ফের ফিরছে মনোরমার স্মৃতি! এ কোন অন্ধকার গাঢ় হচ্ছে মণিপুরে?
Manipur Violence: সম্প্রতি ভাইরাল হয়ে গিয়েছে, মণিপুরের দুই মহিলাকে নগ্ন করে হাঁটানোর ভিডিও। হিংসার এমন ভয়ঙ্কর রূপ দেখে আতঙ্কে কেঁপে উঠেছে গোটা দেশ।
জাতিহিংসা কি তালিবান শাসনের চেয়েও ভয়ঙ্কর! অন্তত মণিপুরের বর্তমান পরিস্থিতি দেখে এমনটাই মালুম হচ্ছে। গত কয়েকমাস ধরেই জ্বলছে মণিপুর। মৃত্যুর পর মৃত্যু, হিংসার পর হিংসা, তার বদলা নিতে গণধর্ষণ থেকে প্রকাশ্যে মেয়েদের নগ্ন করে হাঁটানো, কী হচ্ছে না সেখানে! আর সেই হিংসার কাঁধে চেপেই বেশ কিছু দিন ধরে খবরের শিরোনামে উত্তর-পূর্বের ছোট্ট রাজ্যটি। সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে এমনই এক ভিডিও। যেখানে জোর করে নগ্ন অবস্থায় জনসমক্ষে হাঁটতে বাধ্য করা হয়েছে দুই মণিপুর কন্যাকে। আর সেই ভিডিও ছড়ানোর পরেই উত্তাল দেশ। জাতি হিংসার নামে যা প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে মণিপুরে, যা কার্যত মানবতার লজ্জা। মে মাসের গোড়া থেকেই সামনে এসেছে একের পর এক হিংসার ঘটনা। শুধু খুনখারাপিই নয়, ছোট্ট রাজ্যটিতে যে ভাবে মেয়েদের উপর অত্যাচার বেড়েছে, তা বোধহয় সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের।
এ ছবি অবশ্য নতুন কিছু নয় মাতৃতান্ত্রিক মণিপুরে। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের ঘটনা সেটা। বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার দূরে গুলিতে ঝাঁঝড়া হয়ে পড়েছিল ক্ষতবিক্ষত একটি মেয়ের দেহ। একবার নয়, একাধিক বার গুলি চালানোর আগে সেই শরীর হয়ে উঠেছিল সেনাবাহিনীর লালসা চরিতার্থ করার ক্যানভাস। চলে নির্বিচার গণধর্ষণ। তাঁকে ছিঁড়েকুটে রক্তাক্ত করে সেদিন ক্ষমতার আস্ফালন দেখিয়েছিল ভারতীয় সেনা। ২০০৪ সালে সেই ঘটনার প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিল মণিপুর। আসাম রাইফেলসের সদর দফতরে হেঁটে গিয়েছিল তিরিশ জন মধ্যবয়স্কা। নিজেদের পরিচয় দিয়েছিলেন 'মনোরমার মা' বলে। চিৎকার করে বলেছিল, 'ভারতীয় সেনাবাহিনী, আমাদের ধর্ষণ করো।' সেই ছবিই কি ফের ফিরছে মণিপুরে? জাতি হিংসার নামে রাস্তা জুড়ে নগ্ন করে হাঁটানো হল দুই নারীকে। হ্যাঁ, ২০২৩ সালে দাঁড়িয়ে। চলল ধর্ষণ, অকথ্য অত্যাচার। মৌন দেশ। অন্তত এতদিন মৌনই ছিল।
আরও পড়ুন: কয়েকশো বছর আগেই লুকিয়েছিল হিংসার বীজ! মণিপুর আদৌ কোনওদিন শান্ত হবে?
