একটি প্রণামেই তছনছ সাজানো বাগান? শুভেন্দু-সৌজন্যে বিজেপির অন্দরে যে তোলপাড়
Suvendu Adhikari: আবারও কি আসছেন শুভেন্দু-মমতা? ফিরবে সবুজ শিবিরের নতুন দিন?
"কেমন আছিস? বাবাকে আমার প্রণাম জানাস!'' শুক্রবার, অর্থাৎ ২৫ নভেম্বর একটি সাক্ষাৎ এবং কয়েকটি মন্তব্য উত্তাল করেছিল রাজ্য রাজনীতির অলিন্দ। রাজ্য বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর সাক্ষাৎ হয় সেদিন। মাত্র চার-পাঁচ মিনিটের এই 'কাছে আসা' স্বাভাবিকভাবেই বাড়িয়েছিল জল্পনা, বিতর্ক এবং কথকতার। কিন্তু সেই বিতর্ক কমা তো দূরের কথা, এক-একটি দিন যেতে যেতেই সরি বিতর্কই বাড়ছে তরতরিয়ে। দলের বাইরে তো বটেই দলের মধ্যেও সমালোচনার মুখে পড়েন শুভেন্দু। মমতার সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং প্রণাম-বিতর্কে জড়িয়ে দলের ফাঁদে পড়েন তিনি! এবার সেই সূত্রেই ইন্ধন যুগিয়ে শিরোনামে এসেছেন আর এক বিজেপি নেতা।
২৮ নভেম্বর, ২০২২ তারিখে কেন্দ্রীয় বিজেপি-র সংগঠনের দায়িত্বে থাকা অন্যতম সাধারণ সম্পাদক বিএল সন্তোষের উদ্দেশে বিস্ফোরক চিঠি লিখেছেন বঙ্গ বিজেপি-র রাজ্য কমিটির সদস্য এবং রাজ্য বিজেপি-র প্রাক্তন সহ-সভাপতি রাজকমল পাঠক। দক্ষিণ কলকাতার এই বিজেপি নেতার দাবি, শুভেন্দু অধিকারী এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার ভুল বার্তা দিচ্ছে দলের কর্মী, নেতাদের মধ্যে! ওই চিঠিতেই তাঁর দাবি, শুভেন্দু প্রণাম করছেন, এই বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আদৌ তিনি এমন করেছেন কি? এই বিষয়টি স্পষ্ট করা উচিৎ দলের তরফে। রাজকমলের আরও দাবি, শুভেন্দু অধিকারী বা নেতৃত্বকে এমন কিছুই যে ঘটেনি, অর্থাৎ প্রণাম বিষয়টি যে সংবাদমাধ্যমের তৈরি করা- একথাও বলতে হবে। ওই চিঠিতে একথাও লিখেছেন এই বিজেপি নেতা। কিন্তু তাঁর তরফে দাবি, দলের বিরুদ্ধে বা শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে নয়, দলের অবস্থান স্পষ্ট করতে শুধু এই আবেদন। এর মধ্যে দলের অভ্যন্তরের কোন্দল নেই বলেই দবি ওই রাজকমল পাঠকের।
আরও পড়ুন: তৃণমূল ছাড়ছেন দেবাংশু? হঠাৎ জল্পনার আড়ালে অন্য কোনও ইঙ্গিত?
