সেদিনের সেই ভেবলে যাওয়া রেডিও জকির গলাতেই শেষপর্যন্ত মালা দেন নার্গিস...

Nargis, Sunil Dutt's Love Story: এই যে দেখা হয়ে যাওয়া, এই যে চিরন্তন প্রেম, একেও যদি টেলিপ্যাথির জোর না বলবেন, তো কাকে বলবেন। আসলে শুধুই সিনেমায় নয়, এমন স্বপ্ন মাঝেমধ্যেই সত্যি হয়ে যায় বাস্তবেও।

গল্পের নায়ক সাদামাটা। সদ্যচাকরিতে ঢোকা এক তরুণ। অন্যদিকে, নায়িকা বলিউডের অন্যতম নক্ষত্র। যার ডাইহার্ড ফ্যান ছিলেন কিনা এক ছাপোষা রেডিও জকি। পেশার খাতিরেই এসেছিল প্রথম সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ। সেদিন কে-ই বা জানত, বলিউডের অন্যতম পাওয়ার কাপলদের তালিকায় ঢুকে পড়তে চলেছে সেদিনের সেই রেডিও জকির নাম। বেশ কয়েক বছর পরে সেই অভিনেত্রীর গলায় মালা দিয়েছিলেন সেদিনের সেই ছোকরা। আসলে এমন অবাস্তব কাণ্ডকারখানা সিনেমার বাইরেও ঘটে। সেসব দেখেশুনে ফেলুদাও নির্ঘাত চিৎকার করে বলে বসবেন, 'টেলিপ্যাথির জোর আছে।' টেলিপ্যাথির জোরই বলুন বা নিয়তি, এমন সব রূপকথা ঘটে বলেই বোধহয় আজও গোগ্রাসে প্রেমের গল্প পড়ে মানুষ। বিশ্বাস করে ম্যাজিকে।

আরও পড়ুন: “মওত মুবারক হো মীনা”, প্রিয় বন্ধুর মৃত্যুতে কেন শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন নার্গিস?

সদ্য একটি রেডিও স্টেশনের চাকরিকে ঢুকেছেন তখন তরুণ। ইতিমধ্যে একটি শো-র শিকেও ছিঁড়েছে ভাগ্যে। মোটামুটি চলছে সেই শো। এমন সময় একদিন সুযোগ এল জনপ্রিয় এক অভিনেত্রীর সাক্ষাৎকার নেওয়ার। নাম শুনেই লাফিয়ে উঠলেন তরুণ । স্বপ্নের নায়িকার সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ, কেরিয়ারের প্রথমেই ক'জনের কপালেই বা জোটে।

সেসময় রেডিও সাইক্লোন ছিল বেতার দুনিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় নাম। শুধুমাত্র হিন্দি সিনেমার গান বাজাত স্টেশনটি। সেখানে 'লাক্স কে সিতারে' নামে একটি শো পরিচালনা করতেন সেদিনের সেই যুবক। তা-ও আবার ছদ্মনামে। বলরাজের সঙ্গে ওই শো শুনতে ক্রমশ উন্মুখ দর্শক। ইতিমধ্যে জনপ্রিয় অভিনেত্রী নার্গিসের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ এল তাঁর কাছে। নির্ধারিত দিনে যথাসময়ে স্টুডিওয় এসে পৌঁছলেন লাবণ্যময়ী নার্গিস। ততদিনে তিনি শুধু রেডিও জকি তরুণেরই নন, দেশের বহু তরুণেরই স্বপ্নের নায়িকা।

যাঁকে দেখবেন, যাঁর সঙ্গে কথা বলবেন বলে পেটের ভিতরে প্রজাপতিরা ডানা মেলেছিল..কী আশ্চর্য! সেই স্বপ্নের সেই নায়িকাকে দেখে মুখে কথা সরল না যুবকের। ডাই হার্ড ফ্যান বলে কথা। সেদিন ফ্যালফ্যাল করে শুধু তাকিয়েই রইলেন। তারপর যা হওয়ার তাই হল। বাতিল হয়ে গেল সেই ইন্টারভিউ।

এরপর কী হয়েছিল সেই তরুণ রেডিও জকির? রেডিওর চাকরিটি বাঁচানো গিয়েছিল কিনা জানা নেই, তবে অচিরেই ভাগ্য পরীক্ষা করতে সিনেমায় নামলেন সেই যুবক। প্রথম ছবি তেমন সাফল্য পায়নি। তবে দ্বিতীয় ছবির সেটেই বোধহয় ভাগ্যদেবতা তাঁর লেখনী হাতে অপেক্ষা করছিলেন। সেখানে অবশ্য তাঁরা ছিলেন তাঁরা মা-ছেলের ভূমিকায়। আর ওই মাদার ইন্ডিয়ার সেটেই ঘটে গিয়েছিল ভয়ঙ্কর একটি অগ্নিকাণ্ড। কীভাবে যেন সেই আগুনের মধ্যে আটকে পড়লেন অভিনেত্রী। স্বপ্নের নায়িকা বিপদে, নায়ক ছুটে যাবে না, তাই আবার হয় নাকি! ঝুঁকি নিয়ে আগুনের ভিতর ঢুকে অভিনেত্রী নার্গিসকে উদ্ধার করে আনলেন অভিনেতা। নিজে অনেকটা পুড়ে গেলেও অভিনেত্রীর গায়ে আঁচটুকু আসতে দিলেন না।

