আজীবনই 'চোকার্স' দক্ষিণ আফ্রিকা? কোনওদিন কেন টুর্নামেন্ট জিততে পারে না প্রোটিয়ারা?
T20 World Cup Final Match: এর আগেও বহু বিশ্বকাপে এভাবেই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা।
সেমিফাইনালের গেরো কাটলেও আইসিসি এখনও অধরাই রয়ে গেল দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে। এই দিনটা দেখার জন্য অবশ্যই কুইন্টন ডিকক এক-দিবসীয় ক্রিকেট ছাড়েননি। ২০২৩ সালের বিশ্বকাপটাই ওয়ানডে ফরম্যাটে কুইন্টন ডিককের জন্য ছিল শেষ আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট। সেখানেও চারটে সেঞ্চুরি ছিল তাঁর। তবুও বিদায় নেওয়ার আগে সেটাকে সঠিক সময় মনে করেছিলেন ডিকক। জানিয়েছিলেন, এই বিশ্বকাপের পর একদিনের ক্রিকেট আর খেলবেন না তিনি। পুরোপুরি মনোনিবেশ করবেন ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট এবং টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে। দক্ষিণ আফ্রিকা মনে করেছিল কুইন্টন ডিককের এই প্রচেষ্টার সুফল অন্তত এবার পাবে দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু এবারেও ট্রফির খরা কাটল না দক্ষিণ আফ্রিকার। ভারতের কাছে ৭ রানে পরাজিত হয়ে, খালি হাতেই ফিরতে হলো প্রোটিয়াদের। নেপথ্যে, ভারতের দুরন্ত বোলিং অ্যাটাক আর রোহিত শর্মার কিছু দুর্দান্ত সিদ্ধান্ত।
এবারের টুর্নামেন্টে অপেক্ষাকৃত অনেক সহজ প্রতিদ্বন্দ্বী আফগানিস্তানকে রীতিমতো দুরমুশ করে ফাইনালে পৌঁছেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। এই টুর্নামেন্টে তারা একটিও ম্যাচে পরাজিত হয়নি। যেভাবে তারা সেমিফাইনাল জিতেছিল, তাতে মনে হয়েছিল এবারে টুর্নামেন্ট জিতে নেবে দক্ষিণ আফ্রিকাই। তেমনটা আর হলো কই! মোক্ষম সময়ে ভুল করে ফেলার পুরনো অভ্যাস আর গেল না দক্ষিণ আফ্রিকার। যখন ৩০ বলে মাত্র ৩০ রান প্রয়োজন, হাতে প্রচুর উইকেটও রয়েছে, সেখান থেকে একটা দল কীভাবে হেরে যেতে পারে, সেটাই ভাবাচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকাকে। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষে সবই সম্ভব।
হেনরিক ক্লাসেন যখন পুরোদমে ব্যাট করছেন, সেই সময় ৯০% জয়ের সম্ভাবনা ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার। কার্যত নিজেদের ম্যাচ পকেটে পুরে নিয়েছিল সাউথ আফ্রিকা। ভারতীয়রাও মনে করেছিলেন, আর মনে হয় জেতা হবে না। কিন্তু হার্দিক পাণ্ডিয়ার ওভারে ক্লাসেন আউট হয়ে যাওয়ার পরেই যেন পুরো টিম তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে। ৫ ওভারে মাত্র ২২ রান করতে পারে দক্ষিণ আফ্রিকা। যখন ৩০ বলে ৩০ রান প্রয়োজন, সেখানে দক্ষিণ আফ্রিকা মনে করেছিল, এক রান করে নিয়েই ম্যাচ জিতবে। কিন্তু ভারতের হাতে ছিল একের পর এক ভালো বোলার। ফলে পরিকল্পনা পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার। যা তারা একেবারেই করেনি। পুরনো পদ্ধতিতে খেলতে গিয়ে নিজের বিপদ নিজেরাই ডেকে আনে তারা। চিরকালীন চোকার হয়ে থাকা আবারও যেন প্রমাণ করে দিল দক্ষিণ আফ্রিকা। সুবর্ণ সুযোগ কীভাবে হাতছাড়া করতে হয়, এ দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়া কে জানে আর! এর আগেও বহু বিশ্বকাপে এভাবেই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা।
আরও পড়ুন- শেষ ম্যাচেই ইতিহাস! যেভাবে টি-২০ বিশ্বকাপের মাইলফলক ছুঁলেন বিরাট রোহিত
