নারী-সুরক্ষার অজুহাতে বিঘ্নিত হবে না তো কাজের নিরাপত্তা? রাজ্যের প্রস্তাবে উঠছে যে সব প্রশ্ন
The security Of Woman: ভারতবর্ষে মেয়েরা স্কুলে কিংবা কলেজে গেলেও, কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের উপস্থিতি কম হওয়ার কী কারণ, তা সামাজিকভাবে বিশ্লেষণের প্রয়োজন এখন।
গত ৯ই অগস্ট যখন খবর পাওয়া গেল কলকাতার আরজিকর হাসপাতালে একজন মহিলা চিকিৎসক নির্যাতিতা হয়েছেন, তখনও বোঝা যায়নি এই ঘটনার বিরুদ্ধে এত সর্বব্যাপী প্রতিবাদ হতে চলেছে। শুধু কলকাতা নয়, সারা বাংলা ছাড়িয়ে এই প্রতিবাদ দেখতে দেখতে দেশের সীমানা অতিক্রম করেছে। এখন আর এই লড়াই শুধু সোশ্যাল মিডিয়ায় #উইওয়ান্টজাস্টিস বা #জাস্টিসফরআরজিকর— জাতীয় হ্যাশট্যাগে সীমাবদ্ধ নেই, ধীরে ধীরে এখন তা রাস্তার লড়াইতে পরিণত হয়েছে। মহিলাদের ‘রাত দখল’-এর আওয়াজ খেলার মাঠ পর্যন্ত ছড়িয়ে গিয়েছে। আর এটাই সময় ফের সেই কথাটা বলার— যুগে যুগে দেশে দেশে মহিলারা চিরকালই আজ্ঞাবহ এবং অধীনস্থ হয়ে থেকেছেন এবং সেটাই যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতিহাসে দেখা গিয়েছে, মহিলাদের অর্থনৈতিকভাবে এই অধীনতা বহু মহিলাই মেনে নেননি, আর তার বিরোধিতার জায়গা থেকেই শুরু হয়েছে বিভিন্ন দেশে নানান লড়াই, নানান আন্দোলন। আর সেটাই তো হওয়া উচিত আজকের সময়ের মূল আলোচনার বিষয়বস্তু। মহিলাদের সামাজিক স্তরে এবং কর্মক্ষেত্রে আরও বেশি বেশি করে অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়েই আসলে ধর্ষণ এবং নির্যাতন কমতে পারে। কোনও আইন বা আদালতের লড়াই দিয়ে তা সম্ভব হবে না। হলে রাস্তার লড়াই থেকেই তা উঠে আসবে।
বেশিরভাগ সময়েই সাধারণ মানুষ খুব অল্পে সন্তুষ্ট। সেটা রাষ্ট্র খুব ভালো বোঝে। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে মানুষ মনে করে সিবিআই তদন্ত হলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কলকাতা হাইকোর্টে আরজি করের ধর্ষণ এবং হত্যা সংক্রান্ত জনস্বার্থ মামলার শুনানিতে কেন সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হল, এটা ভেবে দেখা জরুরি। আসলে মেয়েদের ‘রাতের রাস্তা দখল’আন্দোলন, কিংবা ডাক্তারদের কর্মবিরতি এমন মাত্রায় চলে যাচ্ছে যে বিষয়টা সরকারের হাতের বাইরে তো চলে যাচ্ছেই, একই রাষ্ট্রের হাতের বাইরেও চলে যাওয়ার সম্ভাবনাও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। সমাজের নানান স্তর থেকে আওয়াজ ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী নিজে বলেছিলেন, রবিবারের মধ্যে কলকাতা পুলিশ তদন্ত করতে না পারলে, তিনি নিজেই সিবিআইয়ের হাতে তদন্তভার তুলে দেবেন। এবার আদালত সেই তদন্তের নির্দেশ দেওয়ার ফলে কী হল? এক, সিবিআই তদন্তের ফলে ডাক্তারদের আন্দোলন বন্ধ হতে বাধ্য। কিন্তু কেউ কি প্রশ্ন তুলবেন, সিবিআইয়ের কার্যকারিতা নিয়ে? ২০০৭ সাল থেকে রাজ্যের ২৯টি মামলা রাজ্যের হাত থেকে সিবিআইয়ের হাতে দেওয়া হয়েছে। রিজওয়ানুর থেকে রবীন্দ্রনাথের নোবেল চুরি একটা মামলারও ক্ষেত্রেও কি সেই ফলাফল আমরা দেখতে পেয়েছি? আর অভিজ্ঞতা অনুযায়ী এই আরজিকরের ঘটনা নিয়েও সিবিআই তেমন কিছু করবে বলে মনে হয় না, মাঝখান থেকে রাজনীতি হবে এবং ভোটের আগে আবারও তা ব্যবহৃত হবে।
আরও পড়ুন: আর জি কর কাণ্ড উপলক্ষ্য মাত্র, ক্ষোভের বারুদ জমতে দেখেও দেখেনি শাসক দল
