স্বাধীন দেশের চাষিরা সেই প্রথম গর্জে উঠেছিল, আজও প্রাসঙ্গিক তেভাগা আন্দোলন

তেভাগা আন্দোলনের মূল দাবি ছিল, 'তিন ভাগের দুই ভাগ চাষীদের এবং একভাগ ভূ-স্বামীগণের'। যেসব মালিক এই শর্তে রাজি হবে না, তাদের জমিতে কোনও কৃষক কাজ করবে না।

 

 

হেই সামালো, হেই সামালো
হেই সামালো ধান হো
কাস্তেটা দাও শান হো
আর দেব না, আর দেব না
রক্তে বোনা ধান, মোদের ধান গো

তেভাগা আন্দোলনের সূত্রপাত
১৯০৩ সালে সুন্দরবন লাগোয়া সন্দেশখালির চারটি এলাকা ইজারা নিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করে বসতি বানানোর পুরস্কার হিসেবে ইংরেজ সরকারের হাত থেকে ড্যানিয়েল হ্যামিলটন 'স্যর' উপাধি পেয়েছিলেন। জঙ্গল পরিষ্কারের 'ইনাম' হিসেবে জমিদাররা প্রথমদিকে ফসলের একভাগ দাবি করেছিলেন সরকারবাহাদুরের থেকে। সেই দাবি তাঁরা কৃষকদের থেকে 'বুঝে নিতেন' নায়েব, গোমস্তা, লেঠেলবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে। 'কর' আদায়ের নামে চলত অত্যাচার। এদিকে উর্বর জমিতে কৃষকদের মেহনতের ফল হিসেবে খুব ভালো ফসল ফলন হচ্ছিল। এর ফলে জমিদারদের লোভও বাড়ছিল পাল্লা দিয়ে। তাঁরা তখন এক ভাগ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারছিলেন না, তারা পুরো তিন ভাগই দাবি করে বসে। এর ফলে কৃষকরা রুখে দাঁড়ায়। এর ফলে সংঘর্ষ অনিবার্যভাবেই দেখা দেয়। শুরু হয় তেভাগা আন্দোলন। ক্রমশ এই আন্দোলন অবিভক্ত সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। সন্দেশখালির নাম ছড়িয়ে পড়ে রাতারাতি। সেই সূত্রপাত। এরপর আসল রক্তক্ষয়ী তেভাগা আন্দোলন হয়েছিল ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বরে এবং এই আন্দোলন শেষ হয় ১৯৪৭ সালে।

তেভাগা: কৃষক বিপ্ল
১৯৪৭ সালের ৮ মার্চ। স্বাধীনতা তখন প্রায় দোরগোড়ায় উপস্থিত। বেড়মজুর গ্রামে জোতদার দেবেন্দ্রনাথ সরকারের কাছারি বাড়িতে আগুন লাগায় কৃষকরা। শোষিত-নিপীড়িত এবং বঞ্চিত কৃষকদের মধ্যযুগীয় বর্বরতায় দাস করে রাখতে চেয়েছিলেন জমিদার ও জোতদাররা। তেভাগা আন্দোলন ছিল মূলত শ্রেণিহীন সমাজ-প্রতিষ্ঠার বিপ্লব। কৃষিনির্ভর দেশ হলেও বেশিরভাগ কৃষকই ছিল 'ভূমিহীন'। এর ফলে তারা কোনও জমিদার বা জোতদারের অধীনে জমি বর্গা নিয়ে চাষ করত। আর ঠিক সেই কারণেই চাষবাসের উৎপন্ন ফসলের তিন ভাগের দুই ভাগই দিতে হতো মালিক তথা জমিদার বা ভূস্বামীদের। এই বর্গা চাষের ক্ষেত্রে শুধু জমিটুকুই ছিল জমিদারদের ভূস্বামীদের, ফসল উৎপাদনের জন্য ব্যয়, সংশ্লিষ্ট সমস্ত খরচ এবং কায়িক পরিশ্রমের সবটুকুই ছিল চাষিদের। তবু তাদের একভাগ নিয়েই খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে হতো। এত জমিদাররা সন্তুষ্ট ছিল না তারা তিন ভাগের সবটুকুই দাবি করত। ভূমি-কৃষকদের দাবি ছিল উৎপাদিত ফসলের তিন ভাগের দু'ভাগ পাবে কৃষকরা এবং একভাগ পাবে জমির মালিক। তিন ভাগের একভাগ এবং তিন ভাগের দুই ভাগ- এইভাবে ভাগ হবে ফসল, এই থেকেই এই আন্দোলনের নাম হয় 'তেভাগা আন্দোলন'।

আরও পড়ুন: কেমন আছেন তেভাগার শেষ জীবিত সৈনিক?