১৯৯২ বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল
১৯৯২ সালের বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম সেমিফাইনালে জয়ের পথে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। ১৩ বলে দরকার ছিল মাত্র ২২ রান কিন্তু বৃষ্টির বিরতি সব আশায় যেন জল ঢেলে দেয়। সেই সময় নিয়মের মারপ্যাঁচে পড়ে ডিএলএসের ফলে এক বলে ২২ রানের একটা অসম্ভব সমীকরণের মুখে পড়ে যান প্রোটিয়া ব্যটাররা। কোনও রাস্তা না পেয়েই ইংল্যান্ডের সামনে আত্মসমর্পণ করতে হয় অ্যালন ডোনাল্ডদের।
১৯৯৬ বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনাল
১৯৯৬ সালের পাকিস্তানের করাচিতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল। সেই সময় ভারত স্পিনের পিচ হলেও, পাকিস্তান কোনওভাবেই স্পিনারদের সুবিধা দিত না। সেই পিচে শুধুমাত্র পেসাররা সুবিধা পেতেন। দক্ষিণ আফ্রিকা ভারতে খেলা হবে ভেবে এলান ডোনাল্ডের পরিবর্তে স্পিনার পল অ্যাডামসকে নিয়ে দল গঠন করে। সেখানেই বড় ভুল হয়ে যায়। কোয়ার্টার ফাইনালে করাচিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মুখোমুখি হতে হয় দক্ষিণ আফ্রিকাকে। সেই ম্যাচে একেবারে রণমূর্তি ধারণ করেন দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট লেজেন্ড ব্রায়ান লারা। ৯৪ বলে ১১১ রানের দুর্ধর্ষ ইনিংস খেলে দক্ষিণ আফ্রিকার সমস্ত সম্ভাবনা শেষ করে দেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কেনিয়ার কাছে সেই বিশ্বকাপে গ্রুপ স্টেজে পরাজিত হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। মনে করা হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা এবারের বিশ্বকাপে অনেকটা বেশি সুবিধা পাবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে বেরিয়ে যেতে হয় দক্ষিণ আফ্রিকাকে।
১৯৯৯ বিশ্বকাপ সুপার সিক্স
১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে শুধুমাত্র নিজেদের ভুলেই হেরে যেতে হয় দক্ষিণ আফ্রিকাকে। স্টিভ ওয়ার উইকেট প্রায় তুলেই নিয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার বোলাররা। একটা সাধারণ ফ্লিক করতে গিয়ে স্টিভের ব্যাটে বল লেগে চলে গিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার অন্যতম ভালো ফিল্ডার হার্সেল গিবসের হাতে। কিন্তু সেলিব্রেশন করতে গিয়ে বলটা ধরতেই ভুলে যান তিনি। সেই সময় স্টিভ ব্যাট করছিলেন ৫৬ রানে। গিবসের ওই ভুলের পর স্টিভ ওয়াহ বলেছিলেন, "You've just dropped the World Cup"। স্টিভ নিজের ইনিংসকে ১২০ রান অব্দি টেনে নিয়ে যান। ৫০ ওভার শেষে অস্ট্রেলিয়ার রান গিয়ে দাঁড়ায় ২৭২। এত বড় টার্গেট ধাওয়া করা, তাও আবার অস্ট্রেলিয়ার বোলিং লাইন আপের সামনে, সেই সময় ছিল অসম্ভব।
১৯৯৯ বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল
১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে আবারও মুখোমুখি অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকা। দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে সেবার দুরন্ত বোলিং করেছিলেন শন পলক। মাইকেল বেভান এবং স্টিভ ওয়ার ৫০-এর পরেও দক্ষিণ আফ্রিকা অস্ট্রেলিয়াকে আটকে দিয়েছিল ২১৩ রানে। শেন ওয়ার্নের চারটি দুর্দান্ত উইকেটের পরেও ল্যান্স ক্লোজ্নার দক্ষিণ আফ্রিকাকে প্রায় জিতিয়ে দিয়েছিলেন। শেষ ওভারে চার বলে মাত্র একরানের প্রয়োজন ছিল। অস্ট্রেলিয়া ততক্ষণে ম্যাচ প্রায় হেরেই গিয়েছে মনে করে নিয়েছিল। হঠাৎ ক্লুজনারের রান আউট এসে হৃদয় ভেঙে দেয় দক্ষিণ আফ্রিকা সমর্থকদের। ম্যাচ টাই হয় এবং যেহেতু রানরেটের দিক থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার রানরেট অস্ট্রেলিয়া থেকে কম, তাই অস্ট্রেলিয়া ফাইনালে চলে যায়। সেই সময় যদিও সুপার ওভারের কোনও বিষয় ছিল না।
