গোলের গন্ধ ছিল সুনীলের রক্তে
Sunil Chhetri: সুনীল ছেত্রী মানেই রেকর্ড। ১৫১টি ম্যাচে তাঁর গোলসংখ্যা ৯৪।
যদি এমন হতো! বাংলাদেশের জার্সি গায়ে খেলতেন সুনীল ছেত্রী। ভারতের ফুটবল দলকে তাহলে অবলীলায় বারবার হারাত পদ্মাপারের দেশ। গোল করতেন সুনীল। তাতাতেন দলকে। শত-সহস্রের অনুপ্রেরণা হতেন। গর্ব করে বঙ্গবন্ধুর দেশ হয়তো বলত, "আমাদেরও একটা সুনীল ছেত্রী আছে।"
এ নিছক অতিকথন নয়। বাংলাদেশের জাতীয় দলের গোলকিপার আনিসুর রহমান জিকো এই লেখকের সঙ্গে কথা বলার সময়ে কল্পনার আশ্রয়ে এমনই এক ছবি এঁকেছেন। শুধু জিকো নন, সুনীলের নীল রঙে বুক ডোবাতে চাইবেন না, এমন দল দক্ষিণ এশিয়ায় কমই রয়েছে। ভারতের থেকে তিনি হয়ে যান বাংলাদেশের, আফগানিস্তানের, শ্রীলঙ্কার...।
সুনীল ছেত্রী একবুক বিশ্বাসের নাম। আকাশছোঁয়া এক স্পর্ধার নাম। ভৌগোলিক সীমারেখায় তাঁকে বেঁধে রাখা সম্ভবই নয়। তিনি গৃহস্থের গর্ব, পড়শির ঈর্ষা নন। তিনি এই উপমহাদেশের গর্ব।
এক নিঃশ্বাসে বাংলাদেশের গোলকিপার বলছিলেন, "সুনীল ছেত্রীকে খুব সামনে থেকে দেখেছি। গোটা দলকে সুনীলই মাঠে পরিচালনা করেন। মাঠের বাইরে কোচ যেরকম হন, মাঠের ভিতরে সুনীল ছেত্রীও সেরকমই একজন কোচ।"
এক সপ্তাহের বেশি সময় হয়ে গেল সুনীল ছেত্রী শেষ ম্যাচ খেলে ফেলেছেন কিন্তু সুনীল-আবেগে এখনও গোটা দেশ থরথর কম্পমান। তাঁর বিদায়ের শোক ছুঁয়ে গিয়েছে এশিয়ায়, এই উপমহাদেশে। কিংবদন্তি হিসেবে তিনি সমাদৃত এই দেশে। আবার অন্য দেশও তাঁকে কুর্নিশ জানায়। জিকো বলে চলেন, "সুনীল ছেত্রী খুবই শৃঙ্খলাপরায়ণ। হোটেলে খুব কাছ থেকে দেখেছি। দলকে অনুপ্রাণিত করেন। একজন লিজেন্ড হয়ে সবার সঙ্গে মিশে যাচ্ছেন। এরকম একজন ফুটবলারকেই তো চায় সবাই।"
আরও পড়ুন- এক ম্যাচে ৪৪ টা পেনাল্টি! ফুটবলের ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে আছে যে ম্যাচ…
জিকোর গলার আবেগ ধরা পড়েছিল ক্রোয়েশিয়ার কিংবদন্তি লুকা মদ্রিচের শ্বাসপ্রশ্বাসেও। ভারতের বনস্পতির বিদায়ের প্রাক্কালে যিনি সরাসরি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে বলে দিয়েছিলেন, "ইউ আর লিজেন্ড অফ দ্য গেম।"
ফুটবলার সুনীল ছেত্রী দেশ-কাল-সীমানা অতিক্রম করে যান এভাবেই। তিনি ছুঁয়ে যান অন্য দেশের হৃদয়ও। তাঁর হাসি-কান্না স্পর্শ করে অন্যদেরও।
বিদায়ী ভাষণ দিতে দিতে কেঁদেই ফেলেছিলেন সচিন তেণ্ডুলকর। কান্না বড় ছোঁয়াচে। সচিনের কান্নায় আমরাও কেঁদেছিলাম সেদিন। অবসর ঘোষণার সময়ে সুনীল ছেত্রী নিজে কাঁদেননি কিন্তু আমার মতো অনেকের চোখে জলের প্লাবন বইয়ে গেলেন। সচিন আর সুনীলের বিদায়ী ভাষণ কি একবিন্দুতে এসে মিলে গেল? হয়তো তাই। হয়তো নয়।
