শ্মশান থেকে মৃতদেহ তুলে আনা হতো পুজোয়, চমকে দেয় উত্তর কলকাতার কালী মন্দিরের ইতিহাস
History of Thanthania Kalibari : ট্রাম রাস্তার ওপরেই মন্দির। চারিদিকে ঘিঞ্জি বসতি। ব্যস্ত বাস রাস্তা। সামনেই স্কুল কলেজের ভিড়। মন্দিরের ওপর ফলক করে লেখা রয়েছে ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির নাম।
উত্তর কলকাতার কলেজস্ট্রিট। এ শহরের ব্যস্ত জনপদ। ঘিঞ্জি এলাকা। এখানে অচল ট্রামলাইনের ওপর দিয়ে চলে ব্যাস, অটো, ট্যাক্সি অথবা হাতে টানা রিক্সা, কেবল ট্রামটাই চলে না আর। ঘণ্টার শব্দটাও আজ অস্তাচলে। কিন্তু ইতিহাস এখানে প্রতিনিয়ত গল্প বলে। অযাচিত ভাবেই শুরু হয়ে যায় টাইম ট্রাভেল। যার কাঁধে ভর দিয়ে কখনও ঘুরে আসা যায় বই পাড়ার অলিগলি থেকে, কখনও আবার মেডিকেল কলেজের ফুটপাথের স্যাঁতস্যাতে গন্ধে নেশা লাগে। সোডিয়াম ভেপার ল্যাম্পের হলুদ আলোয় সন্ধে নামে, সিগারেটের ধোঁয়া মেশে কফি হাউসের আড্ডায়। তারপর ট্রামলাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করে আবার ঘণ্টার শব্দ কানে আসে, না ট্রাম নয়, খোদ মন্দিরের ঘণ্টার শব্দ। বিপ্লব, স্লোগানের এই রাস্তার ঠিক পাশেই আরাধনা করা হয় দেবী কালীর। আজ বলে নয়, বহু বছর ধরেই। আর এসবের মধ্যেই নিমেষে পাতা উল্টোতে শুরু করে ইতিহাস।
আনুমানিক ১৭০৩ সাল। তখনও সুতানুটি, গোবিন্দপুর মিলে কলকাতা শহরের গোড়াপত্তন হয়নি। জল জঙ্গলে ভরা এলাকায় হঠাৎই ধুয়ো উঠল শক্তি সাধনার। শক্তি-সাধনার উদ্দেশ্য নিয়েই আজকের উত্তর কলকাতার কলেজস্ট্রিট সংলগ্ন এলাকায় এসে হাজির হলেন এক ভবঘুরে শাক্ত ব্রহ্মচারী তন্ত্রসাধক। নাম উদয়নারায়ণ। আজকের ব্যস্ত এলাকার ছবির সঙ্গে সেকালের ছবিটা গুলিয়ে ফেললে চলবে না। তখন এখানে না ছিল গাড়ি-ঘোড়া, রাস্তাঘাট, আর না ছিল জনবসতি। কেবল জল আর জঙ্গলে ঘেরা এই এলাকায় উদয়নারায়ণ নিজের হাতে তৈরি করলেন মাটির সিদ্ধেশ্বরী কালী মূর্তি, প্রতিষ্ঠা করে পূজার্চনাও শুরু করে দিলেন কিছুদিনের মধ্যেই। চারিদিকে অখন্ড নির্জনতা, নিদেনপক্ষে একখানা বসতি খুঁজে পেতেও রীতিমতো ঘাম ঝরাতে হয় ঠিক এরকম জায়গায় আস্ত একটা মন্দির স্থাপিত হল। ফলে মন্দিরের ঘন্টার 'ঠনঠন' শব্দ যেন ওই নিস্তব্ধতার শিরা কেটে ছড়িয়ে পড়তে লাগল দূর থেকে দুরান্তে। লোক মুখে শোনা যায়, এই শব্দ থেকেই নাকি সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরের নাম হয় 'ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি'।
আরও পড়ুন - হাত পাতলেই মেলে ‘চাউমিন’ প্রসাদ, যেভাবে কলকাতার কালী মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন চিনারা
ট্রাম রাস্তার ওপরেই মন্দির। চারিদিকে ঘিঞ্জি বসতি। ব্যস্ত বাস রাস্তা। সামনেই স্কুল কলেজের ভিড়। মন্দিরের ওপর ফলক করে লেখা রয়েছে নাম এবং স্থাপনকাল। মন্দিরের এরকম নাম নিয়ে রয়েছে আরও একটি জনশ্রুতি। মূলত এখনকার কালীকে বলা হতো ডাকাতদের আরাধ্যা। বলা হয়, তারাই এই মূর্তি তৈরি করেছিল। জনশ্রুতি রয়েছে সেই সময় ডাকাতরা হামলা চালানোর পূর্বে, ঘণ্টা বাজিয়ে মন্দিরের দেবীকে আরাধনা করে অভিযানে যেতেন। তাই এই শব্দ শুনে দূরে থেকেও সতর্ক হয়ে যেতেন হামলা সম্পর্কে। মোদ্দা কথা হল, ঘণ্টার শব্দ থেকেই এরূপ নামকরণ। কেউ কেউ অবশ্য বলেন, পাশে লোহার কারখানায় রাতদিন লোহা পিটানোর ঠন ঠন শব্দ থেকেই নাকি এমন নাম।