২০০০ আইসিসি নকআউট সেমিফাইনাল
নাইরোবির আইসিসি ইভেন্টে ভারতের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকা ছিল সুপার ফেভারিট। সেই সময় ভারতীয় দল একেবারেই খারাপ অবস্থায়। সবে সবে নিজের কেরিয়ার শুরু করছেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। একটা সময় দক্ষিণ আফ্রিকা ছিল চালকের আসনে। হঠাৎ জ্বলে ওঠেন সৌরভ গাঙ্গুলি। ১৪১ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে তিনি ভারতের স্কোর নিয়ে যান ২৯৫ রানে। ২৯৬ রানের টার্গেট অর্জন করতে নেমে প্রথম থেকেই সমস্যায় পড়তে শুরু করে দক্ষিণ আফ্রিকা। সর্বসাকুল্যে তারা ২০০ রান তুলতে পারে। ৯৫ রানে ভারতের কাছে পরাজিত হতে হয় দক্ষিণ আফ্রিকাকে।
২০০২ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি সেমিফাইনাল
২০০২ সালের চ্যাম্পিয়ন ট্রফি সেমিফাইনালে আবারও মুখোমুখি ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকা। ভারতের সেমিফাইনাল পড়েছিল শ্রীলঙ্কায়। কলম্বোর মাঠে বীরেন্দ্র শেহবাগ এবং যুবরাজ সিংয়ের পরপর দু'টি পঞ্চাশ এবং রাহুল দ্রাবিড়ের ৪৯-এর দৌলতে ভারত ২৬১ রানের একটা বিশাল স্কোর তুলে ফেলে। দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য বিষয়টা খুব একটা সহজ ছিল না কিন্তু গিবস সেঞ্চুরি করে দলকে অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছিলেন। গিবস যখন আউট হয়ে যাচ্ছেন সেই সময় সাউথ আফ্রিকার স্কোর ১ উইকেটে ১৯২। হাতে তখনও রয়েছে ১৪ ওভার। তারপরেই আসেন হরভজন সিং এবং তিনি পরের ওভারে পরপর দু'টি উইকেট নিয়ে একেবারে ব্যাকফুটে ফেলে দেন দক্ষিণ আফ্রিকাকে। তারপর বীরেন্দ্র শেহবাগের তিনটি উইকেটের মাধ্যমে দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিং লাইন আপ পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। শেষ পর্যন্ত ১০ রানে হেরে পরাজিত হতে হয় দক্ষিণ আফ্রিকাকে।
২০০৩ বিশ্বকাপ গ্রুপ স্টেজ
২০০৩ বিশ্বকাপ দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য ছিল সবথেকে খারাপ। গ্রুপ স্টেজে দক্ষিণ আফ্রিকাকে শ্রীলঙ্কাকে পরাজিত করতেই হতো, পরের রাউন্ডে যাওয়ার জন্য কিন্তু বৃষ্টি এসে সব আশা নিভিয়ে দেয়। সেই সময় সাউথ আফ্রিকা লেজেন্ড জ্যাক ক্যালিস বলেছিলেন, এটাই ছিল সাউথ আফ্রিকার সব থেকে খারাপ বিশ্বকাপ। সেবারে DLS পদ্ধতিতে স্কোর বিশ্লেষণ হয়েছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক শন পলক ভেবেছিলেন ২২৯ রান প্রয়োজন হবে জেতার জন্য কিন্তু আসলে ২২৯ রান ছিল টাই করার জন্য প্রয়োজন। সেখানেই ভুল হয়ে যায় বোঝাপড়ায়। মার্ক বাউচার এবং ল্যান্স ক্লুজনার দক্ষিণ আফ্রিকাকে ২২৯ রানের লক্ষ্যমাত্রা পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে, সেলিব্রেট করে তার পরের বল ব্লক করে দেন। ভুল হয়ে যায় সেখানেই। যেহেতু ২২৯ রান ছিল টাই করার রান, তাই আবারও ম্যাচ টাই হয়ে যায় এবং রানরেট কম থাকায় দক্ষিণ আফ্রিকা কোয়ালিফাই করতে পারে না।
