কারও উট-ঘোড়া বহন করত সোনা, কেউ দু'হাতে বিলিয়েছেন অর্থ || কারা পৃথিবীর সর্বকালের সেরা ধনী

এক ঝলক দেখে নেওয়া যাক পৃথিবীর সর্বকালের সেরা ধনীদের তালিকা।

ক্ষুধার্তরা নাকি কালে-ভদ্রে অন্যের খাওয়া দেখে আনন্দ পান। আর যাঁরা প্রায় সম্পদহীন লোক, তারা মাঝেমধ্যে সম্পদশালীদের সম্পত্তির খোঁজখবর নিয়ে বিশেষ আনন্দ পান। এই কারণেই প্রতি বছর 'ফোর্বস' ম্যাগাজিনের ‘বিশ্বের সেরা ধনী’ ব্যক্তির তালিকা পড়ে অনেকেই গোগ্রাসে। কার সম্পদ কত বেশি, কে কত বিলিয়ন ডলারের মালিক, কার বাড়ি রাজপ্রাসাদের মতো, কার ক'টা দামি গাড়ি, কার প্রাইভেট জেট আছে– এইসব নিয়ে আমাদের অনুসন্ধিৎসা যেন বাড়াবাড়ি রকমের বেশি।

কথায় আছে, ‘টাকা নাকি কথা বলে’– আর এই টাকায় কী না হয়! বলা হয়, পৃথিবীর ধনী মানুষের যত সম্পদ আছে, তা পৃথিবীর বাকি ৯৯% মানুষের মোট সম্পদের থেকেও বেশি। কার বেশি অর্থ ও বিত্ত? মানসা মুসা না কি বিল গেটস? জন ডি রকফেলার না কি চেঙ্গিস খান? প্রশ্নগুলো খুব সহজ হলেও উত্তরটা কিন্তু ভীষণ কঠিন। কারণ বিশ্বের ইতিহাসের শুরু থেকে এদের সময়কাল ছিল ভিন্ন ভিন্ন।

পৃথিবীর ইতিহাসে ধনীদের স্বর্ণযুগ হিসেবে বর্তমান শতাব্দীকে বোঝানো হয়। বর্তমানে বিল গেটস-কে সর্বকালের সেরা ধনী মনে হলেও অতীতের ধনীদের চেয়ে আজকের সময়ের ধনীরা কিন্তু পিছিয়ে। কেউ সংঘর্ষ করে নিজের সম্পত্তি পেয়েছেন, নয়তো কেউ বংশানুক্রমিকভাবে পেয়েছেন। এইসব আগ্রহ, অনুসন্ধিৎসার অবসান ঘটাতে প্রতি বছর 'ফোর্বস' ম্যাগাজিন একটা তালিকা প্রকাশ করে, কে বর্তমান সময়ের সেরা ধনী তা জানাতে। এক ঝলক দেখে নেওয়া যাক সর্বকালের সেরা ধনীদের তালিকা।

আরও পড়ুন: সবচেয়ে ধনী ভারতীয় কে? আম্বানি-আদানিরা নন, জেনে নিন তাঁর পরিচয়

মানসা মুসা
বিশ্বের সবথেকে ধনী ব্যক্তির নাম করলেই মাথায় ঘুরপাক খায় বিল গেটস, জেফ বেজোস বা আম্বানির নাম। কারও সম্পত্তির পরিমাণ ২১৯ বিলিয়ন ডলার, আবার কারও সম্পত্তির মূল্য ৯০.৭ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু যদি সর্বকালের সেরা ধনী ব্যক্তির নাম জানতে হয়, তাহলে শীর্ষে উঠে আসবে মানসা মুসা-র নাম। তিনি হলেন আফ্রিকার রাজা। বিল গেটস থেকে শুরু করে আজকের দিনের সব ধনী ব্যক্তিই তাঁর কাছে শিশু। এমনকী, কোনও রাজা-বাদশাও তাঁর মতো সম্পত্তির মালিক হতে পারেননি। মুসা ছিলেন মালির রাজা। ১৩১২ সালে তিনি মালির সিংহাসনে বসেন। এবার প্রশ্ন ওঠে, মালির মতো এত গরিব দেশের রাজা সবথেকে ধনী হলেন কীভাবে?

