পুরনো জেরক্সের পাতা থেকে আজও ঠিকরে বেরোন বসিরহাটের ফিনিক্স পাখি কুণ্ডু স্যার

Teachers' Day 2023 : জেল থেকে বেরিয়ে শুরু করেন সকাল-সন্ধা পড়ানো, বিনা বেতনে। স্কুল থেকে আরম্ভ করে কলেজ পড়ুয়ারা, সকলেরই প্ৰিয় কুণ্ডু স্যার।

"আগের দিন আমরা একটা চলকুণ্ডলি গ্যালভানোমিটার কীভাবে কাজ করে দেখেছি...", বলতে বলতে হুড়মুড়িয়ে ক্লাসে ঢুকলেন কাঁচা পাকা চুলের এক মাস্টারমশাই। বয়স ষাট ছুঁইছুঁই। দেখে কে বলবে ক'দিন পর অবসর নেবেন! না, অবসর তাঁর জীবনে নেই। তিনি সুভাষ কুণ্ডু। বসিরহাট হাইস্কুলের পদার্থবিদ্যার শিক্ষক। শুধু বসিরহাট মহকুমায় নয়, তাঁর দীপ্তি ছড়িয়ে আছে জেলার আনাচে কানাচে, এমনকী পার্শ্ববর্তী জেলাগুলিতেও।

সত্তরের দশকের শেষভাগে, বসিরহাট কলেজের তরুণ অধ্যাপক, সুভাষ কুণ্ডু জড়িয়ে পড়েছিলেন নকশাল আন্দোলনে। অগত্যা অধ্যাপনার চাকরি খুইয়ে জুটেছিল হাজতবাস। জেল থেকে বেরিয়ে শুরু করেন সকাল-সন্ধা পড়ানো, বিনা বেতনে। স্কুল থেকে আরম্ভ করে কলেজ পড়ুয়ারা, সকলেরই প্ৰিয় কুণ্ডু স্যার। মহকুমার বিভিন্ন স্কুলে তখন বিজ্ঞান শিক্ষকের ঘাটতি। এর ভেতরে, নিজের শিক্ষক অরুণবাবুর আমন্ত্রণে যোগ দেন বসিরহাট হাইস্কুলে। সেই সময় আশেপাশের স্কুলগুলিতেও বিজ্ঞান শিক্ষকের অভাব। দূরের কালীনগর, হিঙ্গলগঞ্জ, প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুলের পড়ুয়ারা মুখিয়ে আছে কুণ্ডু স্যারের ক্লাস করবে বলে। ঠিক হলো, প্রতি রোববার হবে একটা গ্র্যান্ড ক্লাস, সেখানে অন্যান্য স্কুলের ছাত্রদের অবাধ প্রবেশ। এর পাশাপাশি কলেজের ছেলেমেয়েদের জন্য নিজ গরজে গড়ে তুললেন ল্যাবরেটরি। স্নাতক স্তরের বিদেশি লেখকদের ভিড় ঠেলে, প্রাঞ্জল বাংলায় বোঝানো, সঙ্গে ছোট ছোট ইংরেজি বাক্য বোর্ডে লেখা- এর মোহেই জেলার প্রত্যন্ত এলাকার কলেজের পদার্থবিদ্যার শিক্ষার্থীদের ভিড় লেগে থাকত বসিরহাট ফাল্গুনী সিনেমার সামনে ইনস্টিটিউট অব ফিজিক্সে। হ্যাঁ, স্যারের নিজ খরচ ও উদ্যোগে তৈরি এই প্রতিষ্ঠান।

আমরা স্যারকে প্রথম পাই নবম শ্রেণিতে। ক্লাস জুড়ে হেঁটে পড়াতেন বলবিদ্যার সূত্রগুলি, কষাতেন মাঝারি থেকে কঠিন অঙ্ক। মনে আছে, ২০০৫ সালে আমরা ক'জন খুব করে ধরলাম ঐচ্ছিক হিসাবে বলবিদ্যা নেব। তিনি বোঝালেন, বলবিদ্যার অঙ্কের সঙ্গে সঙ্গে পদার্থবিদ্যার অন্য বিষয়গুলিও আয়ত্ত করতে হবে, আর তাছাড়া বলবিদ্যার একটা অঙ্ক ভুল করলে ১০ নম্বর চলে যাবে। সেই শুরু। তারপর প্রতি সপ্তাহে একদিন করে সকালে আমাদের গন্তব্য হয়ে উঠল স্যারের বাড়ি। স্কুলে স্যারের হাতে যেমন জীবন্ত হয়ে উঠত পদার্থবিদ্যার নিষ্প্রাণ সমীকরণগুলো, বাড়িতে তিনি নিজেও পড়তেন, আমাদেরও বলতেন, বুঝে পড়। মাঝে মাঝে ঘরভর্তি দুষ্প্রাপ্য বই থেকে এগিয়ে দিতেন দু'একটা মণিমানিক্য। বলতেন- "দেখ সোজা করে কষা আছে"। উপরি পাওনা হিসাবে হঠাৎ করে দোতলা থেকে নিয়ে আসতেন রেজিস্ট্যান্স বক্স, অ্যামোমিটার, আরও কত কী!

উচ্চ মাধ্যমিকের সময় স্কুলে আমরা স্যারকে পাইনি, পেয়েছি একমাত্র রোববারে। পদার্থবিদ্যার পাঠ নেওয়ার আগে অঙ্ক, বিশেষত ক্যালকুলাস শেখা জরুরি বলে মনে করতেন তিনি। তাই উচ্চ-বিদ্যালয়ের পাঠক্রমের জন্যে তাঁর বাড়িতে যেসব ছাত্রের সমাগম হতো, আগে শেষ করতেন একাদশ, দ্বাদশের অঙ্ক, তারপর ফিজিক্স। বরাবরই ছকভাঙা এই মানুষটি একাগ্রতা, শ্রম, আর অধ্যবসায় দিয়ে ফলিয়েছেন সোনার ফসল, যারা আজ আলো দিচ্ছে দেশের বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণাগারে। না, স্যার এখন আর নেই! ব্যক্তিগতভাবে স্নাতক স্তরের কোনও কিছু দেখার সময় যখন স্যারের খাতার কথা মনে পড়ে, হলুদ হয়ে যাওয়া জেরক্সের পাতা উল্টালে দেখতে পাই, ঠিকরে বেরোচ্ছে ছাত্রদরদি এক মাস্টারমশাইয়ের অধ্যবসায় ও নিরলস শ্রম!

More Articles