পয়লা বৈশাখ মানেই ছিটের জামা! রেডিমেডের ভিড়ে হারিয়ে গেলেন ছোটবেলার দর্জিকাকুরা...
Tailors of Old Days: "এই অনিত্য জীবনে কাল বাঁচবো কিনা ঠিক নেই এই শনিবার প্যান্ট পাবে কিনা জানতে এসেছে? কোথাকার শিশু এ”
এই সময়টা, অর্থাৎ পয়লা বৈশাখ এলে সবার আগে মনে পড়ে পাড়ার দর্জিকাকুদের মুখ আর চিলতে দোকানগুলো। যদিও দর্জিকাকু তাদের নাম ছিল না কোনওমতেই। রতনকাকু আর খোকনকাকুর মধ্যে ছিল চূড়ান্ত কম্পিটিশন। দুর্জনে বলে, দু'জনেই অতীব খাজা দর্জি ছিলেন। তা সে যাই হোক, নৈকট্যর জন্য আমরা ছিলাম রতনকাকুর কাস্টমার। আমাদের প্রজন্মের কাউকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, সে দেবদূত দেখেছে কিনা, সবাই একবাক্যে বলবে হ্যাঁ! পুজো আর নববর্ষের আগে দর্জিকাকুদের মুখ অবিকল দেবদূতের মতোই দেখাত।
আমাদের শৈশবে জামাকাপড়ের মাপ নেওয়ার ঝক্কি না পুইয়ে এক টুকরো কাপড় দিয়ে দেওয়াটাই দস্তুর ছিল। বলতে পারেন, এই ছিল তাদের 'পিস'ফুল সমাধান। তাই পিসের সন্ধানে পায়রা দর্জিকাকুরাই। অতএব এই সময়টুকু ছিল দর্জিকাকুর পায়রার উড়াল। বাকি বছরটুকু তো পর্দা, কোলবালিশের খোল এইসব উঞ্ছবৃত্তির রোজনামচা। খুব বেশি হলে সাদা জামার পকেটে সুতো দিয়ে লোগো বোনা- এই কি সঠিক মূল্যায়ন একজন শিল্পীর? ধিক! এই পূঁজিসর্বস্ব সমাজ শিল্পীকে যোগ্য মর্যাদা কোনওদিনও দিল না।
আরও পড়ুন- বরযাত্রীর বাসে ‘দো ঘুঁট মুঝে ভি…’, মাধ্যাকর্ষণ ভুলে সোজা কাকুর টাকে গিয়ে নামল মাসি!
রতনকাকুর কথাই ধরুন, একবার বরুণ জ্যেঠুর স্যুট সেলাই করতে গিয়ে কফিন বানিয়ে ফেলেছিল। রেমন্ডসের দামি কাপড়খানা জড়িয়ে ধরে বরুণ জ্যেঠু ভেউ ভেউ করে কেঁদে দিয়েছিলেন। পাড়ার লোক শুধু এটুকুই মনে রাখল। রাখালদার ছেলের মোজা যে কী নিখুঁতভাবে অল্টার করেছে এটা কেউ দেখল না। বুচিদির অনেক বয়েসে ছেলে হয়েছে, খুব বাতিক। খোকনকাকুকে ৫ বছরের ছেলের জামা প্যান্ট বানাতে দিয়েছে এই বলে, "দ্যাখ খোকন, প্রথমবার দার্জিলিং যাচ্ছি, ছেলের যেন ঠান্ডা না লাগে”। খোকনকাকুও বানিয়েছে বেহুলার বাসরঘরের মতো পোশাক, এমনকী সামনে চেন পর্যন্ত নেই, যদি ঠান্ডা লেগে যায়?
