বাঘের হাঁ-মুখে মাথা ঢোকানোর ভয়ঙ্কর খেলা! চিনুন সার্কাসের মেয়ে সুশীলাকে

সাদা কালো ছবির ঠিক মধ্যিখানে পেল্লায় খাঁচা। খাঁচার ভেতর জলজ্যান্ত বাঘ।  বাঘের গায়ে সম্রাজ্ঞীর মতো এলিয়ে আছেন এক মহিলা। বয়স তেইশ-চব্বিশ, মুখে মৃদু হাসি। দৃশ্য দেখে দর্শকদের চক্ষু ছানাবড়া। আজকের দিনে এ বর্ণনা শুনে হয়ত অনেকেই বলবেন, ‘ধুস, এমনটাও হয় নাকি?’ কিন্তু একসময় এমনই বিস্ময়কর ছিল কলকাতার কিসসা। তারপর কালে কালে বাঙালির জীবন থেকে কত কীই তো হারালো। সে সবের হিসেব দিতে বসলে ‘কত চন্দ্রভূক অমাবস্যা’ যে কেটে যাবে, তার ইয়ত্তা নেই। বাংলার নিজস্ব সুপারম্যান গোবর গোহকে মনে রাখেনি বাঙালি। অম্লান বদনে যিনি বুকের উপর আস্ত হাতি তুলতেন, সেই ভীম ভবানীও আজ তার স্মৃতিপটে ফিকে হয়ে এসেছেন। মোদ্দা কথা হল, রুপকথার নায়কদের বাঙালি বিস্মৃতির অন্ধকারে জলাঞ্জলি দিয়েছে।  তবে, শুধু পুরুষরাই বাঙালির রুপকথার একচেটিয়া কুশীলব নন। মহিলারাও যে সেখানে সমানভাবে উপস্থিত ছিলেন তার প্রমাণই পাওয়া যায় সুশীলা সুন্দরীর গল্পে।

১৮৭৯ সালে উত্তর কলকাতার রামবাগানে জন্ম হয়েছিল সুশীলার। ছোট থেকেই ছিলেন অত্যন্ত ডানপিটে। তাঁর যখন পুতুল খেলার বয়স তখন সেই পুতুলের সংসারকে একপাশে সরিয়ে রেখে ঘোড়া চালানোয় মেতে উঠেছিলেন তিনি। বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজে সে সময় মহিলারা ছিলেন ‘অন্তঃপুরবাসিনী’।  সকালে তাঁরা মন দেবেন ঘরের কাজে। দুপুর কাটাবেন শাশুড়ি, ননদের সঙ্গে তাস খেলে, গল্প-গুজব করে। তারপর দিনান্তে অফিস ফেরত স্বামীর সেবা করবেন। তাঁদের এমন নিয়মের ঘেরাটোপেই রেখেছিল পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। এ অবস্থায় একজন মহিলা যে একেবারে ঘোড়া ছুটিয়ে সমাজের প্রকাশ্য  সমাবেশে এসে উপস্থিত হবেন, এমনটা অনেকেই ভাবতে পারেননি। কিন্তু সুশীলা সম্ভবত সামাজিক শাসন নিয়ে মাথা ঘামানোর পক্ষপাতি ছিলেন না।

কালক্রমে ঘোড়া চালানোর পাশাপাশি সুশীলার আগ্রহ গেল কুস্তি আর জিমন্যাসটিক্সের দিকে। তখন রমরমিয়ে চলছে কলকাতা শহরের সদ্য গজিয়ে ওঠা সার্কাস কোম্পানিগুলি। নবগোপাল মিত্রর ন্যাশানাল সার্কাস থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁর জামাই রাজেন্দ্রলাল সিংহ ১৮৮৩ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাস’। অনেক ঘুরে দু'টি ঘোড়া ও কয়েকজন জিমন্যাস্টকে সংগ্রহ করে রাজেন্দ্রলাল তিলে তিলে সাজিয়ে তুলেছিলেন তাঁর সার্কাসকে। সে সময় তাঁরা ভারতের নানান প্রান্তে ঘুরে ঘুরে খেলা দেখাতেন। হিংস্র পশুদের সার্কাসে ব্যবহার করার রেওয়াজ তখনো আরম্ভ হয়নি।

এরপর গড়ে উঠল মতিলাল বসুর ‘গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস’। সেখানেই ট্র‍্যাপিজের খেলা দেখাতেন তাঁর স্ত্রী রাজবালা। কালক্রমে ‘গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসে’র মালিকানা গেল প্রিয়নাথ বসুর হাতে। তিনি তাঁর নাম রাখলেন ‘বোসেস গ্র্যান্ড সার্কাস’। মতিলালের সার্কাসের নতুন নাম রাখা হয়েছিল ১৯০৯ সালে। এর ঠিক ১৩ বছর আগে রেওদার মহারাজার কল্যাণে সেই সার্কাসে প্রথম বাঘের প্রবেশ ঘটল। সার্কাসের কলাকুশলীদের খেলা দেখে অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন তিনি। তারপরেই লক্ষ্মী ও নারায়ণ নামে দু'টি বাঘ তাঁদের উপহার দিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন-চাঁদে জেটগতির ইন্টারনেট? কবে শুরু হচ্ছে?

