কেউ ধারে কাটে, কেউ ভারে, সারা বিশ্বের নজর এই তলোয়ারগুলির দিকে
তলোয়ারের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এক দীর্ঘ রক্তাক্ত ইতিহাস। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই মানুষের নানা অস্ত্রের মধ্যে লাঠি এবং তলোয়ার বা ছুরি-জাতীয় অস্ত্রের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় হাজার পাঁচেক বছর আগে প্রথম তলোয়ার তৈরি করে মানুষ। বহু বিখ্যাত লড়াইয়ে নিজের উপযোগিতার স্বাক্ষর রেখেছে এই অস্ত্রটি। কয়েকহাজার বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে রয়ে গিয়েছে তলোয়ার। বারুদের আবিষ্কার আর ক'দিনের! আগ্নেয়াস্ত্র আসার পরেও এই জাতীয় অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ হয়নি। বরং বেয়নেটে, ছুরিতে এখনও এই ধারালো তীক্ষ্ণ ফলা বিশিষ্ট হাতিয়ারের নজির দেখা যায়। ১০৬৬ সালে হেস্টিংস-এর যুদ্ধ থেকে ১৮০০ সালে নেপোলিয়নের অস্ট্রিয়ার সেনাদের ওপর হামলা পর্যন্ত লাগাতার নানা ধরনের তলোয়ারের ব্যবহার দেখা গিয়েছে। এখনও তলোয়ারের সেই আভিজাত্য রয়ে গিয়েছে। ২০২০ সালে টম মুর নামে এক ব্যক্তিকে ‘নাইট’ উপাধি দেন রানি এলিজাবেথ। কোভিডের সময় তাঁর সমাজসেবামূলক তহবিল তৈরির চেষ্টাকেই সম্মানিত করার জন্য এই পুরষ্কার। অনুষ্ঠানের সময় রানি একটি বিশেষ তলোয়ার ব্যবহার করেন। এভাবেই ধীরে ধীরে দৈনন্দিন ব্যবহারের জায়গা থেকে আনুষ্ঠানিক ব্যবহারের জায়গায় সরে গিয়েছে তলোয়ার। বর্তমানে বেশ কিছু বিখ্যাত তলোয়ার রেলিক হিসেবে নিলামেও তোলা হয়। আসুন এক নজর দেখে নিই তাদের।
ইস্পাতের হাতলবিশিষ্ট ভারতীয় তলোয়ার
দাম: ১০৪২৩ ডলার / ৭৯২৩০০ টাকা
উৎপত্তিস্থল: ভারত
সময়: ১৮০০-র আশপাশে
বৈশিষ্ট্য: ইস্পাতের তলোয়ার
ঊনবিংশ শতকের এই তলোয়ারটি ৭৯২৩০০ টাকায় বিক্রি করা হয়। এটিতে বিষ্ণুর দশাবতার খোদাই করা রয়েছে। ভারতে একে ‘তলোয়ার’ নামেই চেনে মানুষ। বাঁকা দেহ এবং ইস্পাতের হাতল এর বিশেষত্ব। এখনও ভারতের বিভিন্ন মিছিল বা অনুষ্ঠানে, উৎসবে এই জাতীয় তলোয়ার ব্যবহার করা হয়। জলে ডুবিয়ে ডুবিয়ে এই ইস্পাতের তলোয়ার নির্মিত হয়। যার ফলে তলোয়ারের গায়ে উজ্জ্বল ঢেউয়ের মতো নকশা দেখা যায়।
আরও পড়ুন: পালকি চেপে যুদ্ধ- ময়দানে যেতেন মুঘল রমণীরাও, হারিয়ে যাওয়া সেই যানের গল্প…
শাজাহানের তলোয়ার
দাম: ২৭৫০০০ ডলার / ২ কোটি ৯ লক্ষ ৭৬ টাকা
উৎপত্তিস্থল: ইউরোপ
সময়: সপ্তদশ শতক
