রবীন্দ্রনাথের প্রিয় মানকচুর জিলিপি স্বাদে টেক্কা দেবে যে কোনও মিষ্টিকে

রবীন্দ্রনাথ জিলিপি ভালবাসতেন, তবে মানকচুর। বিষয়টি বেশ অদ্ভুত লাগছে। মানকচুর আবার জিলিপি হয় নাকি!

কথায় বলে, জিলিপির আড়াই প্যাঁচ। সেই প্যাঁচ থেকে বেরিয়ে আসে কার সাধ্যি! কুটিল মনের মানুষদের বোঝাতেই এই কথা। কিন্তু কথার স্বাদ তেতো হলে কী হবে, জিলিপি ভারি সরস লোভনীয় খাবার। প্যাঁচানো হলদেটে রসে টইটম্বুর। চোখের সামনে থাকলে জিভে জল আসতে বাধ্য। বাংলায় এমন কোনও অঞ্চল নেই, যেখানে জিলিপি তার পসরা সাজিয়ে বসেনি। বিভিন্ন মেলাতে জিলিপি কিনতে গেলে ঠেলাঠেলি-মারামারির জোগাড়। মিষ্টান্ন ভান্ডারের বরাবরের সেলিব্রিটি আইকন জিলিপি। পাঁচ থেকে পঞ্চাশ, ব্রেকফাস্ট টু ডেজার্ট- শেষ পাতে মিষ্টি মুখে মিষ্টি সুখে জিলিপি একাই কাফি। ফলে বাঙালিকে আলাদা করে জিলিপি চিনিয়ে দিতে হয় না।

জিলিপির ইতিহাসও বহু পুরনো। এর লিখিত বর্ণনা তেরোশো শতাব্দীর রান্নার বইতে পাওয়া যায়। মিশরের ইহুদিরাই প্রাচীন এই মিষ্টি আবিষ্কার করেন বলে একটি মত প্রচলিত রয়েছে। মধ্যযুগে তুর্কিরা ভারতে নিয়ে আসে এই খাবারটি। প্রায় ১৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সংস্কৃত ভাষায় রচিত গ্রন্থে জিলিপির এক উপকরণ তালিকা ছিল। অবিশ্বাস্যভাবে আজও তা এক রয়ে গিয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের ভারত ছাড়াও নেপাল, পাকিস্তানে জিলিপির জনপ্রিয়তা চিরকাল তুঙ্গে। নেপালে জিলিপিকে বলা হয় জেরি। শোনা যায় মুঘল যুগেও বাদশাদের খাদ্যতালিকায় স্বমহিমায় জায়গা করে নিয়েছিল এই মিষ্টি। শুধু তাই নয়, বাংলা সাহিত্য থেকে সিনেমাতেও জায়গা করে নিয়েছে জিলিপি।

আমরা সকলেই জানি যে জিলিপির মুখ্য উপকরণ হিসেবে সর্বত্রই ময়দা, দই, সামান্য দুধ এবং বেকিং পাউডার ব্যবহার করা হয়। কিন্তু কোনওদিনও ভেবেছিলেন যে, মানকচুর জিলিপিও কেউ খাবে? আর তা খেতেও নাকি অতি সুস্বাদু। ঠাকুরবাড়ির রান্নার ইতিহাস ঘাঁটলেই জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর হাতের এই জিলিপি খেতে ভীষণ পছন্দ করতেন। একবার ঠাট্টাচ্ছলে তাকে (মৃণালিনী দেবীকে) রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, মানকচুর জিলিপি বানাতে। আর তাতেই তৈরি হয়েছিল এই পদ।

আরও পড়ুন: রাবীন্দ্রিক ডায়েট || স্ত্রী ছাড়া কারও হাতের জিলিপি খেতেন না রবীন্দ্রনাথ

বনেদি বাড়ি বলতে যা বোঝায়, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি ছিল সেইরকম। যৌথ পরিবার। এই পরিবারের সকল সদস্যের মধ্যে আছে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-কলার জাদুস্পর্শ। ঠাকুরবাড়ির সকলেই ছিলেন ভোজনরসিক। রবীন্দ্রনাথও খেতে খুব ভালবাসতেন আর তার সঙ্গে তিনি ভালবাসতেন খাবার নিয়ে নানা রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে। রবীন্দ্রনাথ জিলিপি ভালবাসতেন, তবে মানকচুর। বিষয়টি বেশ অদ্ভুত লাগছে। মানকচুর আবার জিলিপি হয় না কি!

রবীন্দ্রনাথ যখন মানকচুর জিলিপি খেতে চাইছেন, তখন বাংলা ভাষার প্রথম রান্নার বই ‘পাকরেজেশ্বর’-এর একাধিক সংস্করণ বেরিয়ে গিয়েছে। ওই গ্রন্থে কুণ্ডলী অর্থাৎ জিলিপির পাকপ্রণালী রয়েছে, এবং সেখানে জিলিপির অন্যতম উপকরণ হল মুখিকচু কিংবা সারকচু। কচু এ-দেশের নিজস্ব কন্দ, তার অনেকরকম ধরন— মুখি, সার, পানিকচু, পঞ্চমুখী, পাইদনাইল, ওলকচু, দুধকচু, মানকচু, শোলাকচু ইত্যাদি। এদের মধ্যে মানকচু কাঁচা বেটে খাওয়া যায়। মুখি ও সারকচু দিয়ে জিলিপি হলে মানকচু দিয়ে হওয়া বিচিত্র নয়। সারকচুকে অনেকে মানকচুও বলে থাকেন অবশ্য।