২০০৪ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি গ্রুপ পর্ব
২০০৪ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে অনেকটা ভালো অবস্থানে ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। সেমিফাইনালে জায়গা করে নেওয়ার জন্য গ্রুপ ম্যাচে ওভালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে জিততে হতো তাদের। মন্থর পিচে সেঞ্চুরি করে গিবস দক্ষিণ আফ্রিকাকে ২৪৬ রানে পৌঁছে দিয়েছিলেন। অনেকটাই এগিয়ে ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা কিন্তু বৃষ্টি হওয়ার পরে ম্যাচ রিজার্ভ ডে-তে চলে যায় এবং সেই দিন শন পলকের দশম এবং শেষ ওভারে প্রয়োজন ছিল ১৯ রান। মনে হয়েছিল, ওয়েস্ট ইন্ডিজ পারবে না। কিন্তু শিবনারায়ণ চন্দ্রপল এবং রিকার্ডো পাওয়েল ১৯ রান করে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৫ উইকেটে পরাজিত করে।
২০০৬ এর চ্যাম্পিয়নস ট্রফি সেমিফাইনাল
ক্যাপ্টেন গ্রেম স্মিথ টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ভুল করে ফেলেন। জয়পুরের ম্যাচে যদি পরে ব্যাট করা যায় তাহলে পরিস্থিতি ভালো পাওয়া যায়। কিন্তু টসে জিতে তিনি ব্যাটিং নিয়ে ফেলেন এবং সমস্যায় পড়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা। তবুও ২৫৮ রান পর্যন্ত পৌঁছে যায় সাউথ আফ্রিকার স্কোর। এরপর ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে খেলতে মাঠে নামেন ক্রিস গেইল। তার ১৩৩ রানের ঝোড়ো ইনিংসের ফলে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। ৬ উইকেটে ম্যাচ জিতে নেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
২০০৭ বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল
এই বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার দল ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে খেলার আগে দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে বাজি লড়েছিলেন অনেকেই। সেমিফাইনালে টসে জিতে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেন দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক গ্রাহাম স্মিথ। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া এত সহজে হাল ছেড়ে দেওয়ার দল নয়। শন টেইটের দুর্দান্ত গতি এবং গ্লেন ম্যাকগ্রার দুরন্ত লাইন ও লেন্থের কারণে ১৪৯ রানে অলআউট হয়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা। খুব সহজেই এই রান তাড়া করে জিতে যায় অস্ট্রেলিয়া। মাইকেল ক্লার্কের অপরাজিত ৬০ রানের সুবাদে খুব ভালোভাবেই ম্যাচ জিতে যায় অস্ট্রেলিয়া।
২০১১ বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনাল
গ্রুপ পর্বের এক নম্বর দল হিসেবে কোয়ার্টার ফাইনালে প্রবেশ করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। কোয়ার্টার ফাইনালে বিপরীতে ছিল একেবারে নতুন দল নিউজিল্যান্ড, যারা কোনওক্রমে শেষ আটে উঠতে পেরেছিল। এই ম্যাচে নিউজিল্যান্ড দুরন্তভাবে হারায় দক্ষিণ আফ্রিকাকে। জেসি রাইটার ৮৩ রানের ইনিংস খেলেন এবং নিউজিল্যান্ড ২২১ রান করে ফেলে। ২২২ রানের টার্গেট নিয়ে যখন দক্ষিণ আফ্রিকা খেলতে নামে, তখন কিছুটা হলেও সুবিধা ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার দিকে। জ্যাক ক্যালিস সেই সময় ভালো ফর্মে রয়েছেন। তিনি যখন আউট হচ্ছেন সেই সময় দক্ষিণ আফ্রিকার স্কোর ২ উইকেটে ১০৮। অনেকটাই এগিয়ে তারা কিন্তু শেষ পর্যন্ত একের পর এক উইকেট হারিয়ে ৬৪ রানের মধ্যে নিজেদের আট উইকেট হারিয়ে ফেলে দক্ষিণ আফ্রিকা। শেষ পর্যন্ত ৪৯ রানে পরাজিত হয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নেয় দক্ষিণ আফ্রিকা।
