বিপ্লবী অজয় মুখোপাধ্যায়কে বাঙালি ভুলে গেল অথবা ভুলিয়ে দেওয়া হল
বাঙালি জাতির বিপ্লবী ঐতিহ্য আছে, সেই অগ্নিযুগের আমল থেকে, যখন সে এক হাতে বোমা কি বন্দুক আর অন্য হাতে ভগবতগীতা নিয়ে দেশমাতৃকার নামে কসম খেয়ে ইংরেজ মারতে যেত। এহেন ইতিহাস থাকলেও বাঙালি তবু নিজের বিপ্লবীদের ইতিহাসে উদ্বুদ্ধ হতে ভালোবাসে না। বিদেশি বিপ্লব ও বিপ্লবী না হলে তার মন ওঠে না। এই প্রচারের মূলে ছিলেন বামপন্থীরা, যাঁরা ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর স্লোগান তুলে ছিলেন ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’ অতএব ঝুটা আজাদির বিপ্লবীদেরও তাঁদের ঝুটা মনে হয়েছিল। তাই তাঁদের চাই চে গেভারা, কিউবা, নিকারাগুয়া, চিনের লংমার্চ, রাশিয়ার লাল ফৌজ অথচ হাতের কাছে বাঘা যতীন বা সুভাষচন্দ্র বসুরা ছিলেন। আমরা দেখলাম সেই বামপন্থীদের পাল্টি খেতে। পরে তাদের মনে হল এই আজাদি বেশ ভালো। এবং ভোটে জিতে ক্ষমতা দখল করে এই আজাদির যাবতীয় ক্ষীর – ননী খেয়ে হজম করাই প্রকৃত বিপ্লব। যদিও প্রচারে সেই বিদেশি ব্র্যান্ডনেমগুলিই রাখলেন তাঁরা। ইতিহাস ভোলার, ভোলানোর এও এক বড় অধ্যায়।
তমলুক বর্তমানে পূর্ব মেদেনীপুর জেলার একটি মহকুমা শহর। মহাভারতে একে বলা হয়েছে তাম্রলিপ্ত। ১৯৪২ সালে মহাত্মা গান্ধী যখন ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন, সেই সময় তমলুকের কংগ্রেস কর্মীরা সেই আন্দোলনকে এমন পর্যায় নিয়ে গিয়েছিলেন যে ১৯৪২ সালের নভেম্বর তাঁরা ‘স্বাধীন তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার’ গঠন করেন। এর ইতিহাস লিখে গেছেন, গৌতম চট্টোপাধ্যায়, হিতেশরঞ্জন স্যন্যালের মতো ঐতিহাসিকরা। কাঁথি, তমলুক, মহিষাদল, নন্দীগ্রাম ও সুতাহাটা – এই অঞ্চলগুলি নিয়ে তৈরি হয়েছিল ‘স্বাধীন তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার’। এই সরকারের সর্বাধিনায়ক ছিলেন সতীশ সামন্ত, ইংরেজ পুলিশের হাতে তিনি ধরা পড়লে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব তুলে নেন অজয় মুখোপাধ্যায়। অজয়ের নেতৃত্বে তৈরি হয় বিদ্যুৎবাহিনী, সেই বাহিনীই এই বিপ্লবী সরকারকে ২২ মাস পাহারা দিয়ে রেখেছিল, ব্রিটিশ পুলিশ ওই মুক্তাঞ্চলে ঢুকতে পারত না।
এই সরকার চালাতে বিপ্লবীরা ইংরেজ পুলিশ ও তার অনুগামীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে হিংসার আশ্রয় নিয়েছিল, পরে গান্ধীজির কাছে নেতৃবৃন্দ (সতীশ সামন্ত, সুশীল ধাড়া ও অজয় মুখোপাধ্যায়) একথা স্বীকার করলে, তিনি বলেন, ‘তোমরা অহিংসা থেকে সরে গেছ, কিন্তু বীরোচিত কাজ করেছ’।
১৯৪৪ সালের অগাস্ট মাসে গান্ধীজী জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণ করার ডাক দিলেন। তাতে সাড়া দিয়ে ‘স্বাধীন তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার’ তার আন্দোলনের সমাপ্তি ঘোষণা করল। ১৯৪৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর ‘স্বাধীন তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার’ ভেঙে দেওয়া হল। উৎসাহী পাঠক বিস্তারিত ইতিহাস পড়তে পারেন।
