ফাইনালে জয় থেকে শুরুতেই বিদায়! কেমন ছিল ভারতীয় দলের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ সফর

T20 World Cup: অধিনায়ক রোহিত শর্মা ও কোচ রাহুল দ্রাবিড়ের ভারতের সামনে এবার দ্বিতীয়বারের মতো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের হাতছানি।

২০০৭ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেই প্রথম আসরে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির হাত ধরে আইসিসি শিরোপা জিতে নিয়েছিল ভারত। এরপর ২০১৪ সালে বাংলাদেশে মাটিতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠলেও শেষ ম্যাচ শ্রীলঙ্কার কাছে হেরে খালি হাতেই বাড়ি ফিরতে হয় মহেন্দ্র সিং ধোনি-র ভারতকে। ২০১৬ সালেও ঘরের মাঠে ফাইনালে উঠতে পারেনি ভারত। তবে ফাইনাল খেলতে না পারলেও ভারত আইসিসি-র যে কোনও আসরেই হয়ে থাকে অলটাইম ফেভারিট। ভারতীয় দল এতটাই সমন্বিত যে, যে-কোনও পরিস্থিতিতে ম্যাচ ঘুরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন ভারতীয় দলের খেলোয়াড়রা। ঠিক যেমনভাবে ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রস্তুতি ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে শেষ ওভারে চারটি উইকেট নিয়ে ম্যাচ ঘুরিয়ে দিয়েছেন বাংলার মহম্মদ শামি।

ভারতীয় একাদশের প্রতিটি খেলোয়াড়ই এক-একজন তারকা। অধিনায়ক রোহিত শর্মা ও কোচ রাহুল দ্রাবিড়ের ভারতের সামনে এবার দ্বিতীয়বারের মতো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের হাতছানি। তবে ভারতের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের এই দৌড় বরাবরই হয়ে থেকেছে একটা রোলার কোস্টার রাইডের মতো। এই নিয়ে এখনও পর্যন্ত সাতবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করতে পেরেছে ভারত। এর মধ্যে ৬ বার ভারত খেলেছে মহেন্দ্র সিং ধোনি-র নেতৃত্বে আর শেষবার বিশ্বকাপে ভারতীয় দলের নেতৃত্বে ছিলেন বিরাট কোহলি। পরিসংখ্যান অনুসারে, এখনও পর্যন্ত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ইতিহাসে ভারতীয় দল ৩৮টি ম্যাচে অংশগ্রহণ করেছে, যার মধ্যে ২৩টি ম্যাচে জয়লাভ করেছে তারা এবং ১৩টি ম্যাচে হতে হয়েছে পরাস্ত।

আরও পড়ুন: টি-টোয়েন্টি মানেই চমক! ফিরে দেখা কুড়ি ওভারের ক্রিকেটের সেরা অঘটনগুলি

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০০৭ (বিজয়ী)
সে-বছর একদিবসীয় বিশ্বকাপে শক্তিশালী ব্যাটিং লাইন-আপ নিয়ে রাহুল দ্রাবিড়ের নেতৃত্বে খেলতে নেমেছিল ভারত। তবে ভারতীয় দলের প্রত্যেকটি খেলোয়াড়ের হতাশাব্যঞ্জক পারফরম‍্যান্সের কারণে গ্রুপ স্টেজ থেকেই ছিটকে যেতে হয় ভারতকে। সেই সময়ে মনে করা হয়েছিল, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও এরকমই অবস্থা হবে ভারতের।

তবে, বাস্তবতা ছিল ঠিক তার বিপরীত। নতুন সদস্যদের নিয়ে টিম তৈরি করে প্রথম সংস্করণেই ভারতের হয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ঘরে তুলেছিলেন অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি। এই প্রতিযোগিতায় শুধুমাত্র যে ভারতীয় দলের ক্ষমতা প্রদর্শিত হয়েছিল, তাই নয়, একই সঙ্গে অধিনায়ক হিসেবেও নিজেকে প্রমাণ করতে পেরেছিলেন ভারতের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি।