ইতিহাসবিদরা বলেন, মুসার সম্পত্তির পরিমাণ এত ছিল যে, ভবিষ্যতে তাঁকে কেউ ছুঁতেও পারবে না। মুসার সময়কালে আফ্রিকা ফুলে-ফেঁপে উঠেছে, আফ্রিকা তখন প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ। প্রকৃত অর্থে সোনা নাকি মাটির তলায় ফলত। ক্ষমতায় আসার পর নিজের সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটিয়েছিলেন তিনি। ঐতিহাসিকদের আরও মত, ১৩২৪ সালে মুসা-র মক্কাযাত্রার সময় ৫০০ সেনা ছাড়াও বহু উট-ঘোড়া কাজে লাগানো হয়েছিল, যেগুলো নাকি শুধু সোনাই বহন করছিল। কথিত আছে, পবিত্র হজযাত্রার সময় তিনি মিশরে এত অর্থ দান করেছিলেন, যার ফলে মিশরে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয় এবং অর্থনীতি স্বাভাবিক হতে সময় লেগেছিল ১২ বছর। তার মোট সম্পত্তির পরিমাণ অঙ্কে প্রকাশ করা অসম্ভব।

জন ডি রকফেলার
একজন সাধারণ মানুষ থেকে কোটিপতি ব্যবসায়ী হয়েছেন, এমন কতিপয় মানুষের মধ্যে আমেরিকার বিখ্যাত ব্যবসায়ী জন ডি রকফেলার অন্যতম। আমেরিকার ইতিহাসে প্রথম বিলিয়নিয়ার তিনি। ১৮৬৩ সালে পেট্রোলিয়াম খাতে বিনিয়োগ শুরু করেন। ১৮৮০ সালে তাঁর স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রের ৯০% তেল উৎপাদন নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়।

J D Rockfeller

জন ডি রকফেলার

'দ‍্য নিউ ইয়র্ক টাইমস'-এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯১৮ সালে রকফেলারের জমা করা ট্যাক্স বিল অনুযায়ী তাঁর সম্পদের পরিমাণ ১.৫ বিলিয়ন ডলার। বিশেষজ্ঞর মতে, তাঁর সেই সময়ের সম্পত্তির পরিমাণ ওই বছরের যুক্তরাষ্ট্রের আয়ের ২%। ২০১৪ সালে তাঁর ওই সম্পত্তির পরিমাণ হিসেব করে দেখা যায়, তাঁর মোট সম্পত্তির মূল্য ৩৪১ বিলিয়ন ডলার।

অ্যান্ড্রিউ কার্নেগি
সাধারণ তাঁত শ্রমিক থেকে হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বের সেরা ধনী, যাঁকে ইতিহাস মনে রেখেছে ‘ম্যান অফ স্টিল’ বলে। ইস্পাত শিল্পের অগ্রদূত কার্নেগি স্টিল কোম্পানির এই প্রতিষ্ঠাতা বিংশ শতাব্দীর প্রথম ১৮ বছরে দু'হাত খুলে দান করেছেন ৩৫০ মিলিয়ন ডলারেরও কিছু বেশি, যার বর্তমান মূল্য প্রায় ৭৯ বিলিয়ন ডলার।

রকফেলারের মতো কার্নেগিও ছোটবেলায় খুব দারিদ্রর মধ্যে বড় হয়েছেন। তিনি তাঁর সময়ে আমেরিকার সবথেকে বড় স্টিল কোম্পানির মালিক ছিলেন। ১৯০২ সালে তিনি জে. পি. মর্গানের কাছ থেকে ইউএস স্টিল কোম্পানি ৪৮০ মিলিয়ন ডলারে কিনে নেন। তাঁর সম্পত্তির মূল্য ৩১০ বিলিয়ন ডলার। বিপুল বিত্ত উপার্জনকারী মানুষটি নিজ উদ্যম, প্রচেষ্টা আর বহুমুখী প্রতিভার দ্বারা আমেরিকার সেরা ধনী হয়েছিলেন। তাঁকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম বিনিয়োগ প্রতিভাও বলা হয়ে থাকে। তিনি নিজেই নিজেকে প্রেরণা দিতেন। তার মূল মন্ত্র ছিল– 'বিনিয়োগ– আরও বিনিয়োগ'।