ভারতীয় ফুটবলে '৮৩ আসেনি। আসেনি ২০১১। ভারতীয় ফুটবল নেই-নেই-এর স্বর্গরাজ্য। দেশের ফুটবল তমসাচ্ছন্ন। কালো ব্যাকগ্রাউন্ডে সাদা রঙের ফুল স্লিভ পরে সুনীল যখন অবসরের কথা বলছেন, তখন মনে হচ্ছিল ভারত অধিনায়কই তো এই অন্ধকারে আলোর দিশারী ছিলেন এতদিন। তিনিই মিস্টার ইন্ডিয়া। তিনিই আবার বহির্জগতে দেশের অহংকার। তাঁর ফেয়ারওয়েল স্পিচ শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল সুনীল ছেত্রী ভারতীয় ফুটবলের সচিন তেণ্ডুলকর। তিনিই আবার দেশিয় ফুটবলের বিরাট কোহলি।
ভুল ভাবছিলাম। তাঁর পরিচয় তিনি নিজেই। সুনীল ছেত্রী আসলে প্রতিবাদ। সুনীল ছেত্রী বিপ্লব। ক্রিকেটের পেশি প্রদর্শনে অন্য খেলাগুলো যখন বিপথগামী, আলোর অভাবে অন্ধকারময়, তখন ভারত অধিনায়ক একাই বিশ্বমঞ্চে দেশের ফুটবলের পতাকাবাহক। তিনি আলো ছড়িয়ে দেন দেশের ফুটবলে। ফিফা কুর্নিশ জানায়। মেসি-রোনাল্ডোদের সঙ্গে একই আসনে বসিয়ে দেয় আমাদের সুনীলকে। অস্ট্রেলিয়ার সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়, তাঁর ইনস্টা ফলোয়ার ৭ মিলিয়নের বেশি কিন্তু তিনি ক্রিকেট খেলেন না। সুনীল ছেত্রী মানেই রেকর্ড। ১৫১টি ম্যাচে তাঁর গোলসংখ্যা ৯৪। প্রথম ম্যাচে গোল পেয়েছিলেন। তার পরে প্রতিটি মাইলস্টোনের ম্যাচেও গোল রয়েছে তাঁর। ব্যতিক্রম কেবল শেষ ম্যাচ। কুয়েতের বিরুদ্ধে শেষ ম্যাচটায় চোখে নামল জলের ধারা। সুনীলের সঙ্গে কাঁদছে গোটা যুবভারতী।
২০০৫ সালে অভিষেক তাঁর। প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে গোল ছিল। ১৯ বছর ধরে দেশের জার্সিতে জোয়াল টেনেছেন জাতীয় দলের। ২০০৭ সালের নেহরু কাপ জয়ী দলের সদস্য তিনি। ২০০৮ সালে এএফসি চ্যালেঞ্জ কাপের ফাইনালে হ্যাটট্রিক করেন সুনীল। ভারত চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল সেই টুর্নামেন্টে। আর সেই সূত্রেই এএফসি এশিয়ান কাপে খেলার ছাড়পত্র পায় ভারত। ২০১১ সালের এশিয়ান কাপে দু'টি গোল ছিল ভারত অধিনায়কের। সেই বছরের সাফে ৭টি গোল করেছিলেন সুনীল। ক্যামেরুনকে ফাইনালে হারিয়ে ভারত ২০১২ সালের নেহরু কাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। ২০১৭ সালে অন্য এক রেকর্ড ছোঁন তিনি। তাঁর নেতৃত্বে ১৩ ম্যাচ অপরাজিত ছিল ভারত। সেই বছরই এশিয়ান কাপের ছাড়পত্র পায় সুনীলের ভারত। পরের বছর ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপে চাইনিজ তাইপের বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক করেন সুনীল। ২০১৮ সালে দেশের জার্সিতে শততম ম্যাচ খেলেন কেনিয়ার বিরুদ্ধে। ২০১৯ সালের এশিয়ান কাপে থাইল্যান্ডের বিরুদ্ধে ২টি গোল করেন সুনীল। ২০২১ সালে লিও মেসিরই ৮০টি গোল ছুঁয়ে ফেলেন তিনি। ২০২২ সালে এশিয়ান কাপের যোগ্যতাপর্বের তৃতীয় রাউন্ডে সর্বোচ্চ গোলদাতা তিনিই।