স্কটল্যান্ডের বিরুদ্ধে বৃষ্টি বিঘ্নিত ম্যাচ বাতিল হওয়ার কারণে চির-প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের বিপরীতেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সফর শুরু করেছিল ভারত। আর প্রথম ম্যাচেই জয়ের মুখ দেখে নতুন টিম ইন্ডিয়া। ম্যাচ টাই হয়ে যাওয়ার পর শেষমেশ বোল-আউট পদ্ধতিতে নির্ধারিত হয় ম্যাচের ফয়সালা। এরপর সুপার এইটের প্রতিযোগিতায় নিউজিল্যান্ডের কাছে পরাজিত হলেও ইংল্যান্ড এবং দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে পৌঁছয় ভারত।

তবে সেমিফাইনাল থেকে ভারতের যাত্রাপথ খুব একটা সহজ ছিল না। শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে একটি কষ্টার্জিত জয় অর্জন করে ফাইনালে পৌঁছয় ভারতীয় দল। সেখানেও তাদের বিপরীতে চির-প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান। সেবারের বিশ্বকাপে প্রথম থেকেই পাকিস্তান ছিল হট ফেভারিট। গ্রুপ স্টেজ এবং প্লে অফের প্রত্যেকটি ম্যাচে ধারে-ভারে নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শন করেছিল পাকিস্তান। তবে ফাইনালে শেষ বাজি জিতে নেয় ভারত। পাকিস্তানকে হারিয়ে প্রথম সংস্করণে জয়লাভ করে মহেন্দ্র সিং ধোনি-র দল।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০০৯ (সুপার এইট)
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দ্বিতীয় আসরটি বসেছিল ইংল্যান্ডে। তবে, ২০০৯ সালে ভারতের পারফরম‍্যান্স ছিল অত্যন্ত হতাশাজনক। ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ইংল্যান্ড এবং দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে পরপর তিনটি ম্যাচে পরাজিত হয়ে গ্রুপ স্টেজ থেকেই ছিটকে যায় ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ভারত। সেবারের বিশ্বকাপে ভারতীয় দলের একমাত্র জয় ছিল আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে। তবে ২০০৭ সালের রানার-আপ পাকিস্তানের জন্য এই বিশ্বকাপ ছিল প্রতিশোধের। গত বিশ্বকাপে ভারতের কাছে ফাইনাল ম্যাচে পরাস্ত হলেও ২০০৯ সালে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটায়নি পাকিস্তান। ফাইনাল ম্যাচে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে ২০০৯ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে জয়লাভ করে ইউনিস খানের দল।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০১০ (সুপার এইট)
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের তৃতীয় আসর বসেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ যেখানে, প্রথম থেকেই টুর্নামেন্টে ভালো শুরু করেছিল ভারত। প্রথম দু'টি ম্যাচে আফগানিস্তান এবং দক্ষিণ আফ্রিকাকে বড় ব্যবধানে পরাস্ত করে জয়ের ট্র্যাকে ফিরেছিল মহেন্দ্র সিংহ ধোনি-র দল। তবে, শেষমেশ আবারও ঘটে অঘটন। অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং শ্রীলঙ্কার কাছে লাগাতার হারের মুখ দেখে বিশ্বকাপের দৌড় থেকে ছিটকে যায় ভারত। অন্যদিকে, ফাইনাল ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে ৭ উইকেটে পরাস্ত করে জয়লাভ করে পল কলিংউডের ইংল্যান্ড।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০১২ (সুপার এইট)
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের চতুর্থ আসর বসেছিল শ্রীলঙ্কায়। এই টুর্নামেন্টে বলতে গেলে ভারতীয় দলের ভাগ্য খারাপ ছিল। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের চতুর্থ আসরে আফগানিস্তান, ইংল্যান্ড এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে জয়লাভের পরেও নেট রান রেট কম থাকার কারণে ভারতীয় দল পরের রাউন্ডে যেতে পারেনি। তবে এই বিশ্বকাপে আকর্ষণীয় প্রদর্শন করেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ফাইনাল ম্যাচে ৩৬ রানে শ্রীলঙ্কাকে পরাস্ত করে নিজেদের প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ঘরে তুলেছিল ড্যারেন সামির দল।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০১৪ (রানার আপ)
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পঞ্চম আসর বসেছিল বাংলাদেশে। এই বিশ্বকাপে প্রথম থেকেই ফেভারিট ছিল টিম ইন্ডিয়া। ২০১৩ সালে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে জয়লাভের পর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে জয় নিয়েও আশাবাদী ছিল ভারত। পাশাপাশি এইবারের বিশ্বকাপ হচ্ছিল বাংলাদেশে, ফলে পিচ থেকেও সুবিধে পেয়েছিল ভারত। ২০১৪ বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ থেকেই দারুণ ছন্দে ছিল মহেন্দ্র সিং ধোনি-র দল। একটি ম্যাচেও পরাস্ত না হয়ে সরাসরি ফাইনাল অবধি পৌঁছেছিল ভারত। কিন্তু, ধোনিদের অশ্বমেধের এই ঘোড়া আটকে দিয়েছিল শ্রীলঙ্কা। বিরাট কোহলি টুর্নামেন্টের সেরা বিবেচিত হলেও, ফাইনালে শ্রীলঙ্কার কাছে অত্যন্ত হতাশাজনকভাবে পরাস্ত হয়েছিল ভারত। লাসিথ মালিঙ্গার নেতৃত্বাধীন শ্রীলঙ্কার কাছে ছয় উইকেটে পরাস্ত হতে হয়েছিল ভারতকে। ম্যাচের সেরা হয়েছিলেন শ্রীলঙ্কার প্রবাদপ্রতিম ব্যাটসম্যান তথা প্রাক্তন অধিনায়ক কুমার সাঙ্গাকারা।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০১৬ (সেমি-ফাইনালিস্ট)
আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ষষ্ঠ আসরটি বসেছিল ভারতে। প্রথম ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের কাছে পরাস্ত হলেও বাকি সবক'টি ম্যাচ জিতে সেমিফাইনাল অবধি পৌঁছতে পেরেছিল মহেন্দ্র সিং ধোনি-র দল। তবে শত চেষ্টাতেও সেমিফাইনাল ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে পরাস্ত করতে পারেনি ভারত। এই টুর্নামেন্টে ম্যান অফ দ‍্য টুর্নামেন্ট হয়েছিলেন বিরাট কোহলি। শেষমেশ, ফাইনাল ম্যাচে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দ্বিতীয়বারের জন্য টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ট্রফি ঘরে তুলেছিল ড্যারেন সামি-র ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০২১ (সুপার টেন)
করোনাভাইরাসের কারণে আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সপ্তম আসর বসাতে হয়েছিল মরুপ্রদেশ আরবে। ভারতে হবার কথা থাকলেও, সেই সময় ভারতে করোনাভাইরাসের যেরকম পরিস্থিতি ছিল, তাতে ভারতে বিশ্বকাপ আয়োজন করা যেত না। সেই কারণেই আরব, এবং ওমানকে বেছে নিয়েছিলেন তৎকালীন বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়।