আসলে মুশকিলটা এখানেই, রাস্তার লড়াইকে খুব দ্রুত লয়ে যদি আদালতমুখী করে দেওয়া যায়, তাহলে কোনওদিনই কোনও সরকারকে ফেলা যাবে না এবং কোনও দাবিই আদায় হবে না। আমরা উকিলদের বক্তব্য আর সওয়াল শুনে ভাবি, মামলা বোধহয় জেতা হয়ে গেল। কিন্তু আসলে যে তা হয় না, তা আমরা বুঝতেই পারি না। ফলে বারবার হেরে যাই। বিভিন্ন ফেক নিউজ এবং অপতথ্যের বাজারে, মেয়েদের দিনের এবং রাতের প্রতিদিনকার লড়াই আবার হারিয়ে যায়। রোজ যে শ্রমজীবী মহিলারা অসুবিধার সম্মুখীন হন, সেই লড়াই নিয়ে কথাও হয় না, আলোচনাও হয় না। যা হয়, তাতে চ্যানেলগুলোর টিআরপি বাড়ে, মিথ্যে খবরের জেরে হারিয়ে যায় আসল তথ্য। যখন কথা বলা উচিৎ, কেন সামাজিক স্তরে, কর্মক্ষেত্রে মহিলারা নিরাপত্তা পাবেন না? কেন মহিলা গিগ শ্রমিকদের জন্য আরও শৌচালয় থাকবে না? যখন এই সমস্ত প্রশ্ন আরো বেশী করে সামনে আসা জরুরি, তখন সরকারের পক্ষ থেকে একটা সমাধান সূত্র বের করার চেষ্টা হয়। সেসময় আবার বিতর্ক শুরু হয়, তাহলে কি মহিলাদের রাতের নিরাপত্তা দিতে গিয়ে, সরকার তাঁদের কাজের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে? আবারও অর্থনৈতিকভাবে পরাধীন করে রাখতে চাইছে মহিলাদের?
পৃথিবীর ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে দেখা গিয়েছে, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে এক জাতি অন্য জাতির উপরে, এক বর্ণ বা ধর্ম অন্য বর্ণ বা ধর্মের উপরে অত্যাচার চালিয়েছে। আজ অবধি কোথাও এমন কোনও সাম্যবাদী সমাজ তৈরি হয়নি, যেখানে এই ধরনের অত্যাচার হয়নি। তার অবসানও হয়েছে সময়ের নিয়মে। কিন্তু প্রতিটি এই ধরনের সমাজব্যবস্থায় একটা বিষয়ের মিল দেখা গেছে। মহিলাদের উপরে অত্যাচার, তাঁদের অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে রাখার চেষ্টা প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই হয়েছে। পশ্চিমে শিল্পবিপ্লবের সময় থেকে মহিলাদের প্রতি এই বৈষম্য ধীরে ধীরে কমানোর জন্য বহু আন্দোলন হয়েছে। উনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের গোড়ার দিকে আমেরিকা এবং ইংল্যান্ডে মহিলাদের গণতান্ত্রিক স্বরের পরিসর বাড়ানোর জন্য বহু আন্দোলন হয়েছে। যার মধ্যে দিয়ে মহিলাদের কিছু দাবিদাওয়া আদায় করা গেছে। মহিলারা ভোটাধিকার পেয়েছেন, কাজের জায়গায় সমানাধিকার পেয়েছেন। বহু মানুষ তখন এই লিঙ্গ সাম্যের এই আন্দোলনগুলোর স্বপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁরা যুক্তি দিয়েছিলেন, যদি মহিলাদের স্কুল, কলেজ এবং কাজ করতে না দেওয়া হয়, তাহলে দেশের এবং দশের উন্নতি হবে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীতে, প্রযুক্তি এবং বিশ্বায়নের সময়ে সারা পৃথিবীতে যখন মহিলাদের অগ্রগ্রতি চোখে পড়ছে, যখন কাজের জায়গা, রাজনৈতিক জগত সর্বত্রই মহিলাদের অংশগ্রহণ লক্ষণীয়ভাবে বেড়েছে, ভারতবর্ষে তার বাহ্যিক প্রতিফলন কিছুটা দেখা গেলেও, একটা অদ্ভুত বিষয় কিন্তু লক্ষ্য করা গেছে। ২০২২ সালের বিশ্বব্যাঙ্কের একটি তথ্য বলছে প্রায় ৯০ শতাংশ মেয়ে, তার নিজের বয়স অনুযায়ী স্কুলে গেলেও, মাত্র ২৮ শতাংশ মহিলা কাজের জগতে প্রবেশ করেছেন।