২০১৩ চ্যাম্পিয়ন ট্রফি সেমিফাইনাল
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এই ম্যাচ হয়েছিল এবং পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে দুরন্ত ফর্মে ছিলেন এবি ডেভিলিয়ার্স। কিন্তু সেমিফাইনালে একেবারেই হতাশাজনক পারফরম্যান্স তাঁর। ৯ বলে ০ রান করে আউট হন ডিভিলিয়ার্স। ১৭৫ রানে অলআউট হয়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা। জেমস ট্রেড ওয়েল ১৯ রান দিয়ে তিন উইকেট তোলেন। অন্যদিকে জনাথন ট্রট ৮২ রানের দুরন্ত ইনিংস খেলে ৭ উইকেটে পরাজিত করে দক্ষিণ আফ্রিকাকে।
২০১৫ বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল
কোয়াটার ফাইনালে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে সেমিফাইনালে পৌঁছেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। তবে সেখানেই সমস্যা হয়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকার। কাইল এবোটের পরিবর্তে সেবার আনফিট ভার্নান ফিলেন্ডারকে দলে জায়গা করে দেওয়া হয়। দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রীড়ামন্ত্রীর নির্দেশে এই কাজ করা হয় বলে জানা যায়। অধিনায়ক এবি ডেভিলিয়ার্স এর প্রতিবাদে খেলা প্রায় প্রত্যাহার করেতে গিয়েছিলেন। শেষমেষ একটা বৃষ্টি বিঘ্নিত ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় এবং সেখানে দক্ষিণ আফ্রিকা শেষ পাঁচ ওভারে ৬৫ রান যোগ করে নিউজিল্যান্ডকে ২৯৮ রানের টার্গেট দেয়। তবে, ব্রেন্ডন ম্যাককালাম, মার্টিন গাপটিল এবং রসটেলার একসঙ্গে দুরন্ত ইনিংস খেলেন এবং দুই বল বাকি থাকতেই নিউজিল্যান্ড জয়ের জন্য দরকারি রান তুলে নেয়। শেষ মুহূর্তে গ্রান্ড ইলিয়ট দক্ষিণ আফ্রিকার ফাস্ট বোলার ডেল স্টেইনকে ছয় মেরে জয় নিশ্চিত করেন।
আরও পড়ুন- ১৩ বছর পর বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ভারত, চোকার ট্যাগ সরিয়ে ইতিহাসের পাতায় রোহিত অ্যান্ড কোং
২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ গ্রুপ পর্ব
ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ২২৯ রান তুলে ভালো শুরু করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা, তবে শেষমেষ দক্ষিণ আফ্রিকার বোলারদের কুড়িটি ওয়াইডের কারণে সহজেই রান তাড়া করে জিতে যায় ইংল্যান্ড। এরপর ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানো খুব প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার। একটা ভালো জায়গাতে পৌঁছে গিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। শেষ দুই ওভারে প্রয়োজন ছিল ২০ রানের কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলোয়াড়রা ক্রিস মরিস এবং রাবাদার ওভারে ছয় মেরে ম্যাচ জিতে যান। একইভাবে ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতেও অত্যন্ত খারাপ পারফরম্যান্সের কারণে এবং অধিনায়ক ফ্যাফ ডুপ্লেসির খারাপ অধিনায়কত্বের ফলে গ্রুপ পর্বেই বেরিয়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা।
২০১৯ বিশ্বকাপ গ্রুপ পর্ব
