বাংলার বুকোস্কির নগ্ন আত্মজীবনী: 'জগতে কলঙ্ক রবে'

অফিসার ও প্রফেসর-সমৃদ্ধ বাংলা সাহিত্যের হ্যালোজেন-ঝলমলে ঝিনচ্যাক বাজারের শেষে যে প্রায়ান্ধকার চোরাগলিটি আছে, তারই শেষ প্রান্তে নিঃসঙ্গ জেন সন্তর মতো বসে আছে সোমক দাস। খেয়াল করলে দেখা যাবে, তার মাথার পিছনে একটি হেলো বা আলোকবৃত্তও আছে, বা হয়তো নেই, আমারই চোখের ভুল। সে চোরাগলিতে একবার ঢুকলে কোথায় গিয়ে পড়তে হবে, তা এক মারাত্মক উত্তেজনা; খুব কম পাঠকই এই ঝুঁকি নেবেন, আর হ্যালোজেন-ঝলমলে ঝিনচ্যাক বাজারের লেখকরা, বলা বাহুল্য, এই ঝুঁকি নেবেন না।

সোমক দাস কবি, গল্পকার ও ঔপন্যাসিক, যাকে আমি মনে করি বাংলার চার্লস বুকোস্কি। নাম যখন ফেলা হল, তখন বুকোস্কি কে এবং কী, তা নিয়ে দু'কথা বলা উচিত। অনেকেই জানেন, তবু সাবধানের মার নেই।

চার্লস বুকোস্কি (১৯২০–১৯৯৪) জার্মান-আমেরিকান লেখক, যিনি কবি, গল্পকার এবং ঔপন্যাসিক। 'লস এঞ্জেলস টাইমস' তাঁর সম্পর্কে লিখেছিল: বুকোস্কি আমেরিকার রাস্তার কবি, অমার্জিত, অশিক্ষিত মাতাল। নোংরা কথা লেখা আর নোংরা কথা বলাকেই নিজের কাজ বলে মনে করে। একই সঙ্গে বুকোস্কি আমেরিকায় আদৃত ও নিন্দিত হয়েছেন। জীবনে বহু নারীর সঙ্গে সম্পর্ক, বিভিন্ন ধরনের নেশা, জুয়া খেলা, অনৈতিক কাজকর্ম ও খিস্তিখেউড় করাই ছিল তাঁর জীবনযাপন, আর সেটাই তাঁর লেখার বিষয়। তাঁর লেখা ছিল বিতর্কিত, তাঁকে ‘যৌনতাবাদী’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। ‘নোটস অফ এ ডার্টি ওল্ড ম্যান’ নামে একটি কলাম লিখতেন লস এঞ্জেলসের এক আন্ডারগ্রাউন্ড কাগজে, নাম: ওপেন সিটি। এসব দেখে এফবিআই তাঁর নামে আলাদা ফাইল খোলে। তাঁর নেশা সম্পর্কে, লেখকের নিজের কথায় বলতে গেলে, "রোজ নিজেকে মেরে ফেলা এবং প্রতিদিন নতুন করে জন্মগ্রহণ করা– এই ম্যাজিক একমাত্র নেশাতেই সম্ভব।" এই হল সংক্ষেপে বুকোস্কির পরিচয়।

১৯৮৬ সালের মাঝামাঝি সোমক দাসের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার দিনই সে আমার হাতে সদ্য-প্রকাশিত তার একটি মিনিবুক ধরিয়ে দেয়, নাম ‘ঘনশ্যামবাজার’। সেই গদ্যের বইটির প্রথম প্যারাগ্রাফটি পড়া যাক:

কলকাতায় যাবার আগে, পাগলাগারদে যেতে হল। খুপরি ঘরওলা সেই নার্সিং হোম অবশ্য কলকাতাতেই। সেখানে ইলেকট্রিক শক দেবার সময় সীমা বাড়িয়ে দিয়ে, মানুষ খুনের ব্যবস্থা ছিল। দুঃখের বিষয়– কেউ খুন করেনি আমাকে। জানলার কাঁচে ঘুষি চালিয়ে বাঁ হাতের ব্রেকিয়াল আর্টারি কেটে ফেলার পরও আমাকে বাঁচানো হয়েছে।