ভারতের প্রাক্তন হয়ে যাওয়া অধিনায়ক অবশ্য এসব দেখে-শুনে হাত জোড় করে বিনয়ের হাসি দিয়েছেন কিন্তু সুনীল ছেত্রীকে উপেক্ষা করবে কে! কোহলি কি পারলেন? তিনিও তো সুনীলের বিদায়ী ভাষণ শুনে কমেন্ট বক্সে নিজের হৃদয় উপুড় করে দিলেন। বলছিলাম না, সুনীল ছেত্রী প্রতিবাদ, বিপ্লব। দুয়োরানি ফুটবলের প্রতিনিধি হয়েও সুয়োরানির নজর কেড়ে নেন। তিনি নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান। সুনীল ছেত্রীর জন্য দেশ আবেগমথিত। সুনীলের মনে পড়ছে, জাতীয় দলের জার্সি হাতে পেয়ে পারফিউম লাগানোর কথা।
আমিও সুনীল ছেত্রীকে দেখতে দেখতে ফিরে যাচ্ছিলাম ছায়াঘেরা স্মৃতির রাজ্যে। মনে পড়ে যাচ্ছিল বহু আগের ঘটনা। সুনীল তখন মোহনবাগানে। চোটের জন্য মাঠে নামতে পারছেন না। আই লিগের একটি ম্যাচে সুনীলের সঙ্গে মোহনবাগানের আরও তিন-চার জন ফুটবলার প্রেস বক্সে ঢুকে পড়লেন। প্রেস বক্সে বসে ওঁরা দলের খেলা দেখছিলেন।
ওই ম্যাচের প্রথমার্ধে খুব একটা ভাল খেলছিল না মোহনবাগান। সমর্থকরা অসন্তুষ্ট হচ্ছিলেন প্রিয় দলের বিবর্ণ খেলা দেখে। কয়েকজন সমর্থক বাইরে থেকে দেখে ফেললেন সুনীল ছেত্রীকে। দূর থেকেই শুরু হলো গালমন্দ। দল খারাপ খেলছে অথচ সুনীল ছেত্রী চোটের অজুহাতে প্রেস বক্সে বসে খেলা দেখছেন! সমর্থকদের সব রাগ গিয়ে পড়ল বেচারি সুনীলের উপরে। তখন যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনের পুরনো প্রেস বক্স। কাচের বাইরে থেকে কারও উদ্দেশ্যে কিছু ভেসে এলে শোনা যেত না। তবে সুনীল ছেত্রী সমর্থকদের অঙ্গভঙ্গি দেখে সব বুঝতে পারছিলেন। হঠাৎ ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। ওই অস্থির সমর্থকদের দিকে হাত দিয়ে ইশারা করে বলে উঠলেন, "চল অন্দর আ যা...।"
এক বর্ষীয়ান সাংবাদিক সুনীলকে ধমকে বলে উঠলেন, "সুনীল দিস ইজ প্রেস বক্স।" সুনীল থেমে গেলেন। খেলা শেষ হওয়ার কিছু আগে হনহন করে হেঁটে প্রেস বক্স ছাড়লেন। সুনীল ছেত্রী এখনও একই স্পিডে হাঁটেন। মাঠের ভিতরেও, বাইরেও। এখন সুনীলের সেই তারুণ্যের আগ্রাসনে জুড়েছে সম্ভ্রমের রাজমুকুট।
তখন ওডাফা মোহনবাগানে। স্বপ্নের টিম সবুজ-মেরুনের। সুনীলও সেই দলের সদস্য। বড় ম্যাচে ভরা যুবভারতী। ইস্টবেঙ্গলের কোচ মর্গ্যান। বিদেশি ধারাভাষ্যকার জো মরিসন এসেছেন কলকাতায়। আজকের গুরপ্রীত সিং ইস্টবেঙ্গলে। তাঁর উচ্চতা দেখে মুগ্ধ ধারাভাষ্যকার। বিজয় মাল্যর ছেলে সিদ্ধার্থ মাল্য কলকাতায় এসেছেন ডার্বি দেখতে। সুনীল ছেত্রী পেনাল্টি আদায় করে নিয়েছিলেন। লাল-হলুদের উগা ওপারা রেফারির সিদ্ধান্তে মাথায় হাত দিয়ে চিৎকার করছিলেন। ওপারা কি অবৈধ উপায়ে সুনীলকে ফেলে দিয়েছিলেন? একাধিক অ্যাঙ্গেলে রিপ্লে দেখালেও বোঝা যায়নি ফাউল হয়েছিল কিনা। পেনাল্টি থেকে গোল করেছিলেন ওডাফা। সুনীলের পেনাল্টি আদায় নিয়ে জোর চর্চা হয়েছিল। বিতর্কহীন নন। তবু তিনি বিতর্কের বিষাক্ত ছোঁয়াচ থেকে অনেক দূরের বাসিন্দা।
আরও পড়ুন- ফুটবলার না হোর্ডিং! জুতোর ফিতে বাঁধার নামে আসলে ব্র্যান্ড দেখাতেই চান খেলোয়াড়রা?