জার নিকোলাস ২
রাশিয়ার শেষ সম্রাট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন জার নিকোলাস রোমানভ। ১৮৯৪ সালে তাঁর বাবার মৃত্যুর পর রাশিয়ার ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে নেন। বলা হয়, তিনি নিজে বিশ্বের সেরা ধনী হলেও তাঁর রাজত্বকালে সে-দেশের মানুষ সীমাহীন দারিদ্রর মধ্যে জীবনযাপন করেছিল। এরপর প্রজারা তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠন করে। ১৯১৮ সালে তিনি মারা যান। মৃত্যুর সময় তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ৩০০ বিলিয়ন ডলার।

উইলিয়াম– দ্য কনকারার
ইংল্যান্ডের রাজা উইলিয়াম– দ্য কনকারার প্রথম ইংল্যান্ড শাসন করেন। ১০৬৪ সালে তিনি ব্রিটানি এবং মেইন জয় করেন। ১০৬৬ সালে হেস্টিংসের যুদ্ধে জয়লাভ করে তিনি ইংল্যান্ডের রাজা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। রাজা হওয়ার পর তাঁর শাসনকালে তিনি নর্মান অনুসারীদের সম্পত্তি বিতরণ করে জমি দখল করার জন্য পরিচিত ছিলেন। তাঁকে উইলিয়াম– দ্য বাস্টার্ড বলেও ডাকা হতো। তাঁর মোট সম্পত্তির মূল্য ছিল ২২৮ বিলিয়ন ডলার।

জ্যাকব ফুগার
জার্মান ব্যাংকার জ্যাকব ফুগার সম্বন্ধে জানা যায় যে, তিনি ছিলেন একজন কৃষকের নাতি এবং বড় হয়ে তিনি হয়ে ওঠেন সেই সময়ের সবথেকে বড় ধনী ব্যক্তি। অনুমান করা যায় যে, সমগ্র ইতিহাসে এই উদ্যোগী ব্যক্তির মতো সফলভাবে বিপুল ধনসম্পদ কেউ সংগ্রহ করতে পারেননি। জ্যাকব ফুগার ইউরোপে রেশম এবং তামা-র একচেটিয়া ব্যবসায় বিপুল সাফল্য অর্জন করেন। তিনি সম্রাট চার্লস ভি-এর প্রধান অর্থদাতাও ছিলেন। ১৫১৪ সালে তিনি দরিদ্র মানুষের কথা মাথায় রেখে একটি হাউসিং কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর নামের সঙ্গে মিল রেখেই এই কমপ্লেক্সের নাম রাখা হয়। জ্যাকবের উদ্দেশ্য ছিল দরিদ্র মানুষ যেন নিজের সাধ্যের মধ্যে বাড়ি ভাড়া পায়। তাঁর সম্পত্তির বর্তমান মূল্য– ২২১ বিলিয়ন ডলার।

হেনরি ফোর্ড
আমেরিকার বিশ্ববিখ্যাত ফোর্ড মোটর কোম্পানির কথা কে না জানে! এই অটোমোবাইল কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা হলেন হেনরি ফোর্ড। অবিশ্বাস্য হলেও তিনি ছিলেন এক কৃষক পরিবারের সন্তান। ছোটবেলা থেকেই যন্ত্রের প্রতি তাঁর আগ্রহ। মোটরগাড়ির আবিষ্কারক না হলেও তিনিই প্রথম মোটরগাড়ির বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করেন। আমেরিকার মধ্যবিত্ত মানুষের কথা মাথায় রেখেই তিনি ফোর্ড গাড়ি নির্মাণ করেন। তাঁর পথচলা খুবই কঠিন ছিল। ছোটবেলায় মাকে হারানোর ব্যথা তিনি মেনে নিতে পারেননি। বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। অনেক ঝড় পেরিয়ে মাত্র ২৮,০০০ ডলার নিয়ে গড়ে তোলেন ফোর্ড মোটর কোম্পানি। তারপর আর তাঁকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। মিথ্যের সঙ্গে কখনও আপস করেননি তিনি। তাঁর সম্পত্তির মোট মূল্য– ২০০ বিলিয়ন ডলার।

