পথই হয়তো পথ দেখাবে: সুমন চট্টোপাধ্যায়
Suman Chattopadhyay : আমি এক নম্বরের খচ্চর, তদুপরি অসহায়। তাহলে আহাম্মকের মতো আমি লিখি কেন?
'শতম বদ, মা লিখ'
শাস্ত্রে এই সাবধানবাণী উচ্চারিত আছে। না মানলে তার পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে, আমার চেয়ে ভালো বাংলাবাজারে তা কেই বা জানে? কথা বলাটাও যে সম্পূর্ণ নিরাপদ, তা নয়। তবু মন্দের ভালো। কথা শব্দ-তরঙ্গে মিলিয়ে যায়, অনাদরে, অবহেলায় হলেও লেখা থেকে যায়। আমি ছন্দ মিলিয়ে অথবা না মিলিয়ে পদ্য রচনা করতে পারি না, বাস্তবের সঙ্গে কল্পনার মিশেলে জবরদস্ত গল্প বা উপন্যাস লেখাও আমার সাধ্যাতীত। ময়ূরপুচ্ছ ধারণ করার পরেও দাঁড়কাককে দাঁড়কাকের মতোই দেখতে লাগে, সেটুকু বোঝার কিংবা মানার মতো পরিমিতি-বোধ আমার বরাবরই ছিল, এখনও একই রকম আছে।
সারাটা জীবন ধরে খবরের কাগজের পাতায় আমি যেসব ছাইপাঁশ লিখেছি সাহেবরা কায়দা করে তারও নাম দিয়েছে ‘স্টোরি’। ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স থেকে দিয়েছিল নিশ্চয়ই। অনেকে যেমন আদালতে হলফ নামা দিয়ে অন্যের নাম-পদবি ধারণ করে জাতে উঠতে চায়। একটু ভিন্ন কোণ থেকে দেখলে মনে হয় এটা স্রেফ জবরদখল। তুই গপ্পো লিখে ফুটুনি মারিস না, আমিও রোজ স্টোরিই লিখি। হায় কপাল। আমি লিখি সৃষ্টিসুখের উল্লাসে পেট গুড়গুড় করে বলে নয়, অমরত্ব লাভের ছিটেফোঁটা বাসনাও আমার নেই। বেদান্ত মানতে পারলে বেশ ভালো হতো, বিশ্বাস করা যেত, এ জম্মে যা অনায়াত্ত থেকে গেল, পরের জম্মে তাতে সফল হওয়ার একটা সুযোগ অপেক্ষা করছে। দেহ নশ্বর, আত্মা স্থায়ী, এ বড় শ্রবণসুখকর, মনমোহিনী তত্ত্ব যার চুম্বকীয় ক্ষমতা একেবারেই অনস্বীকার্য।
আরও পড়ুন: কে তুমি?