তেভাগা আন্দোলনের অন্তরালে
ভারতে কৃষক সম্প্রদায়ের আন্দোলন মূলত ব্রিটিশ আমল থেকেই। বিদেশি বণিকদের দ্বারা সবথেকে বেশি শোষণের শিকার হয়েছিল কৃষকরা। ১৭৯৩ সালে ব্রিটিশ গভর্নর কর্ণওয়ালিস-কর্তৃক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের কৃষকরা একের পর এক তাদের জমির মালিকানা হারাতে শুরু করে। কৃষকরা তাদের জমির মালিকানা হারিয়ে মূলত পরিণত হয় ভাড়াটে মজুরে। জমিদার এবং কৃষকদের মাঝে জোতদার নামে একটি মধ্যস্বত্ত্বভোগী শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। এরা জমিদারদের কাছ থেকে জমি ইজারা নিয়ে কৃষকদের মাধ্যমে চাষ করাত এবং জোর করে খাজনা আদায় করত। জমির জরিপ না করেই রাজস্ব নির্ধারণ করা হতো। ফলস্বরূপ, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জমির তুলনায় রাজস্বের হার হয়ে যেত বেশি। জমিদার ও জোতদারদের ওপর কৃষকদের ক্ষোভ ক্রমশ দানা বাঁধতে থাকে এবং ১৯৩৬ সালে সোচ্চার কৃষকদের নিয়ে গঠিত হয় 'নিখিল ভারত কৃষক সভা'। এদের নীতি ছিল 'লাঙল যার জমি তার'। বাংলার ভূমিব্যবস্থা সংস্কারের উদ্দেশ্যে ১৯৪০ সালে ফজলুল হকের মন্ত্রিসভায় প্রস্তাব করে 'ফ্লাউড কমিশন'। ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে ৩০ লক্ষ মানুষ মারা যায়। প্রায় এক কোটি মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। সর্বস্বান্ত মানুষ, মাঝারি কৃষক থেকে শুরু করে প্রান্তিক কৃষক সকলেই অবশিষ্ট জমি জায়গা বিক্রি করতে বাধ্য হয়।

তেভাগা আন্দোলনের দাবি
তেভাগা আন্দোলনের মূল দাবি ছিল, 'তিন ভাগের দুই ভাগ চাষীদের এবং একভাগ ভূ-স্বামীগণের'। যেসব মালিক এই শর্তে রাজি হবে না, তাদের জমিতে কোনও কৃষক কাজ করবে না। তারা আরও সিদ্ধান্ত নেয় যে,এবার ধান উঠবে কৃষকদের ঘরে। তারা সংঘবদ্ধভাবে ধান কাটবে।একদল ধান কাটবে আর একদল তীর-ধনুক-বল্লম নিয়ে পাহারা দেবে। এছাড়া তারা আরো একটি সিদ্ধান্ত নেয় যে, নমঃশূদ্র বা মুসলিম কেউ উচ্চবর্ণ হিন্দুর বাড়িতেও কৃষিকাজ করবে না। তাদের স্লোগান ছিল, 'ইনকিলাব জিন্দাবাদ', 'নিজ খিলানে ধান তুলো', আধি নয়-তেভাগা চাই কর্জ ধানের সুদ নাই বিনা রসিদে ভাগ নাই জান দিব তবু ধান দিব না ভাগচাষিদের উচ্ছেদ করা চলবে না'......ইত্যাদি।

তেভাগা আন্দোলনের কিছু মুখ
তেভাগা আন্দোলনে সম্মুখভাগে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন দিনাজপুরের 'হাজী মহম্মদ দানেশ' (ইনিই ছিলেন তেভাগা আন্দোলনের জনক), চিয়ার সাঁই, কমরেড মণি সিংহ (ময়মনসিংহ) আলতাফ আলি, জহুরুদ্দিন মুনসি, মৌলভী আব্দুল হান্নান, ডাক্তার আব্দুল কাদের (বগুড়া), তগনারায়ণ (রংপুর), রমেন মিত্র (রাজশাহী), ইলা মিত্র, কাছিম মিঞা, নূর জালাল (যশোর) প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।