২০১৯ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার দল খুব একটা ভালো ছিল না। দলের সবথেকে বড় ভরসা ডেল স্টেইন চোটের কারণে সেই বছর বল করতে পারেননি। এবি ডেভিলিয়ার্স সেই বছর খেলতে রাজি ছিলেন না। সব মিলিয়ে খুব চাপের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। প্রথম তিনটি ম্যাচে পরপর পরাজয়ের পরে কোনওভাবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একটা জয় আনে দক্ষিণ আফ্রিকা কিন্তু তারপরে আবার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হার হজম করে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নেয়। দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক ফাফ ডুপ্লেসি বিষয়টাকে অত্যন্ত বিব্রতকর বলে আখ্যা দেন। এর পরের দু'টি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ অর্থাৎ ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এবং ২০২২ টি২০ বিশ্বকাপে একইভাবে ভালো খেলোয়াড়ের অভাবে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা।
২০২৩ ওডিআই বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল
৫০ ওভারের বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল পর্বে অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। তৃতীয়বারের মতো সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। এর আগে প্রতিবার সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়া পরাজিত করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকাকে। তাই দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে বিশাল বড় পরীক্ষা ছিল এই ম্যাচ। ২০২৩ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে টসে জিতে দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক তেম্বা বাবুমা প্রথমে ব্যাট করার সাহসী সিদ্ধান্ত নেন। তবে সেই সিদ্ধান্ত খুব তাড়াতাড়িই 'ব্যাকফায়ার' করে যায়। মিচেল স্টার্ক এবং জোস হেজেলউডের দুর্দান্ত বোলিংয়ে ধরাশায়ী হয়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিং। প্যাট কামিনস দুর্দান্ত ক্যাচ নিয়ে আউট করে দেন কুইন্টন ডিকককে। ফলে পুরোপুরিভাবে ব্যাকফুটে চলে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা। শেষমেষ ডেভিড মিলার সেঞ্চুরি করে দলের রান ২১২ অবধি নিয়ে যেতে পারলেও, বল হাতে খুব একটা ভালো বোলিং করতে পারেননি দক্ষিণ আফ্রিকার বোলাররা। ফলে শেষ পর্যন্ত ৩ উইকেটে হেরে ২০২৩ ওডিআই বিশ্বকাপের সফর শেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকা।
২০২৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ছিল বিগত ৩০ বছরে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম ফাইনাল খেলা। গোটা দক্ষিণ আফ্রিকা প্রার্থনা করেছিল, যাতে অন্যবারের মতোই দশা না হয়। চোকারের ট্যাগ সরানোর জন্য পুরো টুর্নামেন্টে চেষ্টা করেছিল সাউথ আফ্রিকা। ভারতের বিপক্ষেও ম্যাচ প্রায় জিতেই গেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। ২০২৪-এর টি-২০ বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে ৩০ বলে ৩০ রান প্রয়োজন ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার, হাতে ছিল ছ'টি উইকেট। অথচ ৭ রানে পরাজিত হতে হলো দক্ষিণ আফ্রিকাকে। দক্ষিণ আফ্রিকা কি আজীবন চোকারই থাকবে? কোনওদিনই টুর্নামেন্ট জেতা হবে না দক্ষিণ আফ্রিকার?