দীর্ঘকাল তালিবানদের নিয়ন্ত্রণে ছিল আফগানিস্তান। মাঝখানে কয়েক বছর স্বস্তি ফিরলেও ফের তালিবান দখল নিয়েছে দেশটির। স্বাভাবিক ভাবেই তালিবান-কবলে ভালো নেই আফগানিস্তানবাসী। একের পর এক বিধিনিষেধ আরোপ হচ্ছে সে দেশের মেয়েদের উপরে। ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে অধিকার। তবে তার চেয়েও ভয়ঙ্কর অবস্থা এখন মণিপুরের মেয়েদের। মেয়েদের শরীর যেন প্রতিহিংসা প্রকাশের অন্যতম ক্যানভাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। যখন তখন বাড়ি থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মেয়েদের। চলছে অবাধ গণধর্ষণ, নিপীড়ন। এমনকী একদল লোকের সামনে সম্পূর্ণ নগ্ন করে ঘোরানো হচ্ছে তাঁদের। সেইসব ভিডিও ছড়িয়ে পড়ছে সোশ্য়াল মিডিয়ায়। গোটা বিশ্ব দেখছে ভারতের একটি রাজ্যের বেআব্রু হিংসার রূপ। নারী নির্যাতনের ভয়াবহ চেহারা।
প্রশাসন নির্বিকার, চুপ সরকার। সম্প্রতি ভাইরাল হয়ে গিয়েছে, মণিপুরের দুই মহিলাকে নগ্ন করে হাঁটানোর ভিডিও। হিংসার এমন ভয়ঙ্কর রূপ দেখে আতঙ্কে কেঁপে উঠেছে গোটা দেশ। ভিডিও ছড়াতেই টনক নড়েছে সরকারের। সবার প্রথমেই ঘটনার তীব্র নিন্দা করে বিবৃতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। নড়়েচড়ে বসেছে সুপ্রিম কোর্ট। মণিপুরের পরিস্থিতি নিয়ে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার কী পদক্ষেপ করেছে, তা জানতে চেয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। ঘটনায় কেন্দ্র ও মণিপুর সরকারের রিপোর্ট তলব করেছে প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চ। অবিলম্বে মণিপুরের ওই ঘটনার ভিডিওটি সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে টুইটার কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু ভিডিও সরিয়ে নিলেই কি এই লজ্জার থেকে মুক্তি। নাকি কোনওদিন শান্তি ফিরবে মণিপুরে?
যতদূর জানা যাচ্ছে, ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি তোলা হয়েছিল মে মাসের চার তারিখ নাগাদ। ঠিক সে সময়টায় জাতি হিংসার নামে উত্তাল হয়ে উঠেছিল রাজ্যটি। থৌবল জেলার নংপোক সেকমাই থানার কাছে ওই ঘটনাটি ঘটে বলে অভিযোগ। কেউ কেউ আবার দাবি করেছে, আদতে কঙ্গপকপি জেলার ঘটনা এটি। পুলিশের কাছে দায়ের হয়েছিল অভিযোগও। তবে না। কোনও রকম পদক্ষেপ করার কথা ভাবেনি প্রশাসন। কীভাবে খুনের ভয় দেখিয়ে ওই দুই মহিলাকে জনসমক্ষে পোশাক খুলতে বাধ্য করা হয়েছিল, সে কথা পুলিশকে জানিয়েছিলেন নির্যাতিতাদের একজন। গত ১৮ মে ওই জেলারই সাইকুল থানায় দায়ের হয়েছিল জিরো এফআইআর। যাতে পদক্ষেপের ক্ষেত্রে কোনও অসুবিধা না হয়। তার পরেও পুলিশের হাতে থেকেছে শুধু পেনসিল। অবস্থার বদল তো দূরের, আরও বেশি খারাপ হয়েছে মণিপুরের পরিস্থিতি। ইতিমধ্যেই মণিপুর হিংসায় প্রাণ গিয়েছে ১৪২ জনের। জখম বহু। ঘরছাড়া বহু মানুষ। তবে ভিডিও ভাইরাল হতেই রাতারাতি ওই ঘটনায় একজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
