বিনা অপরাধে ৪৬ বছর জেলে ছিলেন যিনি

অ্যান্ডি ডুফ্রেনকে মনে আছে? ‘Shawshank Redemption’ সিনেমার যে অ্যান্ডি কুড়ি বছর ধরে জেল পালানোর সুড়ঙ্গ বানিয়েছিল! আর এক তুমুল বৃষ্টির রাতে খুঁজে পেয়েছিল তার কাঙ্ক্ষিত মুক্তির স্বাদ। তার সম্বল বলতে ছিল আশা আর ছোট্ট একটা পাথর খোদাইয়ের হাতুড়ি মাত্র। যে অপরাধ সে করেনি, সেই অপরাধকে স্বীকার করে নিয়ে সে জীবনের কাছে মাথা ঝোঁকায়নি। কিন্তু বাস্তব জীবন কখনও কখনও যেভাবে সিনেমার পর্দাকেও হার মানায় তা দেখলে চমকে উঠতে হয়। রিচার্ড ফিলিপস। মিশিগানের সংশোধনাগারে দীর্ঘ ছেচল্লিশ বছর কাটানোর পর প্রমাণ হয়েছে আদতে তাঁর কোনও অপরাধই ছিল না! একজন মানুষের মিথ্যা সাক্ষ্যপ্রমাণ তাঁকে ততদিনে আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘকালীন জেলবন্দি আসামিতে পরিণত করেছে।

জীবনের পুরোটাই প্রায় একটামাত্র জেলের অন্ধকার কুঠুরিতে কাটিয়ে ফেলার পর তাঁর সেই জীবনের বিনিময় মূল্য ঠিক হয়েছে ১.৫ মিলিয়ন ডলার। মিশিগানের আদালত কর্তৃপক্ষ তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে বছরে ৫০ হাজার ডলার হিসাবে এই পরিমাণ টাকা তাঁকে জরিমানা হিসাবে দেবেন বলে ঠিক করেছেন। ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ১১কোটি ২৫লক্ষ টাকা। কী সহজ অঙ্ক, তাই না! জীবনের হারিয়ে ফেলা ছেচল্লিশটা বছরের দাম মাত্র ১১ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা! দীর্ঘ ছেচল্লিশ বছরে চারপাশের বদলে যাওয়া পৃথিবীর সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারার অসহায়তা, তাঁর ছেলেমেয়েদের হারিয়ে ফেলার কষ্ট, প্রিয় সঙ্গিনীর অন্য পুরুষের সঙ্গে চলে যাওয়ার বেদনা, আর সবচেয়ে বেশি জীবনের রূপ-রং-গন্ধ-স্পর্শ হারিয়ে অন্ধকারের এক লোহার খাঁচায় সারা জীবনটা কাটিয়ে দেবার যন্ত্রণার দাম ১.৫ মিলিয়ন ডলার। তাও কি না পাবার জন্য তাঁর উকিলকে নিয়ত যুদ্ধ করতে হয়!