অজয় মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি ছিল তমলুকের মালিজঙ্গলে। তবে তাঁরা তমলুকের আদি বাসিন্দা নন। আদতে তাঁরা হুগলির বাসিন্দা ছিলেন। তাঁর বাবা শরৎ মুখোপাধ্যায় ছিলেন আইনজীবী। আইন ব্যবসার কারণেই শরৎ মুখোপাধ্যায় তমলুকে আসেন। মহাত্মা গান্ধীর ডাকে অসহযোগ, আইন অমান্য এবং ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ব্যাপক ভাবে সাড়া দিয়েছিল তমলুক। প্রেসিডেন্সি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র তরুণ অজয় কলেজের পড়াশোনা ছেড়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। ‘স্বাধীন তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার’ ভেঙে দেওয়া হলে অজয় ব্রিটিশ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন ১৯৪৪ সালে। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হলে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হন ডঃ প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ, তাঁর উদ্যোগে অজয় মুখোপাধ্যায় মুক্তি পান ও তাঁর বিরুদ্ধে সমস্ত মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
১৯৫২ সালে দেশের প্রথম সাধারণ উপনির্বাচনে তমলুক বিধানসভা কেন্দ্র থেকে কংগ্রেস প্রার্থী হলেন অজয় মুখোপাধ্যায়। দাঁড়াতে হল নিজেরই ভাই বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে। বিশ্বনাথ ছিলেন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী। নির্বাচনে জিতে অজয় মুখোপাধ্যায় হলেন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের মন্ত্রিসভার সেচ ও জলপথ বিভাগের মন্ত্রী।
বিধানচন্দ্রের মৃত্যুর পরে প্রফুল্লচন্দ্র সেনের মন্ত্রিসভাতেও তিনি সেচ এবং জলপথের দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু এই সময়ে দুর্নীতি-সহ নানা কারণে কংগ্রেসের জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়।
তখনই দিল্লিতে কংগ্রেস নেতৃত্ব কামরাজ পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ১৯৬৩ সালের জুলাই মাসে কংগ্রেস দল ও সরকারকে নতুন করে শক্তিশালী করার জন্য নেহরুকে পরিকল্পনা বাতলেছিলেন তৎকালীন মাদ্রাজের মুখ্যমন্ত্রী কুমারস্বামী কামরাজ। কামরাজের প্রস্তাব অনুযায়ী সরকারের নেতৃত্বদায়ী অংশ তাঁদের মন্ত্রিত্ব ছেড়ে সাংগঠনিক দায়িত্ব নেবেন, যারা সংগঠনে ছিলেন এতদিন তাঁরা এবার সরকারে আসবেন।
কামরাজ প্রস্তাব মেনে অজয় মন্ত্রীত্ব ত্যাগ করে কংগ্রেস সংগঠন গড়ে তোলার কাজে লেগে পড়েছিলেন। ১৯৬৪ সালে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি হন। কিন্তু গোষ্ঠীদ্বন্দের শিকার হয়ে নিজ দলের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন, তাঁকে জেলা ও রাজ্য সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এত সহজে হার মানার পাত্র নন তিনি, ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতার শ্যাম স্কোয়ারে অজয় মুখোপাধ্যায় ও নলিনাক্ষ স্যন্যালের হাতে জন্ম নেয় বাংলা কংগ্রেস।
১৯৬৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে আরামবাগ থেকে কংগ্রেস প্রার্থী গান্ধীবাদী নেতা প্রফুল্ল সেনের বিরুদ্ধে ভোটে লড়তে নামেন আর এক গান্ধীবাদী নেতা বাংলা কংগ্রেসের প্রার্থী অজয় মুখোপাধ্যায়। সেই ভোটে অজয় মুখোপাধ্যাযয়ের কাছে মাত্র ৮২০ ভোটে পরাজিত হল প্রফুল্ল সেন।
১৯৬৭ বিধানসভা ভোটের ফল বেরোবার পর দেখা যায় ২৮০ আসনের মধ্যে কংগ্রেস পেয়েছে ১২৭ আসন। ফলে বিবদমান দুই বিরোধী জোটের নেতারা অনুভব করেন ওই অবস্থায় কংগ্রেসের বিকল্প হিসেবে তারা একত্রে মিলে সরকার গড়া উচিত। কিন্তু দুই জোটের দলগুলির মধ্যে সর্বাধিক আসন পাওয়ায় সিপিএম তাঁদের নেতা জ্যোতি বসুকেই মুখ্যমন্ত্রী করার দাবি তোলে। কিন্তু তা মানতে নারাজ বাংলা কংগ্রেস নেতা অজয় মুখোপাধ্যায় বরং বয়েসের নিরীখে তিনি মুখ্যমন্ত্রীত্বের দাবি তোলেন।