কুকি ও মেইতেই, মণিপুরে বসবাসকারী দুই গোষ্ঠীর মধ্যে লড়াই। এই 'তুই না মুই'-এর চক্করে লাটে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা। কিছুদিন আগেই ভাইরাল হওয়া একটি ছবি ঘিরে তুঙ্গে পৌঁছয় দুই গোষ্ঠীর লড়াই। প্লাস্টিক পেঁচানো একটি মেয়ের মৃতদেহের ছবিটি ঘিরে ফের হিংসায় জড়িয়ে পড়ে মেইতেই ও কুকিরা। কুকি সম্প্রদায়ের মেয়েদের ঘর থেকে টেনে এনে গণধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। ছড়িয়ে পড়ে হিংসা। উত্তাল হয়ে ওঠে মণিপুর। পরে অবশ্য জানা যায়, ছবিটি আদতে মণিপুরেরই নয়। বরং দিল্লির একটি অন্য খুনের ঘটনার মৃতদেহ সেটি।
গত মাস তিনেক ধরে মণিপুরে একই অবস্থা চলছে। অথচ এ নিয়ে কোনও অবস্থান নেয়নি রাজ্য কিংবা কেন্দ্র সরকার। অথচ জনসমক্ষে নগ্ন নারীদের উপর নির্যাতনের ছবি ভাইরাল হতেই নড়েচড়ে উঠল দেশ। এতদিন বাদে সরকারের মনে হল, মণিপুরে যা হচ্ছে, যা হয়ে চলেছে, তা আদৌ কোনও সুস্থ দেশে ঘটতে পারে না। এমনকী স্বতঃপ্রণদিত হয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও এতদিন বাদে বলল সুপ্রিম কোর্ট। একে কী বলা যায়? বিশ্বের সামনে মান যাওয়ার ভয় না অন্য কিছু? এতদিন কি চোখ বুজেছিল সংবিধানের রক্ষকেরা। প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় এদিন বলেছেন, মহিলাদের যেভাবে হিংসার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে তা লজ্জার। মণিপুরে যা চলছে, তা সাংবিধানিক ব্যবস্থার ব্যর্থতা। মণিপুরবাসীর সাংবিধানিত অধিকার যে নিয়ত লঙ্ঘিত হয়ে চলেছে তা নিয়ে পদক্ষেপ করার সময় এসেছে। ওই মামলার পরবর্তী শুনানি ২৮ জুলাই, জানিয়ে দিয়েছে শীর্ষ আদালত।
একই সুর শোনা গিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর গলাতেও। তিনি বলেছেন, 'মণিপুরে যা ঘটছে, তা যে কোনও সভ্য সমাজের পক্ষে লজ্জাজনক।' জানিয়েছেন, মণিপুরের বোনেদের সঙ্গে যা ঘটেছে, তা ক্ষমার অযোগ্য। এদিকে, এর আগে একাধিক বার দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আবেদন করা হয়েছে মণিপুরে শান্তি ফেরানোর দাবিতে। এমনকী হিংসায় নিহতদের যাতে নূন্যতম সম্মানটুকু দেওয়া হয়, সেই দাবি করে অমিত শাহের দ্বারস্থ হয়েছিল ন্যাশনাল ফেডারেশন অব ইন্ডিয়া উওমেনের তরফে। মণিপুরের মর্গ জুড়ে সারি সারি জমে থাকা বেওয়ারিশ লাশ, অথচ তাদের পরিচয় জানার উপায়টুকুও নেই। তাদের যথাযোগ্য অন্ত্যেষ্টির জন্য দাবি করা হয়েছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ। তবে তিমির কাটেনি।
আরও পড়ুন: কাশ্মীর থেকে মণিপুর, ক্ষমতার হাতিয়ার যখন ‘ধর্ষণ’
এতদিনে এ বিষয়ে অবস্থান নেওয়ার কথা ভেবেছেন বিজেপিশাসিত মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং। জানিয়েছেন, নারী নির্যাতনে অভিযুক্তদের কড়া শাস্তি দেওয়া হবে। কেন এতদিন সেই অবস্থান নেননি মুখ্যমন্ত্রী! তার উত্তর অবশ্য অজানা নয়। দলের শীর্ষনেতৃত্ব যতক্ষণ না মাথা নাড়াচ্ছেন, ছোট চারাগাছেরা আর কী-ই বা করতে পারে।
আদৌ কি এর পরেও পরিস্থিতি বদলাবে। শান্তি ফিরবে মণিপুরে। সুপ্রিম কোর্ট কি আদৌ পদক্ষেপ করবে এ বিষয়ে? নাকি সমস্ত বিষয়ের মতোই লোকসভা ভোট, বাদল অধিবেশন আরও নানা রাজনৈতিক কর্মসূচীর ভিড়ে ধামাচাপা পড়ে যাবে ছোট্ট রাজ্য মণিপুর। আর ছাইচাপা আগুন জ্বলতেই থাকবে রাজ্যটিতে। যা যে কোনও দিন একটি ফুলকিতেই ফের হয়ে উঠবে জঙ্গল কে জঙ্গল মুহূর্তে গ্রাস করে ফেলা ভয়ঙ্কর দাবানল। ফের মানুষ হয়ে উঠবে সস্তা... যাকে দিব্যি কেটে ছড়িয়ে দেওয়াই যায় সময় সুযোগ বুঝে।