শুধু মার্ভেল-বিশ্বেই নয়, বাস্তবেও ছিল ধুরন্ধর অ্যাভেঞ্জার্স! যারা চমকে দিয়েছিল দুনিয়াকে
History Of Jewish Avengers: বাস্তবেও ছিল অ্যাভেঞ্জার্স। যাদের উত্থান হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে জার্মান অধিকৃত পোল্যান্ডে।
একজন চূড়ান্ত শক্তিধর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সমরাস্ত্র হিসেবে যাকে তৈরি করেছিল আমেরিকা। সত্তর বছর বরফের নিচে ঘুমোনোর পরেও যে অক্ষয়। অন্য জন আমেরিকার অন্যতম অস্ত্র প্রস্তুতকারক সংস্থার মালিক, চূড়ান্ত ধনী এবং চূড়ান্ত বুদ্ধিমান। আর একজন বজ্রের দেবতা ও অন্য জন চির-হরিৎ গামা পালোয়ান, যিনি পেশায় পদার্থবিদ হলেও গামারশ্মির বিচ্ছুরণে আসুরিক ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলেন। এখানেই শেষ নয়, আর আছে এক গুপ্তচর, পেশাদার খুনি হিসেবে যাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল ছোটবেলা থেকেই। সবশেষে রয়েছেন ঈগলের চেয়েও তীক্ষ্ণ দৃষ্টির এক যোদ্ধা, যার হাতে তির আলোর থেকেও দ্রুত ছোটে। আর দুর্ধর্ষ এই দলকে একজোট করে রাখেন কৃষ্ণাঙ্গ এক কর্নেল, যিনি কিনা ধুরন্ধর গুপ্তচরও বটে। এই সব চরিত্রই বড় চেনা চেনা। দুনিয়াকে বাঁচানোর গুরুভার কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন তাঁরা। কখনও তাঁদের লড়াই দূরতর গ্রহ থেকে আসা চিতৌরি সেনার সঙ্গে, তো কখনও যুদ্ধবাজ যন্ত্রমানবের সঙ্গে। কখনও বা সর্বশক্তিমান বেগুনি দানব মেরে পৃথিবীকে যন্ত্রণামুক্ত করেন তাঁরা। ক্রমে দলে বহরে বেড়ে ওঠে পর্দার অ্যাভেঞ্জার্স সেনা।
পর্দায় এমন ম্যাজিক আখছার ঘটান স্ট্যান লি-র সেসব সুপারহিরোরা। যাঁদের একত্রে নাম অ্যাভেঞ্জার্স। যে সব মার্ভেল চরিত্রের পরতে পরতে মিশে থাকে ইতিহাসের সে সব কালো অধ্যায়। ইহুদি হত্যার গাঁথা, কালো মানুষের লড়াই আবার পরমাণু যুদ্ধের অন্ধকারময় দিক। কিন্তু স্ট্যান লির নিজকলে প্রস্তুত এই যে অ্যাভেঞ্জার্স তা কি পুরোটাই মনগড়া, বানানো? একেবারেই নয়। কারণ বাস্তবেও ছিল অ্যাভেঞ্জার্স। যাদের উত্থান হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে জার্মান অধিকৃত পোল্যান্ডে। ১৯৪১-৪৫, পোল্যান্ডের আউশভিৎজ় সাক্ষী ছিল সেই কলঙ্কময় অধ্যায়ের, যা ইতিহাসে পরিচিত হলোকাস্ট নামে। নাৎসি শিবিরে নারকীয় ভাবে হত্যা করা হয়েছিল ৬০ লক্ষেরও বেশি ইহুদিকে। জার্মান অধিকৃত ইউরোপের ইহুদি জনসংখ্যার দুই তৃতীয়াংশকেই শেষ করে দিয়েছিল নাৎসি বাহিনী।
আরও পড়ুন: উল-কাঁটার নকশায় গোপনে খবর পাচার! বিশ্বযুদ্ধের সময়ে দুর্ধর্ষ গুপ্তচর হয়ে উঠেছিলেন বাড়ির মেয়েরাই