বাঘ তো এলো, কিন্তু তাঁদের নিয়ে খেলা দেখাবেন কে? প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, সুশীলার আগেও বাঘের খেলা দেখানোর নিয়ম ছিল সার্কাসে। কিন্তু সে খেলার ধরন ছিল খানিক আলাদা। বাঘকে তখন রিঙে নামানো হত চেন পরিয়ে। কোনোরকম দুর্ঘটনা এড়াতেই এমনটা করা হত। সুশীলা এসে সেই নিয়মে খানিক পরিবর্তন আনলেন। তাঁর আমলেই বাঘের গলা থেকে চেন সরে গেল। উন্মুক্ত বাঘের সঙ্গে তিনি খালি হাতে রিঙে নামা আরম্ভ করলেন।

ঘরভর্তি দর্শকের মধ্যিখানে বাঘ সে সময় খাঁচাবন্দি অবস্থায় থাকত। সুশীলা এলে খুলে দেওয়া হত খাঁচার দরজা, তারপর তিনি নির্বিকার চিত্তে ঢুকে পড়তেন তার ভেতরে। এর পরিণাম কী হতে পারে সে কথা ভেবে দর্শকরা বাকরুদ্ধ হয়ে বসে থাকতেন। কিন্তু খানিক পরেই তাঁরা দেখতেন ব্যাঘ্র মশাই সুশীলার প্রতিটি নির্দেশ শান্ত হয়ে পালন করছে। কোনোরকম উত্তেজনা নেই তার চোখে মুখে, সুশীলা তাকে যা করতে বলছেন, তাই সে করছে। তাঁর এক ইশারাতেই সে গর্জন করে উঠত। আবার অন্য কোনোরকম ইঙ্গিত দেওয়া হলেই সুবোধ বালকের মতো দাঁড়িয়ে পড়ত।

এমনটা চলল ১৯১০ সাল পর্যন্ত। তারপর সুশীলা ভাবলেন, ‘এবার বাঘের সঙ্গে একটু কুস্তি লড়ার খেলা দেখালে কেমন হয়?’ তার কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হল আরও ভয়ঙ্কর খেলা। বাঘের সামনে দাঁড়িয়ে সুশীলা দু-হাতে তার চোয়াল ফাঁক করে মুখের ভেতরে নিজের মাথা ঢুকিয়ে দিতেন। তারপর সেই অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতেন কিছুক্ষণ। দর্শকরা বিস্মিত হয়ে হাততালি দিতে আরম্ভ করলে তিনি বেরিয়ে আসতেন। তারপর, বাঘের গায়ে হেলান দিয়ে হাসিমুখে বসতেন। এই ভঙ্গিতে তাঁর বসে থাকার ছবিটি সারা দেশের সম্ভ্রম অর্জন করে। সেই ছবি দেখে আজ মনে হয় যেন বঙ্কিমের ‘রাজসিংহ’ উপন্যাসের শাহজাদি জেবুন্নিসার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন তিনি।

সুশীলা সুন্দরীকে জীবন সময় দিয়েছে বড় অল্প। মাত্র ৪৫ বছর বয়সেই মৃত্যু হয় তাঁর। তবে তার আগেই তিনি খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছেছিলেন। তাঁর সমসায়িকদের মধ্যে প্রায় কেউই বাঘের সঙ্গে কুস্তি লড়ার মতো কাণ্ড ঘটিয়ে উঠতে পারেননি। এমন খেলা দেখাতে গিয়ে সুশীলা নানান সময় বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন। একবার এক হিংস্র বাঘের থাবার আঘাতে বেশ খানিকটা আহত হয়েছিলেন তিনি। তারপর থেকে আর বাঘের সঙ্গে খেলা দেখানো তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। দর্শকদের হতবাক করে দেওয়ার প্রতিভা নিয়ে সার্কাস রিঙে এসেছিলেন সুশীলা। সার্কাস প্রেমীদের মনে আজও তিনি বেঁচে আছেন গল্পকথার নায়িকা হয়ে।

 তথ্যঋণ : Wikipedia 

More Articles