দুই বাংলার যেসব জেলায় বর্গাচাষিদের ওপর অত্যাচার ও নির্যাতনের মাত্রা বেশি ছিল, মূলত সেইসব জায়গাতেই গড়ে উঠেছিল তেভাগা আন্দোলন। প্রায় ৬০ লক্ষ বর্গাচাষি এই আন্দোলনে শামিল হয়। দিনাজপুর জেলার তৎকালীন ঠাকুর গাঁ মহকুমা ছিল তেভাগা আন্দোলনের আঁতুড়। সেই সময় দিনাজপুরের ৩০টি থানার মধ্যে ২২টি থানাতেই ছড়িয়ে পড়েছিল এই আন্দোলনের আগুন। তেভাগা আন্দোলনের জনক হাজী মোহাম্মদ দানেশ ছিলেন এই স্থানের নেতৃত্বে। কমরেড মণি সিংহর নেতৃত্বে ময়মনসিংহে তেভাগা আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করেছিল। ১৯৪৫ সালে নেত্রকোনায় অনুষ্ঠিত হয় 'নিখিল ভারত কৃষক সম্মেলন'। নেত্রকোনার সিংহের বাংলা, রামেশ্বরপুর, কাইলাহাটিতে আন্দোলন তীব্রতর হয় কমরেড মণি সিংহর নেতৃত্বে।

তেভাগার নারী
তেভাগা আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। নানা ভাবে তাঁরা পুরুষদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলনে শামিল হয়েছেন। পুরুষরা যখন ধান কাটছে, তখন তাঁরা পাহারা দিয়েছেন। কখনও শত্রুদের সামনে দুর্ধর্ষ নির্ভীকভাবে ভালো হয়ে দাঁড়িয়েছেন। এমনকি তীর-বল্লম হাতে তুলে নিয়ে লড়াইও করেছেন।নারী নেত্রীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ইলা মিত্র (সাঁওতালদের কাছে তিনি 'রানিমা' নামে পরিচিতা ছিলেন), এছাড়া রাজবংশী মেয়ে ভাগুনী, জয়বর্মনী, দীপপুরী, মাতি বর্মনী, সীতা বর্মনী, নড়াইলের নমঃশূদ্র কৃষক গৃহবধূ সরলাদি প্রমুখ। আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবার অপরাধে ১৯৫০ সালের ৭ জানুয়ারি কমরেড 'ইলা মিত্র' রোহনপুর রেলস্টেশনে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। পুলিশি হেফাজতে তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন করা হয়, দিনের পর দিন।

তেভাগার পরিণতি
১৯৪৬-'৪৭ সালে দুই বাংলায় মোট ১৯টি জেলার তেভাগা আন্দোলনের আগুন জ্বলে উঠেছিল দাবানলের মতো। 'নিখিল ভারত কৃষক সভা'-র নেতৃত্বে হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মানুষ একত্রে জোট বেঁধেছিল। দিনাজপুর, রংপুর, ময়মনসিংহ, যশোর, খুলনা, ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া, পাবনা, ফরিদপুর, হাওড়া, হুগলি, মালদহ, বাঁকুড়া, নদিয়া, চব্বিশ পরগণা, মেদিনীপুর, জলপাইগুড়ি প্রভৃতি জেলাগুলোতে এই আন্দোলন সংগঠিত হয়। এর মধ্যে দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, রংপুর, খুলনা, ময়মনসিংহ, যশোর এবং চব্বিশ পরগণা জেলায় এই আন্দোলনের তীব্রতা ছিল সর্বাধিক।

এই আন্দোলনের চাপে সরকার ১৯৪৭ সালের ২২ জানুয়ারি বিধানসভায় 'বঙ্গীয় বর্গাদার সাময়িক নিয়ন্ত্রণ বিল' উত্থাপন করেন। মহাত্মা গান্ধী জোতদারদের তেভাগা মেনে নিতে বলেন। আন্দোলনের চাপে ভূস্বামীগণ ৪০ ভাগ বর্গাচাষিকে স্বেচ্ছায় তেভাগা দেন।খাজনার নামে বলপূর্বক অর্থ আদায় বন্ধ হয়। ভূস্বামীরা চাষিদের সঙ্গে আপোস করে এবং মামলা প্রত্যাহার করে নেয়। ১৯৫০ সালের 'জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০'- এই বিলটির মধ্য দিয়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও জমিদারি প্রথার বিলোপ ঘটে।

 

More Articles