প্রসঙ্গত, রাজনৈতিক মহলের একাংশ বলছেন, একাধারে প্রাক্তন তৃণমূল নেতা, প্রাক্তন সাংসদ, মমতার সরকারের অন্যতম মন্ত্রী। অন্যদিকে বর্তমান বঙ্গ বিজেপি-র মুখ শুভেন্দুর রাজনৈতিক শত্রুর সঙ্গে এই আকস্মিক মোলাকাত খুব একটা ভালো বার্তা দেয়নি সেদিন। দলের অন্য বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পল এবং মনোজ টিগ্গাদের সঙ্গে নিলেও বিতর্ক পিছু ছাড়েনি কাঁথির শান্তিকুঞ্জের এই বাসিন্দার। 'সেটিং থেকে দিদির সঙ্গে ভাইয়ের ফিটিং', একাধিক রাজনৈতিক কটাক্ষ আর স্লোগানে ব্যতিব্যস্ত হয়েছেন শুভেন্দু। সমালোচনায় বিদ্ধ হয়েছেন এই বিজেপি নেতা। কিন্তু শুক্রবারের শীতকালীন আবহের এই উত্তাপে ফের চড়েছে পারদ। যা নিয়ে অর্থাৎ যে আগুনে সেদিনই ঘি ঢেলেছিলেন অধিকারী পরিবারেরই আর এক সদস্য। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে চায়ের আমন্ত্রণ এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এঁর প্রশংসায় শুভেন্দু-আগুন উসকে দিয়েছিলেন তিনি। সেই শুভেন্দু-ভ্রাতা দিব্যেন্দু অধিকারীর কীর্তিতে উঠেছিল প্রশ্ন। আবারও কি আসছেন শুভেন্দু-মমতা? ফিরবে সবুজ শিবিরের নতুন দিন? এই প্রশ্নেই অগ্নি-কাঠি সঞ্চার করেছিলেন রাজনৈতিক মহলের একটা অংশ।
যদিও এর বিপরীতের ওই মহলের দাবি ছিল, সেটিং নয় শুভেন্দু নিজের রাজনৈতিক কৌশলের মধ্যে এই বিষয়টিও ঘটিয়েও জাতীয় রাজনীতিতে কদর বাড়িয়েছেন নিজে।
কোন্দলে বিপর্যস্ত বিজেপি?
দিলীপ ঘোষ। পুরনো সম্পর্ক আর ছোটদের বড়-প্রণামকে ধরে মুখ্যমন্ত্রী এবং শুভেন্দুর সাক্ষাৎকার নিয়ে মুখ খোলেন। মুখ খোলেন তিনি। এবার সেই জল্পনার মধ্যেই সক্রিয হচ্ছে হচ্ছে একই প্রশ্ন। রাম রাম গৃহে প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন রাজকমল।
ঘরে ফিরবেন শুভেন্দু?
২০২১, ফের ডিসেম্বর মাস। জল্পনা আর একাধিক কল্পনা কাটিয়ে রাজ্যের রাজনীতিতে শোরগোল ফেলেন শুভেন্দু। মুকুল রায়ের পথে দল বদলে বিজেপি-তে নাম লেখান এই নেতা। ঝড় ওঠে তৃণমূলে। বিড়ম্বনা আর অস্বস্তিতে বিদ্ধ হয় তৃণমূল। যা বাড়ে বিধানসভা নির্বাচন এবং নন্দীগ্রামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুভেন্দু অধিকারীর নির্বাচনী লড়াই নিয়ে। ক্ষমতায় না এলেও রাজ্যের বিরোধী দলনেতা হতেই এই অস্বস্তি বাড়তে থাকে মমতার দলের। দুর্নীতি আর অভিষেক বিরোধিতায় ফের আক্রমণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হন শুভেন্দু।
হঠাৎ সাক্ষাৎ নিয়ে বিতর্ক
বিধানসভার অন্দরে দিদি আর ভাইয়ের দেখাদেখি। মমতার মুখে শুভেন্দু-নামে প্রশ্ন ওঠে ফের। তাহলে কি মুকুলের দেখানো পথেই ঘরে ফিরছেন তিনি? আবারও কি অভিষেক আপন হবেন শুভেন্দুর? যদিও এই ঘটনার পরের দিনই একাধিক বিষয়ে পুরনো মেজাজে ফেরেন শুভেন্দু। মমতাকে আক্রমণ থেকে দুর্নীতিতে বিদ্ধ তৃণমূলকে আক্রমণ, ফের শুরু করেন তিনি। রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে, এই সাক্ষাৎ যে জল্পনা বাড়াবে এমন আঁচ করেই পরদিনই ফের জনমানসে মমতা, অভিষেক বিরোধিতার পথে এগিয়েছেন শিশির-পুত্র।