এত কিছুর পরেও কি ভাল না-বেসে থাকা যায়! পারলেন না নার্গিস। হাসপাতালে দিনরাত সেবা করে সুস্থ করে তুললেন সেই মানুষটিকে। তখনও কি অভিনেত্রী জানতেন নাকি, সেই তার বাঁধা হয়ে গিয়েছিল অনেক দিন আগেই, একটি রেডিও স্টেশনের রেকর্ডিং স্টুডিয়োয়। যেখানে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে প্রশ্ন ভুলে যাওয়া এক রেডিও জকির সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল তাঁর। তবে এমন কত সাক্ষাৎকারই তো তাবড় অভিনেত্রীরা দিয়ে থাকেন। অত কি মনে থাকে, না মনে রাখা যায়! তবে ভোলেননি সেদিনের সেই রেডিও জকি। অভিনেত্রীকে মন দিয়েছিলেন সেদিনই, কিংবা হয়তো আরও আগে, পর্দায় নার্গিসকে দেখেই।

এদিকে নার্গিস ততদিনে যথেষ্ট বড় অভিনেত্রী। বলিউডে তার প্রচুর নামডাক। স্বাভাবিক ভাবেই সেদিনের সেই ফ্যানটিকে মনে রাখেননি তিনি। তার পরে কেটে গিয়েছে অনেকগুলো বছর। ততদিনে পর্দায় পা রেখেছেন আরেক সুদর্শন যুবক। বলরাজ দত্ত নাম ছেড়ে হয়ে উঠেছেন বলিউড তারকা সুনীল দত্ত। ১৯৫৫ সালে রেলওয়ে প্ল্যাটফর্ম নামে একটি সিনেমা দিয়ে আত্মপ্রকাশ তাঁর। প্রথম ছবি দিয়েই নজর কেড়েছিলেন সুনীল। সেই সুনীল, যার কেরিয়ার একদিন শুরু হয়েছিল রেডিওর হাত ধরে। ততদিনে নার্গিসের কেরিয়ার মধ্যগগনে। না, বয়সের বিশেষ তফাৎ তাদের ছিল না। দু'জনেই জন্মেছিলেন ১৯২৯ সালের জুন মাসে। মাত্র পাঁচ দিনের তফাতে। তবে মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই সিনেমায় হাতেখড়ি নার্গিসের। তার পর একের পর এক ছবিতে অভিনয়। আর সেভাবেই বড় হয়ে ওঠা।

আরও পড়ুন: বাইজি গলি থেকে মুম্বই শাসন! ভারতের প্রথম দুই মহিলা সুরকারকে ভুলেছে সিনেমা

এই এতগুলো বছরের তফাতে হঠাৎই ১৯৫৭ সালে 'মাদার ইন্ডিয়া'-র সেটে দেখা হয়ে গেল দুজনের। পরিচালক মেহেবুব খান দুই গুনী শিল্পীকে নিয়ে এলেন এক ছাদের তলায়। যদিও সেখানে তাঁরা মা ও ছেলের ভূমিকায়। এই ছবিটি সুনীল দত্তের জীবনে সব দিক থেকে উল্লেখযোগ্য। কেরিয়ারের দিক থেকে তো বটেই, ব্যক্তিগত জীবনের দিক থেকেও মাইলস্টোন এই ছবি। নার্গিস আর রাজ কপূর তখন বোধহয় বম্বের সবচেয়ে হিট জুটি। নার্গিস-রাজের সম্পর্ক নিয়েও কম কানাঘুষো ছিল না। তবে সেসব কিছু তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল এক চিরন্তন প্রেমের আবেদনের সামনে। তাই শেষপর্যন্ত সেই মানুষটির গলাতেই মালা দিয়েছিলেন প্রখ্যাত নায়িকা।

বলিউড পেয়েছিল তার অন্যতম পাওয়ার-কাপলকে। যাদের প্রেম আজও এক রূপকথা। যে রূপকথার শুরু হয়েছিল এক রেডিওস্টেশনের স্টুডিওয়, ভেবলে যাওয়া এক অখ্যাত রেডিওজকিকে সঙ্গে নিয়ে। জীবনের শেষমুহূর্ত পর্যন্ত সেই প্রেমে ঘাটতি পড়েনি এতটুকু। এই যে দেখা হয়ে যাওয়া, এই যে চিরন্তন প্রেম, একেও যদি টেলিপ্যাথির জোর না বলবেন, তো কাকে বলবেন। আসলে শুধুই সিনেমায় নয়, এমন স্বপ্ন মাঝেমধ্যেই সত্যি হয়ে যায় বাস্তবেও। যেমন হয়েছিল নার্গিস-সুনীলের জীবনে। আর বাকিটা... ইতিহাস!

More Articles