ভারতবর্ষে মেয়েরা স্কুলে কিংবা কলেজে গেলেও, কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের উপস্থিতি কম হওয়ার কী কারণ, তা সামাজিকভাবে বিশ্লেষণের প্রয়োজন এখন। অর্থনৈতিক মাপকাঠিতে অন্যান্য একই মাপের অর্থনীতির দেশের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে, ভারতবর্ষ সেখানেও পিছিয়ে। সেইসব দেশে যেখানে ৭৪ শতাংশ মেয়েরা পড়াশুনা শেষ করেছে এবং তাঁদের মধ্যে ৩৬ শতাংশ কাজে ঢুকেছে, সেখানে আমাদের দেশ যথেষ্ট পিছিয়ে আছে। কেন এই সমস্ত তথ্য সামনে আনা জরুরি হয়ে পড়েছে এখন? কারণ, আরজিকর হাসপাতালে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া ওই মর্মান্তিক ঘটনা এবং তার পরবর্তীতে সরকারের কিছু পদক্ষেপ আবার কিছু প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। ভারতীয়রা মানে আমরা সাধারণত এই ধরনের ঘটনাকে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি বলে মনে করি। অবশ্য মনে না করার কোনও কারণও নেই, কারণ সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিও সেই রকম। নির্ভয়া কান্ডের পরে যে বিশাখা কমিটির রিপোর্ট পেশ হয়েছিল, তা এতদিনে লাগু হয়নি কেন?— সেই প্রশ্ন কে করবে ১৩ বছর পার করা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে? কেন্দ্রীয় সরকার? তা যদি ভেবে থাকেন, তাহলে নিশ্চিত ভুল ভাবছেন। কেন্দ্রীয় সরকার সেইসব বিষয়ে এতটুকুও চিন্তিত নন, তারা বরঞ্চ অনেক বেশী চিন্তিত, রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক আছে কিনা, তা নিয়ে। তাই কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র দফতর থেকে প্রতি দু'ঘণ্টা অন্তর, রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা সংক্রান্ত রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে। যদি দেখা যেত, যে কেন্দ্রের নারী ও শিশু কল্যাণ দপ্তর, প্রতিদিন যে কোনও রাজ্যে ঘটে যাওয়া মহিলাদের ওপর অত্যাচারের খতিয়ান নিচ্ছে, বা তার বিরুদ্ধে কোনও সদর্থক ভূমিকা নিচ্ছে, তাহলেও বোঝা যেত। কিন্তু তা নয়। তারা অন্য কিছু নিয়ে চিন্তিত। রাজ্য সরকার অবশ্য আরও একটু এগিয়ে ভাবেন, তারাও শ্যামবাজার এবং আরজিকর হাসপাতাল সন্নিহিত অঞ্চলে কোনও বিক্ষোভ জমায়েত নিষিদ্ধ করেছে। একদিকে তারা ১৬ দফা ঘোড়ার ডিম প্রসব করে, ‘রাতের সাথী’ প্রকল্প নামিয়ে ভাবছে, না জানি কি করলাম, আর ওদিকে বিক্ষোভ বন্ধ করছে।
আরও পড়ুন: ১০ দফা দাবিতে অনড় আরজি করের জুনিয়র চিকিৎসকরা
হয়তো এইটা আইন শৃঙ্খলা অবনতির একটা দিক, কিন্তু তা সত্ত্বেও বলতে হবে এই ধরনের কোনও ঘটনা শুধুই আইনশৃঙ্খলার বিষয় নয়। সাম্প্রতিক পিউ সার্ভের তথ্যে একটি ভয়ঙ্কর দিক সামনে এনেছে। ৫৫ শতাংশ পুরুষ মনে করেন, কাজের জায়গায় পুরুষদের বেশি প্রাধান্য থাকা উচিৎ। যে ৬১টি দেশে এই সমীক্ষা চালানো হয়েছিল, তার মধ্যে দেখা গিয়েছে, এই প্রশ্নের নিরিখে ভারত দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। অর্থাৎ ভারতীয় পুরুষেরা মহিলাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক ভাবতেই অভ্যস্ত এবং তাঁরা মনেই করেন, ভারতীয় পুরুষদের মহিলাদের তুলনায় কর্মক্ষেত্রে জায়গা বেশি পাওয়া উচিৎ এবং মহিলাদের স্থান হওয়া উচিত অন্দরমহলে। এই জায়গা থেকেই আসলে জন্ম নেয় ধর্ষণ মানসিকতা। অর্থনীতিতে মহিলাদের অংশগ্রহণ যত কম হবে, তত এই মানসিকতা বাড়বে। এমনিতেই অনেক ক্ষেত্রে এরকম মানসিকতা দেখা গেছে যে মেয়েদের অনেক ঝামেলা, বিশেষত প্রসবকালীন ছুটি, বাচ্চার দেখাশোনা ইত্যাদি। এখন যদি একজন মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর তরফে আবার রাতের ডিউটি যথাসাধ্য কম দেওয়ার বিষয়টি যুক্ত হয় তাহলে তো কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের লড়াইটা আরো কঠিন হয়ে ওঠে। দিনদুপুরে কিছু হওয়ার ভয়ে মেয়েরা কি তাহলে ঘরেই বসে থাকবে, এই প্রশ্নটা কেউ মুখ্যমন্ত্রীকে করবেন না? ‘রাতের দখল’ নেওয়ার লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে কি মহিলারা এই দাবি করেছিলেন আদৌ?