মাদ্রাসা শিক্ষায় সিলমোহর, কেন হাইকোর্টকে চ্যালেঞ্জ করল শীর্ষ আদালত?
Madarsa Education Act 2004: মঙ্গলবার ইলাহাবাদ হাইকোর্টের সেই রায়কে খারিজ করে দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট পরিষ্কার জানিয়ে দিল, উত্তরপ্রদেশের মাদ্রাসা শিক্ষা আইন সম্পূর্ণ বৈধ এবং সাংবিধানিক।
মাদ্রাসার শিক্ষা আইন সাংবিধানিক কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল যোগীরাজ্যে। এমনকী সেই মামলা গড়ায় আদালত পর্যন্ত। ইলাহাবাদ হাইকোর্ট সেই শিক্ষা আইনকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে তা বাতিল করার নির্দেশ দেয়। তবে সুপ্রিম কোর্টে ধাক্কা খেল হাইকোর্টের সেই রায়। মঙ্গলবার ইলাহাবাদ হাইকোর্টের সেই রায়কে খারিজ করে দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট পরিষ্কার জানিয়ে দিল, উত্তরপ্রদেশের মাদ্রাসা শিক্ষা আইন সম্পূর্ণ বৈধ এবং সাংবিধানিক। সুপ্রিম কোর্টের মঙ্গলবারের রায়ে কার্যত স্বস্তি মিলল উত্তরপ্রদেশের মাদ্রাসায় পঠনপাঠনরত অন্তত ১৭ লক্ষ পড়ুয়ার।
সে সময় উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতায় সমাজবাদী পার্টি। ২০০৪ সাল নাগাদ উত্তরপ্রদেশ মাদ্রাসা বোর্ড শিক্ষা আইন কার্যকর করে মুলায়ম সিং যাদব সরকার। তার পর দেশে সরকার বদলেছে। বদলেছে হাওয়াও। বিজেপি জমানা মুসলিম বিরোধীতার তেজে একের পর এক জায়গার মুসলিমগন্ধী নাম বদলে দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন তোলা হয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষা আইন নিয়েও। সূত্রের খবর, যোগী আদিত্যনাথ সরকারে আসার পরই রাজ্যের মাদ্রাসাগুলি নিয়ে এক সমীক্ষা শুরু করে। মাদ্রাসাগুলিতে কোনও বিদেশি অনুদান আসছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সমীক্ষা করে। একই সঙ্গে রাজ্য সরকার মাদ্রাসা শিক্ষাকে ‘মূল শিক্ষাব্যবস্থা’র অন্তর্ভুক্ত করার কাজও করে। মাদ্রাসার সিলেবাস বদলেও উদ্যোগ নেয় শিক্ষা বিভাগ। সেই আবহেই মাদ্রাসা শিক্ষা আইনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ইলাহাবাদ হাই কোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়।
আরও পড়ুন: মাদ্রাসা ভাঙা নিয়ে তুঙ্গে অশান্তি! যেভাবে উত্তাপ বাড়ছে দেবভূমি উত্তরাখণ্ডে
কী রয়েছে এই মাদ্রাসা আইনে? ২০০৪ সালে প্রণীত এই আইনটির লক্ষ্য উত্তরপ্রগেশ রাজ্যে মাদ্রাসা (ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান)-এর কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা। পাশাপাশি উত্তরপ্রদেশ জুড়ে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা, সেগুলির পাঠ্যক্রম ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণকে একটি কাঠামো দিয়েছে আইন। এর উদ্দেশ্য ছিল মাদ্রাসা শিক্ষার প্রচার ও প্রসার। এতে আরবি, উর্দু, ফারসি, ইসলামিক স্টাডিজ, দর্শনের মতো বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছিল। এই আইনের অধীনে রাজ্যের মাদ্রাসার কার্যক্রম তত্ত্বাবধান ও তদারকির জন্য তৈরি হয়েছিল উত্তরপ্রদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডও। সেই আইনকেই গত ২২ মার্চ বেআইনি ঘোষণা করে দেয় ইলাহাবাদ হাইকোর্ট।
মাদ্রাসা বোর্ড আইনের বিরুদ্ধে ইলাহাবাদ হাইকোর্টে পিটিশন দায়ের করেছিলেন আংশুমান সিং রাঠোর নামে এক ব্যক্তি। রাঠোর এই আইনের সাংবিধানিক বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। গত মার্চ মাসে আবেদনকারীর আবেদনে সাড়া দেয় হাইকোর্ট। সেখানেই মাদ্রাসা শিক্ষা আইনকে ‘অসাংবিধানিক এবং ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের পরিপন্থী’ বলে তা বাতিলের নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। হাইকোর্ট বলেছিল, 'ইউপি বোর্ড অফ মাদ্রাসা শিক্ষা আইন ২০০৪ অসাংবিধানিক এবং ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি লঙ্ঘন করেছে।' পাশাপাশি রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল মাদ্রাসায় অধ্যয়নরত শিশুদের সাধারণ স্কুলিং ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করার। কিন্তু সেখানেই থামেনি মামলার জল। হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে ফের মামলা হয়।