২০১৯ সালের জুন মাসে খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতকের এই তলোয়ার বিক্রি হয় ২ কোটি ৯ লক্ষ ৭৬ টাকায়। এটি মুঘল সম্রাট শাজাহানের ব্যক্তিগত তলোয়ার ছিল এককালে। ইস্পাতের এই তলোয়ারটির ওপর সোনার নকশা করা রয়েছে। যদিও ভারতে এই তলোয়ার তৈরি হয়নি। ইউরোপে নির্মিত হয়েছিল এই বিশেষ অস্ত্রটি। সাধরণত এই ধরনের বাইরে থেকে আসা তলোয়ারকে সেসময় ‘ফিরঙ্গি’ তলোয়ার বলা হত। বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রাথমিকভাবে তলোয়ারটির একদিকেই ধার ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে দু'টি দিকেই ধার দেওয়া হয়। এই তলোয়ারের আক্রমণ থেকে বেঁচে ফেরা কঠিন আক্রান্তদের পক্ষে।
প্রাচ্যের রত্ন
দাম: ২১০০০০০ ডলার/ ১৫ কোটি ৯৮ লক্ষ ৩৪ হাজার ২৫৫ টাকা
উৎপত্তিস্থল: আমেরিকা
সময়: বিংশ শতাব্দীর শেষের দিক
বৈশিষ্ট্য: ১০০-রও বেশি দামি রত্নখচিত
১৯৭৫ সালের পরে কোনও এক সময় এই তলোয়ার নির্মিত। ছোট্ট এই তলোয়ারটির গায়ে ১৫৩টি পান্না লাগানো রয়েছে। রয়েছে ৯ খানা হিরে এবং সোনার কারুকাজ। এবং হাতলটি জেড (এক ধরনের স্ফটিক) দ্বারা নির্মিত। নেভাদার বিখ্যাত শিল্পী ও তলোয়ার-নির্মাতা বাস্টার ওয়ারেনস্কি এই তলোয়ার তৈরি করেছিলেন। এর দাম প্রায় ষোলো কোটি টাকা। বাস্টার ‘লিগাসি নাইভস্’ নামে তিনটি বিখ্যাত তলোয়ার বানান। চুনি-পান্না-হিরেখচিত, সোনার কারুকাজ করা এবং আরও নানা ধরনের দুর্মূল্য রত্ন দিয়ে নির্মিত হয় এই তলোয়ারগুলি। তাদেরই একটি এই ‘প্রাচ্যের রত্ন’। একটি নির্মাণ করতে প্রচুর পরিমাণে সময় লাগলেও, বাস্টার একা হাতে সমস্তটা তৈরি করেছেন। বাস্টারের কাজের ভক্তদের কাছে এই তলোয়ারগুলি ‘আর্ট নাইভস্’ হিসাবে পরিচিত।
স্পেনের ‘ইয়ার ড্যাগার’ বা কর্ণাকৃতির ছোরা
দাম: ৫১০০০০০ ডলার / ৩৮ কোটি ৮১ লক্ষ ৭৩ হাজার ৭৫০ টাকা
উৎপত্তিস্থল: স্পেন
সময়: পঞ্চদশ শতক
বৈশিষ্ট্য: কর্ণাকৃতির হাতল
এই কানের আকারের হাতলবিশিষ্ট ছোরাটির বর্তমান মূল্য ৩৮ কোটি ৮১ লক্ষ ৭৩ হাজার ৭৫০ টাকা। পঞ্চদশ ও ষষ্ঠ শতকের স্পেনে এর ব্যবহার ছিল। সাদাবি এই ছোরাটি বিক্রি করে ফের নজর কাড়ল। কর্ণাকৃতি হাতলের এই ছোরার আভিজাত্যের ইতিহাসের সঙ্গে নিজেদের নাম চিরকালীনভাবে জড়িয়ে দেওয়ার দিকে আরেক ধাপ এগোল সাদাবি। পঞ্চদশ শতকের স্পেনে নোবেলমেনদের মধ্যে এই ধরনের তলোয়ারের ব্যবহার এতটাই দেখা যেত, যে উইন্ডসর ক্যাসেলে রাখা রাজা ষষ্ঠ এডওয়ার্ডের একটি প্রতিকৃতির হাতে পর্যন্ত এটি স্বমহিমায় বিরাজমান। এর ‘ইয়ার ড্যাগার’ নামটি নবজাগরণের সময় থেকে প্রচলিত। মূলত হাতলের আকৃতির জন্যই এই নাম। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ছোরার উৎপত্তিস্থল হল আফ্রিকার উত্তরাঞ্চল। যে ছোরাটির ছবি এখানে দেওয়া হল, এই ছোরাটির সঙ্গে লুকেনা-র যুদ্ধের ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে। এই যুদ্ধ হয়েছিল ক্যাস্টিলের রাজা ও খ্রিস্টান সেনার সঙ্গে গ্রানাদা অঞ্চলের (ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী একটি অঞ্চল) নাসরিদ এমিরেটের মুসলিম সেনাদের।