আত্মহননকে নানান ভাবে গ্লোরিফাই করেছেন বহুজন। সেখানে আত্মহননের মাধ্যমেই শুরু হয়েছে চরিত্রের নতুন যাত্রাপথ। এ যেন এক চিরন্তনের খেলা। বারবার কোনো এক তথাকথিত চরিত্রের নির্মাণে অবধারিত ভাবে তাকে আত্মহননের পথে ঠেলে দিয়ে যেন চরিত্র নির্মাতারাও মনে মনে খানিক সন্তুষ্ট হন এই ভেবে যে, এ তো এমনই হবার ছিল, এমনটাই হয়, হওয়াটাই স্বাভাবিক।
এমন করে গোটা সমাজই নানান ভাবে একদিকে যেমন আত্মহত্যা প্রতিরোধের কথা বলে, তেমনই আবার কোথাও গিয়ে আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে আশার আলোও দেখতে পায়। মনে মনে স্বীকার করে নেয় আত্মহত্যার সাপেক্ষে যুক্তিগুলোও। আসলে আত্মহত্যা আমাদের মনের সেই নিবিড় কল্পনার নিভৃত প্রদেশ, যেখানে যাপন করতে চাওয়া প্রতিটি মুহূর্তের অধিকার আমার একার। যেখান কোনো সমঝোতার হিসেব নেই, মানিয়ে নেওয়ার গুরুতর প্রচেষ্টা নেই, সহ্য করার জ্বালা নেই, ব্যর্থতার আড়াল নেই, শোকের পরিচর্যা নেই, অবসাদের স্থবিরতা নেই। আছে কেবল নিজের তৈরী করা একটা জগৎ, যে জগতের মালিক কেবল আমিই।
আজ এই আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবসে, কোনও তথাকথিত মনোঃচিকিৎসার কথা নয়, নয় কোনও সহানুভূতিসুলভ পরামর্শের বার্তাও, কেবল নিজেকে নিজের জীবনের মালিক ভেবে জৌলুসহীন শিরোনামে মৃত্যুর দিকে এগোতে এগোতেই প্রতিদিন অল্প অল্প করে বেঁচে থাকা যায় কি না, দেখুন না একবার! মৃত্যুচর্চা তো অনেক হলো। এবার জীবনচর্চা করে দেখা যাক না একবার, মনের ওই কাল্পনিক নিভৃত প্রদেশে রোজ একটু একটু করে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাওয়া যাচ্ছে কি না!