আই লিগে ডেম্পোর বিরুদ্ধে সুনীলকে খেলানো হলো মাঝমাঠে। তাঁর পাস থেকে ওডাফা গোল করেছিলেন। অনভ্যস্ত জায়গায় সুনীল ছেত্রী ফুল ফুটিয়েছিলেন। খেলার শেষে মাঠে শুয়ে পড়েছিলেন সুনীল। জোরে শ্বাস নিচ্ছিলেন। তাকিয়ে ছিলেন আকাশের দিকে। সেই আকাশ তিনি আজ নিজেই হয়ে উঠেছেন। ১৪০ কোটির দেশকে অসম্ভবের স্বপ্ন দেখিয়ে ভারতের ফুটবল আকাশে আজ তিনিই ধ্রুবতারা। উঠতি ফুটবলাররা বলতেই পারেন, "তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা।"
সুভাষ ভৌমিক ইস্টবেঙ্গলের দায়িত্ব নিয়েছেন সেই সময়ে। সে বড় সুখের সময় ছিল না লাল-হলুদের। মোহনবাগানের কাছে হারতে হারতে আত্মবিশ্বাস তলানিতে ঠেকেছিল ইস্টবেঙ্গলের। চোদ্দো বছর আগের এক ডার্বির প্রেক্ষাপট ছিল এমনই। ইতিহাসের চাকা ঘুরিয়ে ছিলেন সুভাষ। ইস্টবেঙ্গল ৩-০ গোলে হারিয়েছিল চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীকে। নবি দুটো গোল করেছিলেন। সুনীল ছেত্রী একটা। সেটাও নবিরই পাস থেকে। গোল করেই এক ছুটে নবির কোলে সুনীল। আঙুল উঁচিয়ে নবিকে বলছিলেন হয়তো, "ভাই এটা তোরই গোল।"
সুনীল ছেত্রী তরতরিয়ে ইংরেজি বলেন। কলকাতার সাংবাদিকদের সঙ্গে বাংলায় কথা বলেন। তাঁর মুখ দিয়ে বিতর্কিত কথা বলানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, তা আগেভাগে ধরে ফেলতেন সুনীল। ঠান্ডা চাহনি দিতেন। এড়িয়ে যেতেন প্রশ্ন। ততদিনে ভারতের অধিনায়ক তিনি। রোনাল্ডোর স্মৃতিজড়িত ক্লাবে চলে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে দেশে ফিরেছেন। ২০১২ সালের নেহরু কাপে অন্য এক সুনীল ছেত্রীকে দেখা গেল। এই সুনীল অনেক পরিণত।
ফাইনালে এক গোলে পিছিয়ে ভারত। মাঝমাঠ থেকে আলগা একটা বল ধরে শুরু করলেন দৌড়। কেউ বললেন, "জীবনের দৌড়।" কেউ আবার বললেন,"জীবন বাঁচানোর দৌড়।" ক্যামেরুনের সুগঠিত চেহারার ফুটবলাররা ধাওয়া করছেন সুনীলকে। খর্বকায় সুনীলকে রোখে কার সাধ্যি! পেনাল্টি বক্সের ভিতরে ফেলে দেওয়া হলো সুনীলকে।
"পে-না-ল্টি", সমস্বরে চিৎকার করে উঠল গ্যালারি। পেনাল্টি নিলেন সুনীল। বেশ কিছুটা দৌড়ে নিলেন শট। বল ক্যামেরুনের জালে। টাইব্রেকারে জিতে নেহরু কাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ভারত।