এই হল লেখকের পরিচয়। ওই মিনিবুকের ২২ পৃষ্ঠায় লেখা,

"বেশি নেশা হয়ে গেলে কলেজ স্কোয়ারের সুইমিং পুলের উপরের চাতালে উঠে শুয়ে পড়তাম। অত উঁচুতে, পুলিশ ওঠে না। রাতবিরেতে রাস্তায় শুয়ে থাকার নিয়ম হল, সঙ্গে কম্বল বা ন্যাকড়াজাতীয় কিছু থাকা চাই। নইলে পুলিশে ধরবে। অর্থাৎ, বৈধ ফুটপাথবাসী ছাড়া অন্য কেউ হঠাৎ ফুটপাতে রাত কাটাতে চাইলে আইনে ও সামাজিকতায় আটকায়। কলকাতা অভিমান করে।"

এহেন সোমক দাসের আত্মজীবনী ‘জগতে কলঙ্ক রবে’ প্রকাশিত হয়েছে গত বছর অক্টোবরে, যা এবছর ফেব্রুয়ারিতে আমি হাতে পেলাম। আত্মজীবনীতে লেখা যে, প্রচণ্ড অর্থাভাবে তাঁদের সপরিবারে সোনাগাছি পাড়ায় মাসে ৬০ টাকা ভাড়ায় একটি বাড়িতে উঠে যেতে হয়। সেসময় সোমক ও তাঁর বাবা একই সঙ্গে হরলালকার দোকানে কাজ করত। লিখছে, "সোনাগাছিতে দিন ভালোই কাটত। একদিন হরলালকার দোকানে ডিউটি সেরে বাবার সঙ্গে বাড়ি ফিরছি। একটা দালাল পিছু ধরল, ভালো মাল আছে বাবু, কলেজ গার্ল, নেপালি। বাবা আস্তে করে বলল, আমরা এখানেই থাকি। আমাকে বলল, এদের সঙ্গে এভাবেই কথা বলবি।" পরের লাইনেই সে লিখছে, "যাদের দিকে কোনদিন তাকাব না ভেবেছিলাম, তারাই বন্ধু হয় গেল।"

এরকম আরও মণিমাণিক্য বইটিতে ছড়িয়ে আছে।

শুধু এই আত্মজীবনী নয়, সোমক এ-যাবৎ যা লিখেছে, সবই তার জীবনে ঘটে যাওয়া অলৌকিক ঘটনাবলীর কথা। কল্পলোকের গল্পগাছা নয়। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত তার গল্পগ্রন্থ ‘অক্ষরের জন্মসূত্র’, সেখানেও এই আত্মজীবনীর অনেক ঘটনার কথা আছে, থাকাটাই স্বাভাবিক, লেখক হল কসাই, তার দোকানে সে নিজেকেই ঝুলিয়ে রেখেছে এবং খানিকটা করে কেটে পাঠককে দিচ্ছে। অন্য খাসি আর পাবে কোথায়? প্রথম গল্পটি, যেখানে লেখক নির্দ্বিধায় বান্ধবীর যোনিকেশ নির্মূলের বর্ণনা দিয়েছে, তারপরই কানিলিঙ্গাসের যে তুমুল কার্নিভাল শুরু হয়, বাংলা সাহিত্যে তা আর কোথাও আছে বলে জানা নেই। ওই বইতেই ‘প্রতিশোধ সম্পর্কে ধারণা’ গল্পটিতেই যে এই আত্মজীবনী শুরু হয়েছিল, আজ তা আমার কাছে স্পষ্ট হয়। এরও আগে ১৯৮৬ সালে ‘সোমক দাসের গল্প’ নামে একটি সংকলন প্রকাশিত হয়, তাতেও যে গল্পগুলো আছে, সেগুলো তার আত্মজীবনী নামক মহানিম গাছটিরই ডালপালা। সারা জীবন একটি সংকট থেকে আরেকটি সংকট, একটি প্রেম থেকে আরেকটি প্রেম, বিভিন্ন বেশ্যার ঘর, থানা ও রিহ্যাব ঘুরে সোমক যে প্রায়ান্ধকার চোরাগলিটির প্রান্তে নিঃসঙ্গ জেন সন্তর মতো বসে আছে, সেখানে তার ছায়া তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,

‘তুমি কি সুন্দর নও? বেঁচে আছো কেন পৃথিবীতে?’

সব শেষে বলার, সোমক দাসকে পাঁচ বছর ঘনিষ্ঠভাবে যা জেনেছি, সে তুলনায় তার আত্মজীবনী পড়ে মনে হয়েছে, সে যা লিখেছে তা হিমশৈলের চূড়ামাত্র! ভবিষ্যতে হয়তো সে শৈল আরও প্রকট হবে, কেননা সোমকের অবস্থানটি রামপ্রসাদের গানেরই অন্তরার বাক্যটির মতো–

‘সাগরে যার বিছানা মা/ শিশিরে তার কী করিবে।'

More Articles