রিচার্ড ফিলিপস ১৯৭৭ সালের জানুয়ারি নাগাদ তাঁর প্রিজন সেলের কামরায় বসে লিখেছিলেন – “Ain’t it a crime/ When you don’t have a dime/ To buy the freedom you’ve lost?... Ain’t it sad/ When you’ve never had/ The freedom of a soaring bird?”। কবিতার নাম ছিল ‘Without a Doubt’। ১৯৭১ সাল থেকে শুরু হয় তাঁর এই দীর্ঘ কয়েদিজীবন। যে অপরাধ তিনি করেননি, সেই অপরাধের দায় তাঁর ওপর চাপিয়েছিলেন বন্ধু ফ্রেড মিচেল। ছোটবেলা থেকেই সৎ বাবা ও নির্বাক মায়ের সংসারে বড় হয়ে ওঠা ফিলিপসের কাছে পালিয়ে বেড়ানোর রাস্তা খোঁজা ছাড়া উপায় ছিল না। কিন্তু নড়বড়ে কাজের ভবিষ্যৎ নিয়ে সবে যখন স্ত্রী, চার বছরের মেয়ে আর দু বছরের ছেলেকে নিয়ে সুখের মুখ দেখতে শুরু করেছেন ফিলিপস, তাঁর জীবনে দুষ্ট শনিগ্রহের মতো ঢুকে পড়ে ‘দাগো’ নামে খ্যাত রিচার্ড পালোম্বো আর ফ্রেড মিচেল। একদিকে মিচেল আর পালোম্বোর সঙ্গে তীব্র সব নিষিদ্ধ নেশার ঘোর আর অন্যদিকে সংসারের পাকদণ্ডী- দুইয়ের মাঝে জীবনকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে বেশ ভালোই দিন কাটছিল ফিলিপসের। বাধ সাধল সামনের কনভিনিয়েন্স স্টোরে এক ছোটখাটো দিনে ডাকাতির ঘটনা। ডাকাতির সময় বন্দুকের ব্যবহার করায় পালোম্বো ধরা পড়ে যান। পুলিশের কাছে কবুল করেন তাঁর সহযোগী হিসাবে ছিলেন রিচার্ড ফিলিপস। ১৯৭১-এর জুনে বিচার শুরু হয়। ১৯৭২ এর মার্চ নাগাদ আরেকটি পুরনো কেসের সমাধান সূত্র খুঁজে পায় ডেট্রয়েট পুলিশ। ওই এলাকারই বিগত এক বছর ধরে নিখোঁজ গ্রেগরি হ্যারিসের গুলিবিদ্ধ কঙ্কাল উদ্ধার হয়। দুটি ঘটনারই প্রধান সাক্ষী হিসাবে ফ্রেড মিচেল জানান,  ডাকাতির প্রায় সাতদিন আগে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে পালোম্বোর সামনে রিচার্ড ফিলিপস খুন করেছিল হ্যারিসকে। এই ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ফিলিপসের উকিল দাগোকে প্রশ্ন করেন- “Is your silence because you did not wish to incriminate someone else?”। উত্তরে পালোম্বো এক কথায় জানান- “Yes.” । ফ্রেড মিচেলের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আজীবন সশ্রম কারাদণ্ডের সাজা পান ফিলিপস। সেই ফ্রেড মিচেল যাকে ফিলিপস বন্ধু হিসাবে চিনতেন। সেই ফ্রেড মিচেল যাঁর মৃত্যুর পর দাগো তথা পালোম্বো স্বীকার করেন, মিচেলের ভয়েই তিনি নিজের পরিবারের সদস্যদের প্রাণ বাঁচাতে, এতদিন সত্য গোপন করেছিলেন। হ্যারিসের মৃত্যু পালোম্বোর সামনে বন্দুকের গুলিতেই হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু সেই বন্দুক চালিয়েছিল ফ্রেড মিচেল নিজেই। ১৯৭১ এর জুনের ডাকাতির ঘটনার সময় তিনি রিচার্ড ফিলিপসকেই চিনতেনই না। তাঁর ফিলিপসের সঙ্গে পরিচয় হয় জুলাই মাসে। তাও ফ্রেড মিচেলেরই সঙ্গে, তাঁরই বন্ধু হিসাবে! তাহলে ডাকাতির ঘটনায় কিংবা হ্যারিসের মৃত্যুর সঙ্গে ফিলিপসের প্রত্যক্ষ যোগ কোথায়?  উত্তর মেলে না। প্রায় তেতাল্লিশ বছর দীর্ঘ কারাবাসের পর উকিলের – “And Mr. Phillips was totally innocent?” … “He wasn’t even there?” প্রশ্নের উত্তরে পালোম্বো স্থির গলায় জানান “That’s correct.”। কিন্তু তখন আদতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। রিচার্ড ফিলিপস ততদিনে বুঝতে শিখে গিয়েছেন – “The clock hand spins like the water wheel on the side of an old shack. Everything has been for a reason. Nothing can be turned back; especially not time.”।

মানুষ হিসাবে কেমন ছিলেন রিচার্ড ফিলিপস? কেমন ছিল তাঁর স্বপ্ন, বাস্তব, কল্পনায় মেশানো জীবনের ছায়া? কেমনভাবে ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে চেয়েছিলেন তিনি? কেমন হতে পারত তাঁর তুমুল প্রেমিক সত্তা? বরফসাদা চুলের ফিলিপস যখন দীর্ঘ ছেচল্লিশ বছর পর মিশিগান সংশোধনাগারের বাইরে পা রাখলেন, আকাশের দিকে চুম্বন ছুঁড়ে দিয়ে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন ঈশ্বরকে! দেখতে দেখতে মনে পড়ে যাচ্ছিল সিনেমার অ্যান্ডি ডুফ্রেনের জেল পালানোর রাতে, তীব্র ঝড়জলের মধ্যে গায়ের জামাটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আকাশের দিকে দু'হাত বাড়িয়ে দেবার দৃশ্যের কথা। জীবনও তো কম সিনেম্যাটিক নয়!

কয়েদি জীবনের এতগুলো বছর কীভাবে কাটিয়েছিলেন ফিলিপস? শুধুই কায়িক শ্রম আর অপেক্ষা করে? উত্তর হল- না। ন্যায় বিচার পাওয়ার অপেক্ষা ছিল বটে। কিন্তু তাকে ছাপিয়েও তাঁর কারাজীবনের দিনগুলিকে ঘিরে রেখেছিল শব্দ, সুর আর রং। হ্যাঁ। ঠিকই পড়লেন। ফিলিপস শুরুর দিকে কবিতা লিখতেন তাঁর প্রিজন সেলে বসে। ১৯৯০ সাল নাগাদ তিনি প্রায় ৩১'টির বেশি কবিতা লিখেছেন। অন্ধকার কুঠুরির এককোণে বসে লেখা এই সব কবিতায় ফিরে ফিরে এসেছে জোনাকির আভা, রাতের বুক চিরে স্কাইলার্কের নিশ্চুপ উড়ে যাওয়া, তাঁর আলাবামায় কাটানো দিনগুলোতে প্রিয় শিকামোর গাছটির কথা, এক দয়ালু কাকু-কাকিমার কথা, ছেলেবেলায় তুতোভাইদের কাঁধে চেপে ঘুরে বেড়ানোর কথা, উজ্জ্বল গোলাপি রঙের ড্রেস পরা এক নারীর কথা আর ক্রমশ অন্ধকারের অতলে তলিয়ে যেতে যেতে নিজস্ব মৃত্যুর কথা।