Henry Ford

হেনরি ফোর্ড

বেসিল ২
বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের দীর্ঘতম রাজত্বকারী রাজা ছিলেন তিনি। দ্বিতীয় বেসিল বুলগার স্লেয়ার বলেও পরিচিত ছিল। ৯৭৬ থেকে ১০২৫ সালে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত তিনি বাইজানটাইন সাম্রাজ্যে রাজত্ব করেছেন। বেসিলের দীর্ঘ শাসনের প্রথম বছরগুলি গৃহযুদ্ধ এবং রাজনৈতিক চক্রান্তে জর্জরিত ছিল। অবশেষে ৯৮৯ সালে তিনি শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপন করে তাঁর সাম্রাজ্যের পূর্ব সীমান্ত সম্প্রসারণে মনোযোগ দেন। বাইজানটাইন সাম্রাজ্যকে শক্তিশালী এবং মজবুত করার জন্য তিনি ভেনিসের ডোজ-এর সঙ্গে চুক্তি করেন। তাঁর মৃত্যুর পর বেসিলের বার্ষিক আয় ২০০,০০০ পাউন্ড সোনা ছাড়িয়ে যায়। তাঁর সম্পত্তির বর্তমান মূল্য– ২০০ বিলিয়ন ডলার।

অ্যালান রুফুস
যুক্তরাজ্যের প্রথম নর্মান রাজা উইলিয়ামের ভাইয়ের ছেলে ছিল রুফুস। নর্মান শাসনকালে তিনি তাঁর কাকার সঙ্গে কাজ করতে শুরু করেন। অ্যালান রুফুস-কে সেসময় অ্যালান দ্য রেড নামেও ডাকা হতো‌। তিনি প্রথম উইলিয়ামের রাজ্য বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১০৯৩ সালে রুফুস মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সময় তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ১১ হাজার পাউন্ড। এ সম্পত্তির বর্তমান অর্থমূল্য- ১৯৪ বিলিয়ন ডলার।

কর্নেলিয়াস ভ্যান্ডারবিল্ট
কর্নেলিয়াস ভ্যান্ডারবিল্ট, ভ্যান্ডারবিল্ট পরিবারের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। পূর্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রেল পরিবহণের ওপর তাঁর একচেটিয়া আধিপত্য ছিল। তিনি একজন আমেরিকান ব্যবসায়ী, যিনি নিউ ইয়র্ক সেন্ট্রাল রেলপথ প্রতিষ্ঠার জন্য বিখ্যাত। পরবর্তী জীবনে তাঁকে ‘দ্য কম্যান্ডার’ বলেও ডাকা হতো। ১৬ বছর বয়সে তিনি নিজস্ব ফেরি সার্ভিস শুরু করেন এবং স্টেটন আইল্যান্ড ও ম্যানহাটনে তাঁর মাল এবং যাত্রী বহন শুরু হয়। ধীরে ধীরে তাঁর ক্রিয়াকলাপ প্রসারিত হতে শুরু করে। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সম্পত্তির মোট মূল্য– ১৮৫ বিলিয়ন ডলার।

এইভাবেই কেউ নিজ উদ্যমে, কেউ সংঘর্ষ করে নিজের নিজের সম্পত্তি অর্জন করে ইতিহাসের পাতায় তাঁদের নাম তুলে ফেলেছেন। তাঁদের সম্পত্তির পরিমাণ ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাঁরা সর্বকালের ধনী ব্যক্তি। তাঁদের স্থান কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। তাঁরা অজেয়।

More Articles