নয়া রাজনৈতিক কৌশল
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বিরোধী দলনেতার সঙ্গে দেখা করেছেন। পুরনো সহযোদ্ধার সঙ্গে কথা বলেছেন। সাংবিধানিক সৌজন্যের নজির হলেও এই ঘটনার মধ্যেও রাজনৈতিক কৌশল খুঁজে পেয়েছেন কেউ কেউ। একাধিক কেন্দ্রীয় প্রকল্প। নাম বদল থেকে শুরু করে দুর্নীতি। একের পর এক ক্ষেত্রে শুভেন্দু তীরের বিধর হয়েছে তৃণমূল। বঙ্গের বিজেপির সংগঠনে একাধিক দুর্বলতার মধ্যেও শুভেন্দু আঁচে বারবার তপ্ত থেকেছে রাজ্যের বিজেপি। সেই অবস্থায় দাঁড়িয়ে সেই দলের মুখের সঙ্গে দেখা করে সুকৌশলে জল্পনা বাড়িয়ে দিতে পারেন মমতা। যা আখেরে রাজনৈতিক লাভ দিয়েছে তৃণমূলকেই! আবার শুভেন্দু অধিকারীর তরফে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে একাধিক দাবি জানিয়ে আসা, দলের কর্মীদের তৃণমূল-তরফে সমস্যার কথা জানিয়ে আসা, মাইলেজ দিতে পারে বিজেপি-কে। একথাও বলেছেন কেউ কেউ।
অন্দরেই প্রশ্নের মুখে শুভেন্দু
কিন্তু একাধিক রাজনৈতিক কৌশল আর কথকতার ভিড়েও উঠেছে প্রশ্ন। দলের অভ্যন্তরে বিতর্কের সামনে পড়েছেন এই নেতা। কেন? বঙ্গ বিজেপি সূত্রে বলছে, বাংলায় বিজেপি-র মূল রাজনৈতিক শত্রু। মানুষ যাঁর বিরুদ্ধে গেরুয়াকে বিকল্প হিসেবে বেছে নিচ্ছেন। সেই দলের বস্তা হিসেবে এই আদিখ্যেতা না করলেই ভালো হত। বঙ্গের এক বিজেপি নেতার দাবি, "শুভেন্দু অধিকারী ভালো কাজ করছেন। তিনি এই রাজ্যে দলের অনেকটা অগ্রগতি ঘটিয়েছেন। তাই বলে, তিনিই সর্বেসর্বা, দলের আর কেউ নেই, একথা না ভাবা ভালো। যা কিছু তিনি করতে পারেন না, চাইলেই।'' যদিও এই ঘটনার পরের দিনই অবস্থান বদলান তিনি।
চিঠি-বিপদে শুভেন্দু
কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে চিঠি গিয়েছে। শুভেন্দু আর মমতার আকস্মিক সাক্ষাতের স্পষ্ট বক্তব্য চেয়েছেন তিনি। কিন্তু কেন? রাজ্যের এই নেতার চিঠি নিয়ে রাজনৈতিক মহলের দাবি, এই ঘটনায় যে অস্বস্তি ছিল তা এক ধাক্কায় বাড়িয়ে দিয়েছেন রাজকমল। যেখানে প্রশ্ন উঠেছে শুভেন্দুর কাজ নিয়েই। অর্থাৎ দলের মধ্যেই বিরাট প্রশ্নের মুখে পড়েছেন এই নেতা। যা বঙ্গ বিজেপি-তে খুব একটা স্বস্তির খবর নয় বলেই মত রাজনৈতিক মহলের ওই অংশের।
তাহলে কি বিপদে শুভেন্দু
মোদি না অমিত শাহ, না কি নাড্ডা? বঙ্গ বিজেপি-র অন্যতম বর্তমান মুখের বিড়ম্বনায় কি অস্বস্তিতে পড়েছেন তাঁরাও? ব্যবস্থা নেওয়া হবে শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে? এই প্রশ্নের বিশ্লেষণে, রাজনৈতিক মহলের একাংশের দাবি, শুভেন্দু অধিকারী যা করেছেন সেটি ভুল বলে অবস্থান বিজেপি-র দলীয় অন্দরে প্রকাশ হলেও প্রকাশ্য এর কোনও প্রকাশ না হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। দলের কথা আপাতত দলেই রাখতে চাইছেন নেতৃত্ব। তাই, রাজকমলের চিঠি নিয়ে বিতর্কে খুব একটা ইন্ধন না দেওয়ার সম্ভাবনায় রয়েছে গেরুয়া-কর্তাদের তরফে, এমনও বলছেন কেউ কেউ।