কিন্তু শুধু মৃত্যুচিন্তা নয়। তাঁকে প্রতি মুহূর্তে বাঁচার জন্য নতুন করে উদ্দীপনা জোগাত তাঁর ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে, নিজেকে নতুন নতুন রূপে আবিষ্কার করার তাড়না। তাই নিজে হাতে বানানো গ্রিটিংস কার্ড বানানোর জমানো টাকা দিয়ে কিনে ফেললেন একটা জলরঙের বাক্স। চেয়েছিলেন অ্যাক্রিলিক রং। তাও ভুল করে যা এল, তাতেই তিনি খুশি। তাঁর কারাগারের বন্ধুরা যখন অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকত, তিনি একের পর রং মিশিয়ে মিশিয়ে এঁকে চলতেন তাঁর জীবনকে। কখনও ম্যাগাজিন বা অন্যান্য পত্রপত্রিকার কাটা অংশ থেকে দেখে, কখনও বিখ্যাত কোনো শিল্পীদের অনুসরণে ফিলিপস এঁকে চলতেন একের পর এক ছবি। একটা মাত্র জলরঙের প্যালেটকে আঁকড়ে ধরে হেডফোনে জন কোলট্রেন বা মাইলস ডেভিস চালিয়ে তিনি কাগজের উপর রঙিন স্বপ্নের জগতে বুঁদ হয়ে থাকতেন। ৪৬ বছরের দীর্ঘ কারাবাসের মধ্যে তিনি এঁকেছেন প্রায় ৪০০-এর বেশি ছবি। একসময় তাঁর সেই গারদের ছোট জায়গাও যখন সেই সব ছবির জন্য বাড়ন্ত হয়ে উঠল, পত্রমিতালীর বন্ধু দোরিন ক্রোমাতিয়েকে সেই সব ছবি তিনি পাঠিয়ে দিলেন। কোন বিশ্বাসে দোরিন সেই সব ছবি নষ্ট না করে, ফিলিপসের আসার অপেক্ষায় রেখেছিলেন জানা নেই। কিন্তু দোরিনের দরজায় ফিলিপস একদিন ঠিক এসে পৌঁছেছিলেন। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বাসের টিকিট কেটে নিউ ইয়র্কে গিয়ে দোরিনের কাছ থেকে ফিরে পেয়েছিলেন সেই সব ছবি। এক জ্যাজ পিয়ানোবাদক, ওয়াইনের পাত্রে একটামাত্র চেরি, দূর সমুদ্রে ভাসমান এক জাহাজের ছবির সামনে হলুদ ফুলের গুচ্ছ, সর্যূমুখীর ক্ষেতে সূর্যাস্ত, মোনালিসা, মাদার টেরেসার পোর্ট্রেট, চারজন নৃত্যরত বাদক ইত্যাদি ছিল তাঁর ছবির বিষয়। ছবি আঁকতে আঁকতে তিনি ভুলে যেতেন জেলের বাইরের মুক্ত জীবনের জন্যও তাঁর কিছুমাত্র অপেক্ষা আছে!

“There is no price to put on freedom. That’s yours, that’s something that you were born with. And you should be able to continue to be free until the day you die.” এক সাক্ষাৎকারে এমনটাই বলেছিলেন ফিলিপস। জেলে থাকাকালীন জেলের মধ্যেই একসময় মিচেলকে খুন করতে চেয়েছিলেন তিনি! কিন্তু করেননি। তাঁর দিকে তোলা সারা পৃথিবীর দেওয়া মিথ্যে অপবাদকে তিনি ওইভাবে সত্যি হতে দেননি। তিনি বেঁচেছিলেন! রঙে-রেখায়-শব্দে-সুরে ডুবে বেঁচেছিলেন। তাই ৭৩ বছর বয়সে এক ঝটকায় আধুনিক পৃথিবীতে ঢুকে পড়ে তাঁর প্রিয় অরেঞ্জ জুসের এত রকমফের দেখে ঘাবড়ে গেলেও, মুহূর্তেই সামলে নেন নিজেকে। অপেক্ষা করেন আরও একটা মুক্ত জীবনের নতুন ভোরের প্রত্যাশায়। একদিন। আরেকটা নতুন ভোর! আরেকটা নতুন দিন। আলো, আনন্দ, মুক্তি আর জয়!   

তথ্যসূত্রঃ

১। https://edition.cnn.com/interactive/2020/04/us/longest-wrongful-prison-sentence/

২।https://www.insider.com/man-exonerated-after-45-years-sells-prison-art-to-get-by-2019-1

৩। https://www.youtube.com/watch?v=KqtZxmaQN4Y

More Articles