সিপিএমও আশঙ্কা করে এই টানাপোড়েনে অজয়বাবু যদি কোনও কারণে দলবল নিয়ে ফের কংগ্রেসের দিকে চলে যান তাহলে আসল লড়াইটাই ভেস্তে যাবে। কারণ সেবারে জনগণের রায় ছিল কংগ্রেস দলকে ক্ষমতাচ্যুত করা। সেক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রিত্বের দাবিতে অনড় থাকলে সেই রায়কে উপেক্ষা করা হবে। তাছাড়া এই নিয়ে অযথা জেদ করলে অকংগ্রেসি সরকার গঠনের সুযোগ একবার হাতছাড়া হলে ভবিষ্যতে এমন সুযোগ ফের কবে আসবে বলা শক্ত। ফলে শেষ পর্যন্ত সিপিএম নেতৃত্ব অজয়বাবুকেই মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মেনে নেয়।
সমাধান সূত্রে হিসেবে ঠিক হয় জ্যোতি বসু উপ-মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পাশাপাশি তাঁর সঙ্গে অর্থ ও পরিবহণ দফতরের দায়িত্বে পাবেন। অবশেষে ১৯৬৭ সালের ১৫ মার্চ অজয় মুখোপাধ্যায় রাজ্যে যুক্তফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হন এবং ২ নভেম্বর পর্যন্ত সেই পদে থাকেন। এরপর ফের ১৯৬৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৭০ সালের ১৯ মার্চ পর্যন্ত তিনি যুক্তফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী পদে আসীন ছিলেন। ১৯৬৯ সালের ১ ডিসেম্বর কার্জন পার্কে নিজের সরকারের বিরুদ্ধে বাংলা কংগ্রেসের কর্মীদের নিয়ে অনশন সত্যাগ্রহে বসেন মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায়।
১৯৭১ সালে তৃতীয়বার মুখ্যমন্ত্রী হলেও সরকারের পতন হয় দ্রুত। মাত্র ৮৩ দিনে। তাঁর মুখ্যমন্ত্রীত্বের তিনটি পর্ব যথাক্রমে:
প্রথমঃ ১মার্চ ১৯৬৭ - ২১ নভেম্বর ১৯৬৭
দ্বিতীয়ঃ ২৫ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ – ১৬ মার্চ ১৯৭০
তৃতীয়ঃ ২এপ্রিল ১৯৭১ – ২৮ জুন ১৯৭১
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির ইতিহাসে ইনি সত্যিই একজন নৈরাজ্যবাদী মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। পরে ফিরেছিলেন কংগ্রেসে। ১৯৭২ সালে তমলুক থেকে কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে জয়ীও হয়েছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক কাজকর্ম থেকে সরে যাচ্ছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে কেন্দ্রের মন্ত্রীর পদে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কিন্তু অজয় তাঁর বয়স এবং স্বাস্থ্যের কারণে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৭৭ সালে লোকসভা নির্বাচনে স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর সহযোদ্ধা সুশীলকুমার ধাড়ার কাছে পরাজিত হলে তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নেন।
তমলুক ছেড়ে কলকাতায় এক আত্মীয়ের বাড়ি চলে যান। সরল ছিল জীবনযাপন। নিরামিষ খেতেন। পরনে চটি জুতো। হাঁটুর উপর পর্যন্ত খদ্দরের কাপড় আর হাতকাটা জামা পরতেন। ১৯৭৭ সালে তাঁকে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান পদ্মবিভূষণ দেওয়া হয়। এরপর অকৃতদার অজয় লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গিয়েছিলেন। ৮৫ বছর বয়সে ১৯৮৬ সালের ২৭ মে নিতান্তই অবহেলায় মারা যান প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায়। তাঁর জীবনের দিকে তাকালে মনে হয় তিনি ছিলেন নৈরাজ্যবাদী বিপ্লবী।