হাইকোর্টের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিল আঞ্জুম কাদরি, ম্যানেজার অ্যাসোসিয়েশন মাদারিস আরাবিয়া (ইউপি) , অল ইন্ডিয়া টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন মাদারিস আরাবিয়া (নয়া দিল্লি), ম্যানেজার অ্যাসোসিয়েশন আরবি মাদ্রাসা নতুন বাজার এবং শিক্ষক অ্যাসোসিয়েশন মাদারিস আরাবিয়া কানপুর। দু'দিনের শুনানির সময়, আবেদনকারীরা যুক্তি দিয়েছিলেন যে হাইকোর্ট ইউপি মাদ্রাসা আইনের উদ্দেশ্যটি ভুলভাবে বুঝেছে যে আসল উদ্দেশ্যটি দেখার পরিবর্তে ধর্মীয় নির্দেশনা দেওয়া। উল্টোদিকে আইনের বিরোধিতাকারীদের পাশাপাশি জাতীয় শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশন (এনসিপিসিআর) জোর দিয়েছিল যে মাদ্রাসা শিক্ষা সংবিধানের ২১এ অনুচ্ছেদের অধীনে মানসম্পন্ন শিক্ষার প্রতিশ্রুতি উপেক্ষা করেছে। ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণের স্বাধীনতা থাকলেও মূলধারার শিক্ষার বিকল্প হিসেবে তা গ্রহণ করা যায় না।
মঙ্গলবার মামলাটি ওঠে মামলা ওঠে বিচার জে বি পর্দিওয়ালা, মনোজ মিশ্রা এবং প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চে। যেখানে খারিজ হয়ে যায় গত ২২ মার্চের এলাহাবাদ হাই কোর্টের রায়। রায় দেওয়ার সময় প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ জানায়, আদালত মাদ্রাসা শিক্ষা আইনের বৈধতা বহাল রাখছে। এই আইন সাংবিধানিক। ইলাহাবাদ হাই কোর্ট রায় দেওয়ার সময় আইনের মৌলিক কাঠামোগত ত্রুটির কথা বলেছিল। তা ভুল ছিল। এই আইন মাদ্রাসা প্রশাসনে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে না বলেও জানায় তিন বিচারপতির বেঞ্চ। সুপ্রিম কোর্ট রায়দানের সময় আরও জানায়, মাদ্রাসা আইনে কিছু ধর্মীয় প্রশিক্ষণ অন্তর্ভুক্ত থাকায়, তা অসাংবিধানিক হতে পারে না।
তবে দেশের সুপ্রিম কোর্টের তরফে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, এই আইনের অধীনে ‘ফাজ়িল’ এবং ‘কামিল’ ডিগ্রিপ্রদান অসাংবিধানিক। কারণ, এই সংশ্লিষ্ট বিধান ইউজিসি গাইডলাইনের পরিপন্থী। এতদিন পর্যন্ত মাদ্রাসা বোর্ড কামিল নামে স্নাতক এবং ফাজিল নামে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দিত। এর অধীনে ডিপ্লোমাও করা হয়, যাকে বলা হয় কারি। বোর্ড প্রতি বছর মুন্সী, মৌলভি (দশম শ্রেণী) ও আলিম (দ্বাদশ শ্রেণী) পরীক্ষাও পরিচালনা করে আসছে। তবে এবার থেকে কামিল ও ফাজিলের ডিগ্রি দিতে পারবে না উত্তরপ্রদেশের মাদ্রাসাগুলো। অর্থাৎ সব মাদ্রাসা দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সার্টিফিকেট দিতে পারবে, তবে এর বাইরে শিক্ষার সার্টিফিকেট দেওয়ার ক্ষমতা মাদ্রাসার থাকবে না। পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্ট এ-ও জানিয়ে দিয়েছে, শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণের জন্য রাজ্য সরকার হস্তক্ষেপ করতেই পারে। সেক্ষেত্রে মাদ্রাসা বলে কোনও বাধা থাকবে না।
আরও পড়ুন:পাল্টে গেল মাদ্রাসা! সমস্ত বৈশিষ্ট্য ধুয়েমুছে ‘মি স্কুল’ গড়ল বিজেপি সরকার
সুপ্রিম কোর্টের মঙ্গলবারের এই সিদ্ধান্তে কার্যত স্বস্তি পেয়েছে উত্তরপ্রদেশের ১৬ হাজার মাদ্রাসা। সেই রাজ্যে মোট মাদ্রাসার সংখ্যা প্রায় ২৩,৫০০। রাজ্যে মোট মাদ্রাসার সংখ্যা প্রায় ২৩,৫০০। এর মধ্যে ১৬,৫১৩টি মাদ্রাসা স্বীকৃত বলে খবর। যেখানে এইমুহূর্তে পঠনপাঠন করছে প্রায় ১৭ লক্ষ পড়ুয়া। সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশের পর খুশির হাওয়া তাদের মধ্যেও।