এদিকে পাহাড়ে উঠতে হবে বলে বুচুদি ছেলেকে জল, অরেঞ্জ জুস, মোমোর সুপ সব খাইয়ে দিয়েছে মাঝপথে। এইবার খোকার থেকে থেকেই সুসু পায়, আর তক্ষুনি আবিষ্কার খোকনকাকুর কীর্তির। চেন নেই, যার অর্থ পুরো প্যান্ট খুলতে হবে প্রত্যেকবার। আর সেই হিসি থামায় সাধ্য কার! হিসি চেপে আর কাজ নাই, এ যে বাতাসিয়া লুপের হিসি। বুচুদিদের 'ঘুম'-এ চোখ বুঁজে আসে, আর ছেলে নতুন উদ্যমে হিসুর 'তাকদা' দেয়। কলকাতা ফিরে বুচুদি আর বুচুদির বর পারলে খোকনকাকুকেই অল্টার করে দেয়। ওই, যোগ্য সমঝদারের অভাব যেকোনও যুগে শিল্পীকে যন্ত্রণা দিয়েছে। নাহলে নুটুদার বিয়েতে রতনকাকুর ওই শেরওয়ানি! তা তো সময়ের বিচারের ঊর্ধ্বে। কোমরে পাপোষ গুঁজে দিলে অবিকল ধরাচূড়া! কে জানে ওই কারণেই কিনা নুটুদার বিয়েটা টিকল না।
আরও পড়ুন- হাতকাটা দুঃখরা ফুলহাতা হয় শীতেই, খোসা ছেড়ে আসে কমলালেবু, না হওয়া প্রেমরা…
এর মধ্যেই পুজো, পয়লা বৈশাখ এলে রতনকাকু আর খোকনকাকুই ছিল আমাদের ভরসার ভারসাচে, আমাদের গোলমেলে গুচি। ওদেরও ওই সময় সেরকমই হাবভাব হতো। খোকনকাকুরটা অতটা জানিনা কিন্তু এই সময়গুলো এলে রতনকাকু ভাববাচ্যে চলে যেত। আর আশ্চর্য বৈরাগ্য! মানে, "এই অনিত্য জীবনে কাল বাঁচবো কিনা ঠিক নেই এই শনিবার প্যান্ট পাবে কিনা জানতে এসেছে? কোথাকার শিশু এ”- এমন ধারা প্রশ্ন চোখে সাজিয়ে আমাদের দিকে থাকত তাকিয়ে। এইদিকে মন ঠিক করে নিয়েছে, অষ্টমীতে দিল তো পাগল হ্যায়ের প্যান্ট পরতেই হবে। অতএব রতনকাকুর দোকানে যাতায়াত হতো ঘনঘন। তখন দেখতাম দোকানটা মন দিয়ে, দুটো মেশিনের মধ্যে একটা অনবরত চলছে। একটা কোণায় কিছু ভাগ্যবানের জামা, প্যান্ট ঝুলছে। টেবিলে রাখা একটা আকাশি চক, একটা অদ্ভুত স্কেল যা সোজা নয় গোটাটা, খানিকটা গিয়ে চওড়া হয়ে গেছে। ঘ্যানঘ্যানও করতাম খানিক, অধিকারবোধ থেকেই হয়তো। শুনত কী শুনত না, কে জানে? আর ধোনি আসার আগে থেকেই রতনকাকু ধোনির ফ্যান! যে জামাটা অষ্টমীর সকালে পরব বলে সপ্তমীর রাতেও না পেয়ে নাভিশ্বাস তুলছি, হঠাৎ শুনি রাতের কড়ানাড়া! কৃপণের মতো গোঁফের কোণায় হাসি ঝুলিয়ে রতনকাকু। হিরো বুঝি ওরম দেখতে হয়? সেই রাতে তো তাই মনে হত।
এখন আর রতনকাকুর দোকানে যাওয়া হয় না। রেডিমেড সুখ দুঃখের এই পৃথিবীতে জামার জন্য অপেক্ষা আর পোষায় না। অল্টার? তাও তো দোকানই করে দিচ্ছে আজকাল। পাড়ায় এখন একটাই দর্জির দোকান, রতনকাকুরটা। খোকনকাকু এখন টকটাইম ভরে। কিন্তু পুজো বা পয়লা বৈশাখ এলে খোকনকাকুর দোকানের ঝাঁপ পড়ে যায় তাড়াতাড়ি। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী, দুই স্যাঙাত মুখোমুখি হয় রতনকাকুর চিলতে ঘরে। রতনকাকুও আর আজকাল বেশিক্ষণ পারে না, খোকনকাকুর থেকে কিছুটা, না কিছুটা নয় অনেকটাই বড়। খোকনকাকুকে দোকানের গর্ভে নিয়েই ঝাঁপ ফেলে দেন রতনকাকু। আমরা টের পাই ওরা রাতের পোশাক বুনতে বসেছে। সেই পোশাকের নকশায় কালপুরুষ উলটো হলে কিছু বলার নেই। সময় ওদের কাজ কেড়ে নিতে পারে, ভুল করার অধিকার নয়। শুধু রতনকাকুর বানানো জামা পরে চেনা লোক চমকে উঠতে পারে, কারণ ভুলের ধরনটা খোকনকাকুর।
পুনশ্চ- মা শাড়ি কেটে জুড়ে গরমকালের কামিজ বানাচ্ছে কয়েকটা। কাপড় নিয়ে রতনকাকুর দোকানে গেছিলাম। দেখলাম, নীল চক, এখনও ছোট হয়নি, একটুও।