রিহার্সাল শেষে নিজের থালা থেকে আদর করে খাইয়েও দিয়েছেন নাট্যগুরু...
Teachers' Day 2023 : প্রচুর বকা খেয়েছি সীমা ম্যামের কাছে, তারপর ম্যাম নিজের প্লেট থেকে আমাকে রিহার্সালের পর খাইয়েও দিয়েছেন, এই স্মৃতিও আছে।
স্কুল জীবনে পড়ালেখার ক্ষেত্রে দু'একজন ভালো শিক্ষক পেলেও তাঁরা কেউই জীবন পাল্টে দেওয়ার কারিগর হয়ে উঠতে পারেননি দুর্ভাগ্যবশত। তবে সেই স্কুলবেলাতেই দু'জন এমন মানুষের সংস্পর্শে আমি আসতে পেরেছিলাম, যাঁরা একটু হলেও আমাকে দু’পা বিশিষ্ট জীব থেকে মানুষ হতে সাহায্য করেছেন এবং আমিও যে কিছু একটা পারি সেই শক্তিটুকু জুগিয়েছেন। ঘটনাচক্রে দু'জনেই আমার থিয়েটারের শিক্ষক, প্রথমজন সৌমিত্র বসু এবং দ্বিতীয়জন সীমা মুখোপাধ্যায়। দু'জনের কাছে কাজ শেখার অভিজ্ঞতা এই শিক্ষক দিবসের প্রাক্কালে ভাগ করে নিতে চাই।
সৌমিত্র স্যারকে প্রথম দেখি ২০১৫-র জুন মাসে। হাওড়ার একটি নাটকের দলে ঘটনাচক্রে যুক্ত হওয়ার পরে সৌমিত্র স্যারের একটি প্রযোজনাভিত্তিক ওয়ার্কশপ করার সুযোগ হয়েছিল। তখন স্বভাবতই স্যারকে চিনতাম না। যাদবপুর, শঙ্খ ঘোষ, শম্ভু মিত্র, বহুরূপীর সঙ্গে স্যারের কী যোগসূত্র কিছুই জানতাম না। সেবার স্যারের লেখা একটি নাটকে এক প্রধান চরিত্রে আমি অভিনয় করি, নাটকটির নাম সম্ভবত ছিল ‘ইচ্ছাপূরণের রাত’। তখন আমার ক্লাস ৯, ওই গম্ভীর মানুষটাকে প্রচণ্ড ভয় পেতাম (এখনও যে একটু একটু পাই না তা নয়)। স্যারের সঙ্গে সহজভাবে মিশতে পেরেছি আরও কিছুদিন পর, যখন সৌমিত্র স্যার আমাদের তৎকালীন দলে রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’ নিয়ে কাজ শুরু করেন। ডাকঘরে স্যার আমায় ঠাকুরদার চরিত্রটিতে অভিনয়ের সুযোগ দেন, আমার সঙ্গে যারা নাটকটিতে অভিনয় করেছিল তারা সবাই স্কুলের ছাত্র। ওই প্রযোজনাটিতে যারা অভিনয় করেছিল, সেইসময়ে আমি আর আরও একটি ছেলে (যে প্রহরীর চরিত্রে অভিনয় করে) বয়সে সবথেকে বড় ছিলাম, মানে সবে মাধ্যমিক পাস করেছি। স্যার আমাদের সঙ্গে তাঁর বহুরূপী যাপনের গল্প করতেন, শম্ভু মিত্র কীভাবে রবীন্দ্রনাথের টেক্সট নিয়ে কাজ করতেন সেইসব গল্প করতেন আর একটু একটু করে বলতেন ডাকঘরের মূলে থাকা দর্শনের কথা। যখন নাটকটির স্টেজ রিহার্সাল হয় এবং সম্পূর্ণ আবহসংগীত তৈরি হয়ে আসে, প্রথমবার শুনে আমি ব্যক্তিগতভাবে চমকে গেছিলাম। খুব যে ভালো বুঝেছিলাম তা নয়, তবে রবীন্দ্রনাটকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার কতটা গভীর হতে পারে তা বুঝেছিলাম। এখন প্রায় ৬-৭ বছর পর নাটকটির ভিডিওটি চালিয়ে দেখতে বসলে বুঝতে পারি কত বড় মাপের নাট্যচিন্তক হলে ডাকঘরের মধ্যে ‘তোরা শুনিসনি কী শুনিসনি তার পায়ের ধ্বনি’ বা ‘তাই তোমার আনন্দ’র মতো গান ব্যবহার করা যায়।
যেদিন প্রেসিডেন্সির প্রবেশিকায় সুযোগ পাই, সেদিন বিকেলেই এক অনুষ্ঠানে স্যারের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়। আমার মা একটু দোনামনায় ছিল, ছেলেকে হাওড়ার কলেজে পড়াবে না কি প্রেসিডেন্সিতে পড়তে পাঠাবে! মা কথাটা স্যারকে বলায়, স্যার মাকে একটা মৃদু ধমক দেন আর আমার মাথায় আলতো চাঁটি মেরে বলেন, "কোনও দিকে তাকাস না, প্রেসিডেন্সিতে বাংলায় অ্যাডমিশন নিয়ে নে।" বলা ভালো স্যারের জন্যই আমার প্রেসিডেন্সিতে পড়ার রাস্তা সুগম হয়।