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একই ম্যাচে বাঁ পা, ডান পায়ে দুটো গোল করেছিলেন। দেশের এক নামজাদা ফুটবল লিখিয়ে বলেছিলেন, "একই ম্যাচে ডান পা, বাঁ পায়ে গোল করছে কোনও ভারতীয় স্ট্রাইকার, তা সচরাচর দেখা যায় না।" খুব দ্রুত কথা বলেন সুনীল। বল পায়ে দৌড়ের মতোই। পেনাল্টি স্পট থেকে গোললাইন পৃথিবীর রহস্যময় সরণী। সেই সরণীতে পথ হারিয়েছেন অনেকে। সুনীল সেই পথে আলো ছড়িয়ে গেলেন। এক স্টেপে পেনাল্টি নিতেন। গোলকিপার বলের নাগাল পেতেন না।
আরও পড়ুন- কলকাতা ফুটবলের দুয়োরানি মহামেডান স্পোর্টিং
ইউনাইটেড স্পোর্টসের এক কর্তা বলছিলেন, সুনীল ছেত্রী পুরোদস্তুর পেশাদার। নইলে এত বছর টিকেই থাকতে পারত না। গল্প বলছিলেন তিনি। ফিরে যাচ্ছিলেন বেঙ্গালুরু-ইউনাইটেড স্পোর্টস ম্যাচে। "কল্যাণীতে খেলা। সুনীল কড়া একটা ট্যাকল করে বসল রফিককে। আমাদের ক্যাপ্টেন দীপক মণ্ডল মাটিতে শুয়ে কাতরানো রফিককে গালাগাল দিয়ে বলছে, ওঠ, উঠে দাঁড়া। পরের মুহূর্তে রফিক সর্বশক্তি দিয়ে সুনীলকে পাল্টা ট্যাকল করে বসল। সুনীল তখন ভারত অধিনায়ক। মাটি থেকে উঠে দীপকের দিকে তাকিয়ে সুনীল বলল, দাদা তুম শুধরোগে নেহি।"
সেই কর্তা বলে চলেন, "এটাই সুনীল ছেত্রী। দীপক সেদিন রফিককে জীবনের শিক্ষা দিয়েছিল, খেলার মাঠে কেউ কাউকে ছেড়ে দেয় না। সুনীল ছেত্রীও সেই শিক্ষাকেই সমর্থন করে গেলেন।"
গর্ব করে দেশের মানুষ এখন বলছেন, "আমাদেরও একজন সুনীল ছেত্রী ছিলেন।" আমার মতো অনেকেরই গর্ব হবে এই ভেবে, জীবদ্দশাতেই এক সাধারণ ছেলেকে কিংবদন্তি হয়ে উঠতে দেখেছি। নেই মেসির মতো সম্মোহন করার মতো বাঁ পা। আবার রোনাল্ডোর মতো মায়াবী ফুটবলও খেলেন না তিনি। লেওয়ানডস্কি-লুকাকুদের মতো তছনছ করে দেওয়ার ধারেকাছেও তিনি নেই। তবু খর্বাকৃতি সেই সুনীল আজ মেসি-রোনাল্ডোদের সঙ্গেই একই ব্র্যাকেটে, একই নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হন। কী ছিল সুনীলের?
জিকো বলছিলেন, "ও আসলে বক্স স্ট্রাইকার। গোলের গন্ধ ওঁর রক্তে। আক্রমণে ওঠার সময় সতীর্থদের নির্দেশ দেন ওয়ান টাচ-টু টাচে খেলার। ও এখানেই অনন্য।" সুনীলের হাতেই থাকত দলের রিমোট কন্ট্রোল।
সুনীলের ফুটবলের প্রভাত থেকে পড়ন্ত বেলার সৌন্দর্য উপভোগ করার অভিজ্ঞতা হয়েছে অনেকেরই। দিনের পথিক মনে রেখো, আমি চলেছিলেম রাতে সন্ধ্যাপ্রদীপ নিয়ে হাতে... এ গান হোক সুনীলেরই।