মানকচুর জিলিপি নাকি খেতে সুস্বাদু হয়। শুনেছিলেন কোনওদিন? কলকাতার 'পত্রলেখা' থেকে ২০১১ সালে প্রকাশিত হয় শান্তা শ্রীমানীর ‘সহজ রবীন্দ্রনাথ’ বইটি যেখানে অনেক মজার মজার তথ্য পাওয়া যায় রবি ঠাকুরের ব্যাপারে। ওই বই থেকে জানা যায়, মানকচুর জিলিপি রান্নার বুদ্ধি সবার প্রথম রবীন্দ্রনাথের মাথাতেই এসেছিল। তাঁর পরামর্শ অনুসারে জিলিপি রান্না করে দেখা গেল, সাধারণ জিলিপির চেয়ে নাকি অনেক ভালো খেতে এই জিলিপি।

শোনা যায়, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে একসময় এই জিলিপির আসর বসত। কারণ স্বয়ং কবি যে ছিলেন জিলিপির পরম ভক্ত‌। কবি নাকি প্রায়ই নতুন নতুন মিষ্টির ফরমাইশ নিয়ে হাজির হতেন মৃণালিনী দেবীর কাছে। আর উৎসাহ নিয়ে তা নিজে হাতে বানিয়ে পরিবেশনও করতেন কবির সহধর্মিণী। এমনই একদিন আর্জি এল, ‘মানকচুর জিলিপি’। মৃণালিনী দেবী অবশ্য তা উপহাস করে এড়িয়ে যান প্রথমে। কিন্তু পরে একদিন সেটি তৈরি করে হাজির করলেন। মানকচুর মত নীরস সবজি দিয়েও রসে টইটম্বুর জিলিপি বানানো যায়, এ যেন কল্পনাতীত!

Rabindranath Thakur

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

তাহলে জেনে নিই মৃণালিনী দেবী ঠিক কীভাবে এই মানকচুর জিলিপি বানিয়ে রবীন্দ্রনাথকে চমকে দিয়েছিলেন।

উপকরণ

মানকচু: ৫০০ গ্রাম

সূক্ষ্ম ময়দা বা পানিফলের আটা: ২৫০ গ্রাম

সাদা তেল: ৭৫০ মিলি

চিনি: ২ কেজি

গোলাপ আতর: ৫ মিলি (অপশনাল)— কচুর লেহ-তে মেশাতে হবে।

পদ্ধতি

মানকচু জল-সহ সেদ্ধ করে কচুর খোসা পরিষ্কার করে নিতে হবে। তারপরে হাত দিয়ে ভালো করে চটকে আবার গরম করে নিতে হবে।

তারপর তার সঙ্গে ময়দা (কিংবা পানিফলের আটা) মিশিয়ে ও ফেনিয়ে হাঁড়ির মধ্যে ঢাকনা দিয়ে সূর্যের তাপে দু’প্রহর রাখতে হবে। গ্রীষ্মকাল হলে দু’প্রহর অথবা চার প্রহর ছায়াতে; শীতকালে চার প্রহর কিংবা আট প্রহর ছায়াতে। বিন্দু জলে ভাসলে বুঝতে হবে হয়ে গেছে।

লেহ ঘন হলে তিন-চার ভাঁজ কাপড়ের (গামছার মতো পাতলা) সছিদ্র পুটুলির মধ্যে লেহ রেখে, আর লেহ তরল হলে, সছিদ্র নারকেলের মালা বা ওই জাতীয় পাত্রে মিশ্রণটি নিয়ে নিতে হবে।

এরপর কড়াইতে তেল গরম করতে হবে এবং আঁচ মাঝারি রাখতে হবে।

তেল গরম হলে প্যাঁচের আকারে কুণ্ডলী পাকিয়ে ভাজতে হবে।

অন্যদিকে আরেকটা কড়াইতে জল দিতে হবে। তারপর তার মধ্যে চিনি দিতে হবে। চিনি আর জল ফুটতে থাকবে।

জল আর চিনি একসঙ্গে মিশে গেলে অল্প গোলাপজল দিয়ে দিতে হবে। আপনার জিলিপির শিরা প্রস্তুত।

জিলিপি ভাজার পর তা ওই গোলাপজল-সহ চিনির রসে ৩০ মিনিট রেখে দিতে হবে। তারপর গরম গরম পরিবেশন করুন মানকচুর জিলিপি।

ময়দা কিংবা নানাবিধ ডালের গুঁড়োর জিলিপি আমরা খেয়েছি, কিন্তু মানকচুর জিলিপি শুনেই কেমন একটা বোধ হচ্ছে। নেহাৎ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, নাহলে বিশ্বাস করা কঠিন হতো। মানকচুর জিলিপি এই বঙ্গ ছাড়া আর কোথাও হয় বলে শোনা যায় না। জিলিপি যে মাপের আন্তর্জাতিকতা বহন করে, তা অন্য কোনও মিষ্টির ভাগ্যে জোটেনি। আর যাঁরা ডায়েটে আছেন, বা মধুমেহ রোগে আক্রান্ত, তাঁদের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী, কিন্তু আপনারা চাইলে গোপনে চিট মিল হিসেবে এটা ট্রাই করতেই পারেন। মানকচু বলে হয়তো নাক সিঁটকাবেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের প্রিয় মিষ্টি ছিল মানে খেতে মন্দ হবে না। তাই রেসিপি দেখে বাড়িতেও বানাতে পারেন ঠাকুরবাড়ির এই এক্সপেরিমেন্টাল ডিশ।

 

More Articles