এবার আসি সীমা ম্যামের কথায়। সীমা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও আমার প্রথম পরিচয় হাওড়ার ওই দলটায়। বলা যায় সীমা মুখোপাধ্যায়ই আমায় পাড়ার গলি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে ইডেন গার্ডেনসে ফেলে দেন। ম্যামের জন্য আমার প্রথম আকাদেমি মঞ্চে অভিনয়, তাও আবার বিমল চক্রবর্তীর মতো একজন বিশাল মাপের অভিনেতার সঙ্গে। প্রচুর বকা খেয়েছি সীমা ম্যামের কাছে, তারপর ম্যাম নিজের প্লেট থেকে আমাকে রিহার্সালের পর খাইয়েও দিয়েছেন, এই স্মৃতিও আছে। সীমা ম্যামকে নিয়ে লিখতে গেলে এত কথা মাথায় ভিড় করছে যে সবটা গুছিয়েই উঠতে পারছি না। ম্যাম রিহার্সাল রুমে ঢুকলেই পানের গন্ধে ঘরটা ভরে যেত (এখনও নিশ্চয়ই একই ঘটনা ঘটে, বহুদিন ম্যামের রিহার্সাল রুমে যাওয়া হয় না, লিখতে গিয়ে গন্ধটা প্রচণ্ড মিস করছি)। ম্যামের সঙ্গে একটা ছোট্ট ব্যাগ থাকত, যাতে পানপাতা সমেত পানের মশলা থাকত, রিহার্সাল করাতে করাতে ম্যাম পান সেজে খেতেন।
আকাদেমিতে প্রথম অভিনয় যেমন ম্যামের হাত ধরে, আকাদেমিতে দেখা প্রথম নাটকটিও ছিল ম্যামের নির্দেশনায়। মণিপুর ও শর্মিলা চানুর আন্দোলন নিয়ে সীমা মুখোপাধ্যায় নিজের দল রঙরূপে একটি প্রযোজনা করেন, নাম ছিল ‘ছায়াপথ’। আজ মণিপুরের এই পরিস্থিতিতে নাটকটি কতটা মূল্যবান তা ভীষণভাবে বুঝতে পারছি।
অন্য থিয়েটার আয়োজিত ‘নাট্য স্বপ্নকল্প’-তে ২০১৬ সালের ৩১ অক্টোবর সীমা ম্যামকে জীবনকৃতি সম্মান দেওয়া হয়। ম্যাম সেদিন মঞ্চে বলেছিলেন, "জীবনে যা কিছু হয়ে যাক, মাথাটা যেন নিচু থাকে সবসময়, ঔদ্ধ্বত্য যেন এসে কোনওভাবে ঘাড়টাকে উঁচু না করে দেয়। এইটুকু নিয়েই চলার চেষ্টা করি।"
একটা ছোট্ট মজার ঘটনা বলি। একবার অনেকদিন আগে গিরিশ মঞ্চের একটা শো’তে চুলে ঝুঁটি করে ঢোকার জন্য সীমা ম্যাম হালকা বকেছিলেন। এখন বড় হওয়ার পরে স্বভাবতই ওড়া শুরু হয়েছে, খুব শখ করে লম্বা চুল রেখেছি, তাতে একটা খোঁপাও হয় আজকাল। গত মাসে একটা নাটক দেখতে গিয়ে হঠাৎ সীমা ম্যামের মুখোমুখি হয়ে পড়ি, চুলে তখনও খোঁপা বাঁধা। গিরিশ মঞ্চের সেই ঘটনাটা হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ায় এই মাস্টার্স শেষ করা বয়সেও ক্লাস ওয়ানের বাচ্চার মতো ঘাবড়ে গেছিলাম।
থিয়েটারের কোনও দলের সঙ্গে যুক্ত নই প্রায় তিন বছর, থিয়েটারেরই বিকল্প কিছু কাজ করার চেষ্টা করছি। পত্রিকার কাজ করছি, লেখালিখি করছি, স্বভাবতই স্যার আর ম্যামের সঙ্গে যোগাযোগ কমেছে অনেকটাই। তবে যখন আমাদের বিভাগে কোনও কাজে এসে সৌমিত্র স্যার বিভাগের অধ্যাপকদের মজা করেই জিজ্ঞাসা করেন, "রাজর্ষি পড়াশোনাটা করছে? না কি শুধু অন্য কাজই করে বেড়াচ্ছে" বা সীমা ম্যাম এখনও দেখা হলে যখন গাল টিপে আদর করেন, সেইটুকুই অনেকটা শান্তি দেয়, কাজ করার উৎসাহ দেয়। এঁরা দু'জন আমায় যা দিয়েছেন, তার সাপেক্ষে এই লেখাটি কিছুই না, আমার হৃদয়ের সবটুকু দিয়ে এঁদের প্রণাম জানাই।