কিন্তু এই মন্দিরের আসল রহস্য হল, এখনও প্রতি বছর নতুন বিগ্রহ গড়া হয় এখানে। এই মন্দিরের দেবীমূর্তি ধাতুর নয়; এমনকী পাথরেরও নয়। মাটি দিয়ে প্রতি বছর নতুন করে তৈরি করা হয় ঠনঠনিয়ার সিদ্ধেশ্বরীর কায়া। দেবী সিদ্ধেশ্বরী চতুর্ভুজা, ঘোর কৃষ্ণবর্ণা। বামদিকের দুটি হাতে শোভা পায় যথাক্রমে খড়্গ এবং নরকপাল, আর ডান হাতে অভয় এবং বরদা মুদ্রা। সোনার গয়না কিছু থাকলেও মূলত রুপোর গয়নাতেই সজ্জিতা হন দেবী।
যদিও বর্তমানে যে কালীমন্দিরটি রয়েছে তা নির্মাণ হয়েছে বেশ খানিক পরে। সেও অবশ্য ২০০ বছরের বেশি হল। ১৮০৩ সালে শঙ্কর ঘোষ নামে এক ব্যবসায়ী কালী আরাধনার জন্য নতুন মন্দির গড়ে দেন, তার সঙ্গে দেবীর নিত্যপূজার ব্যয়ভারও গ্রহণ করেন তিনিই। তার পর থেকে বংশ পরম্পরায় ঘোষ পরিবারই দেবীর সেবা করে আসছে। আজও। প্রতি বছর কার্তিক অমাবস্যায় মহা সমারোহে পূজিতা হন মা সিদ্ধেশ্বরী। এছাড়াও সারা বছরই দেবীর মন্দিরে থাকে ভক্তদের ঢল। ব্যস্ত জনপদের এক্কেবারে পাশেই চলে সাধনা।
মন্দির নিয়ে আরও একটি গল্প শোনা যায়। মৃতদেহের সঙ্গে নাকি দারুণ ভাব ছিল দেবী সিদ্ধেশ্বরীর। তাই বিশেষ পুজো উপলক্ষে শ্মশান থেকে মড়া নিয়ে আসা হত মন্দিরে। বামাচারী মতে চলত শবসাধনা। জনশ্রুতি আর বিশ্বাস মিলেমিশে গিয়েছে এখানে, তাই শোনা যায় আজও এই প্রথার নাকি চল আছে। দীপান্বিতা অমাবস্যার আগে ভূত চতুর্দশীতে মন্দিরে মরদেহ এনে মৃতের আত্মার শান্তি কামনা করতে দেখা যায় কিছু পরিবারকে। শুনতে অবাক লাগলেও খোদ উত্তর কলকাতাতেই ঘটে এরকম ঘটনা তাও আবার ব্যস্ত শহরের চোখে চোখ রেখেই। যদিও তাতে প্রাচীন গল্পের সত্যতা প্রমাণিত যে হয়না, তা বলাই বাহুল্য।
আরও পড়ুন - কেন কালীপুজোর দিন হয় অলক্ষ্মী বিদায়
কালীর প্রসঙ্গ এলে যেন চলেই আসে রামকৃষ্ণ দেবের কথা। কেবল দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী মায়ের সঙ্গে নয় ঠনঠনিয়ার সিদ্ধেশ্বরী কালীর সঙ্গেও নিবিড় যোগে আবদ্ধ ছিলেন রামকৃষ্ণ দেব। শোনা যায়, তাঁর এক শিষ্য কেশবচন্দ্র সেন একবার ঘোরতর অসুখে পড়লে তাঁর আরোগ্য কামনায় মা সিদ্ধেশ্বরীকে চিনি আর ডাব দিয়ে পুজো দিয়েছিলেন রামকৃষ্ণ দেব, আর তার পরই নাকি সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন কেশবচন্দ্র। প্রথম জীবনে ঝামাপুকুরে বসবাস করাকালীন রামকৃষ্ণ দেব প্রায়শই আসতেন সিদ্ধেশ্বরী মায়ের দর্শনে। আপন মনে গান শোনাতেন দেবীকে। এমনকী পরবর্তীকালে দক্ষিণেশ্বরে থিতু হলেও সময়বিশেষে এই মন্দিরে এসে পুজো দিয়ে যেতেন তিনি।
রামকৃষ্ণ দেবকে নিয়ে ডাব-চিনির সেই জনশ্রুতি আজও বহাল তবিয়তে বাঁচিয়ে রেখেছেন ভক্তরা। বিশ্বাসের দৌড় যে সত্যিই আকাশ ছোঁয়া! তাই এখানে আজও ডাব-চিনির ভোগ নিবেদনের রীতি। শুধু তাই নয় দেবী এখানে মোটেই নিরামিষাশী নন, দিব্যি ঝাল ঝোলে মাছ, পাঁঠা খেতে পছন্দ করেন তিনি। সারা বছর এখানে পিঁয়াজ রসুন ছাড়া আমিষ পদ রান্না করা হয়। ব্যতিক্রম কেবল ফলহারিণী পুজোর দিন আর দীপান্বিতা অমাবস্যার দিন। ব্যস্ত শহরে প্রাণকেন্দ্র আঁকড়ে রেখেছে ইতিহাস। সেই ইতিহাসে যে ধর্মের জায়গাকে একেবারে বাদ দেওয়া চলে না তা আজও জানান দিচ্ছে ঘণ্টার ওই শব্দটাই। ট্রামের ঠন ঠন শব্দ আর শোনা যায় না ঠিকই তবে ইতিহাসের ঠন ঠন শব্দ আজও ধ্বনিত হিয় উত্তর কলকাতার এই কালীবাড়ির অন্দরে।