তবে ২০২১ সালের বিশ্বকাপে প্রথম থেকেই ছন্দে ছিল না বিরাট কোহলির ভারতীয় দল। প্রথম দু'টি ম্যাচে পাকিস্তান এবং নিউজিল্যান্ডের কাছে পরাস্ত হয়ে বেশ কিছুটা পিছিয়ে পড়েছিল ভারত। পরে অপেক্ষাকৃত সহজ প্রতিদ্বন্দ্বী আফগানিস্তান, স্কটল্যান্ড এবং নামিবিয়া-র বিপক্ষে জয়লাভ করলেও ততক্ষণ এই সেমিফাইনালে যাওয়ার রাস্তাটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ভারতের জন্য। ফলে গ্রুপ স্টেজ থেকেই খালি হাতে ফিরতে হয় ভারতকে। তবে এই বিশ্বকাপ ছিল অঘটনের বিশ্বকাপ। ইংল্যান্ড, পাকিস্তান এবং নিউজিল্যান্ড প্রথম থেকেই এই বিশ্বকাপে হট ফেভারিট থাকলেও ২০২১ বিশ্বকাপের শিরোপা উঠেছিল অস্ট্রেলিয়ার হাতে। ফাইনাল ম্যাচে নিউজিল্যান্ডকে ৮ উইকেটে পরাস্ত করে নিজেদের প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ট্রফি ঘরে তুলেছিল অ্যারন ফিঞ্চের দল। ৭৭ রান করে ফাইনাল ম্যাচের সেরা হয়েছিলেন মিচেল মার্শ। অন্যদিকে, ম্যাচের সেরা হয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার বিধ্বংসী ওপেনার ডেভিড ওয়ার্নার।

More Articles