তবে ওই যে বললাম, আমি এক নম্বরের খচ্চর, তদুপরি অসহায়। তাহলে আহাম্মকের মতো আমি লিখি কেন? হক কথা। মা কি কসম, আমি সাকুল্যে তিনটি জিনিস পারি- পড়তে, লিখতে আর বলতে। পারি এবং ভালোবাসি। বই পড়ার অভ্যাসটি না থাকলে গুমঘরে অতগুলো দিন-যাপন অসম্ভব হয়ে উঠত। দিনের কিছুটা সময় স্রেফ বকবক করার জন্য তুলে রেখেছি বাংলাস্ফিয়ারে ভিডিও করার জন্য। এবার ইনস্ক্রিপ্টের সৌজন্যে নিয়মিত লেখার একটা বন্দোবস্তও হয়েছে। আর কী-ই বা চাই। বাকিটুকু বিছানায় আধশোয়া হয়ে বই পড়া। এই ত্রিভূজের একোণ-ওকোণ ঘুরে বেড়িয়ে এখন আমার দিন যাপন।
বাঙালি পাঠক কোনটা ‘খাবে’ বা খাবে না, আমি বিলক্ষণ সেটা বুঝি, সারাটা জীবন পাঠকের ক্ষিদেই কেবল মেটাতে হয়েছে বলে অনেকের তুলনায় কিঞ্চিৎ বেশিই বুঝি দাবি করতে পারি। আজ অনেক কাল পরে নিয়মিত লেখার আমন্ত্রণ তাই আমায় কিছুটা হলেও আতান্তরে ফেলে দিয়েছে। আমার হৃদয় বলছে জীবনের বাকি কয়টা দিন পাঠকের ক্ষুন্নিবৃত্তি নাই বা করলি, সেয়ানা মস্তিষ্ক সাবধান করে বলছে ও সব গ্যাস খাস না, পয়সার বিনিময়ে যখন লিখছিস তখন পাঠককে সন্তুষ্ট রাখাটাই তোর একমাত্র অভীষ্ট হওয়া উচিত। হৃদয়-মস্তিষ্কের এমন ঠোকাঠুকির কোনও ফয়সালা আমি এখনও করে উঠতে পারিনি। পথই আমায় পথ দেখাবে ধরে নিয়ে পথে নামতে চাইছি।
আরও অগ্রসর হওয়ার আগে একটি ছোট্ট সংশোধনী। আমি নিয়মিত লিখব, প্রত্যহ না-ও লিখতে পারি। অধিকন্তু নঃ দোষায় সূত্রটি সব ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য নাও হতে পারে। অতি প্রসবে মা এবং শিশুর স্বাস্থ্য বিপন্ন হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। সবাই তো আর ইচ্ছে করলেই রাবড়ি দেবী হতে পারবেন না। এই বয়সে আমি তো কিছুতেই নই। প্রাথমিকভাবে ভেবে রেখেছি সোম থেকে শুক্র, কাজের দিনগুলিতে দৈনিক সংবাদের ভাষ্য লিখব, উইকএন্ডে, শনি ও রবিবার লিখব একান্ত ব্যক্তিগত গদ্য। এইভাবে মস্তিষ্ক আর হৃদয় উভয়কেই যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া যাবে, বিবেকের দংশন থাকবে না।
আমার এই ব্যক্তিগত পরিসরটি ভারি মজার, নানা রঙের দিনে বোঝাই একটি পেল্লাই জাহাজ। এখানে নোঙর করে এবার সেই জাহাজ থেকে এক এক করে সব কয়টি বাক্স খালাস করব। অকপটে, নির্ভয়ে, নিষ্কম্প হয়ে। বিবিধ বাক্সে মজুত আছে অসংখ্য কাহিনি। কখনও তা আনন্দের, রোমাঞ্চের, উত্তেজনার, কখনও আবার বিষাদের, ভয়ের, বিভীষিকার। আটপৌড়ে মধ্যবিত্ত গেরস্থের মতো আমার জীবন নয়, সরল রেখায় সহজ পথে তা এগিয়ে যায়নি, এখনও যাচ্ছে না।
আরও পড়ুন: বিশ্বাসে মিলায়ে শোক, অঙ্কে বিয়োগফল
কীভাবে বাঁচতে হয় বা বাঁচা উচিত আমি তা বুঝতেই চাইনি অথবা পারিনি, ফলে আদর্শ-জীবন বলে কিছু যদি সত্যি থেকে থাকে তার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ পরিচয়টুকু পর্যন্ত হয়নি। আমার জীবনবোধে গতকাল কিংবা আগামিকালের গুরুত্ব অকিঞ্চিৎকর, আজ এই মুহূর্তটিই সব। 'কাল ক্যায়া হোগা, কিসকো পাতা, আভি জিন্দগিকা লে লো মজা!' তাহলে? ফাসেন ইওর সিট বেল্ট ফর টেক অফ! বাকি কথা উড়তে উড়তে।