পৃথিবীর সমস্ত যুদ্ধের ইতিহাসই আসলে প্রতিশোধের ইতিহাস। ঠিক যেমন করে ৭ অক্টোবর, ইহুদিদের পবিত্র দিনে ইজরায়েলে ঢুকে পড়ল জঙ্গিগোষ্ঠী হামাস, সত্তর বছর আগে হওয়া এক ঘটনার প্রতিশোধ নিতে। নির্বিবাদে হত্যা করা হল অজস্র নিরপরাধ মানুষকে, করা হল অপহরণ। আর তার বদলা নিতে গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করে দিল ইজরায়েল। সেই ধ্বংসলীলা এখনও চলছে। রকেটে, গুলি, বোমা, বিস্ফোরণে তছনছ করে দেওয়া হচ্ছে গোটা শহর। অগণিত মানুষ রোজ মারা যাচ্ছেন। মারা যাচ্ছে অজস্র শিশু। অথচ তা নিয়ে পরোয়া নেই কারওর। যেমনটা ছিল না নাৎসিদের। অসংখ্য ইহুদিকে গ্যাসচেম্বারে ঢুকিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তাঁদেরকে ব্যবহার করা হয়েছে ক্রীতদাসের মতো। প্রতিদিন মৃত্যুর মধ্যে বসিয়ে রেখে একটু একটু করে শ্বাসবায়ু কেড়ে নিয়েছিল হিটলারবাহিনী।
১৯৪৫ সালের অগস্ট মাসে জাপানের দুটি শহরে পারমাণবিক বোমা ফেলল আমেরিকা। দুটি শহর মিলিয়ে ২ লক্ষেরও বেশি মানুষ মারা গেল ওই হামলায়। এর পরেই ১৪ অগস্ট আমেরিকার কাছে আত্মসমর্পণ করল অক্ষশক্তির শরিক জাপান। সেই সঙ্গেই শেষ হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যার বুকে চাপা রইল ভয়াবহ সেই সব অন্ধকার ইতিহাস। যে সব ইহুদি মানুষ ওই নির্মম গণহত্যার হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিল সেদিন, তাদের শরীরের শিরায় উপশিরাতেও যে চিরন্তন সেই প্রতিশোধ-বিষ কাজ করবে, তাতে আর নতুন কথা কী! তেমনই ৫০ জন বেঁচে যাওয়া ইহুদি মিলে তৈরি করেছিল একটি দল। যাদের নাম ছিল অ্যাভেঞ্জার্স। তবে পৃথিবীকে বাঁচানো নয়, নাৎসিদের হত্যাই ছিল যাদের মূল লক্ষ্য। হিব্রু ভাষায় তাঁদের ওই দলের নাম ছিল নাকাম।
এই অ্যাভেঞ্জার্স বাহিনীর সূচনা হয়েছিল আব্বা কোভনার নামে এক নেতার হাত ধরে। যাঁর জন্ম হয়েছিল পোল্যান্ডে। পরবর্তীকালে ইজরায়েলের কবি-সাহিত্যিক হিসেবেও নামডাক হয় তাঁর। জার্মানদের এই ইহুদিনিধনের কথা নিজের ইস্তেহারেই প্রথম প্রকাশ করেন কোভনার। চেষ্টা করেছিলেন গণজাগরণের। তবে তার সেই পরিকল্পনা ঘেঁটে যায়। নাৎসিবাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে জঙ্গলে পালিয়ে যান কোভনার, পরে সোভিয়েত পার্টিসানসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কোনও ভাবে প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তাঁর শরীরেই জেগে উঠল প্রতিশোধের আগুন। তাঁর উদ্যোগেই তৈরি হল অ্যাভেঞ্জার্স বাহিনী। প্রায় পঞ্চাশ জন ইহুদি, যাঁরা কোনও না কোনও ভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন সেদিন নাৎসিদের নারকীয় আগ্রাসনের হাত থেকে।
রক্তের বদলে রক্ত, খুনের বদলা খুন। যে ভাবে হোক ইহুদি গণহত্যার বদলা নিতেই হবে। অগত্যা কুকুর কামড়ে দিলেও তুমিও বসিয়ে দাও মরণ কামড় কুকুরের পায়ে। প্রতিশোধের আগুন বুকে নিয়ে কোভনার ও তাঁর দলবল ছুটে গেলেন ম্যান্ডেটরি প্যালেস্টাইনে। সংগ্রহ করে আনতে বিরাট পরিমাণ বিষ। যে বিষ গণকবর রচনা করবে নাৎসিদের। সযত্নে দু-দুটি পরিকল্পনা সাজাল অ্যাভেঞ্জার্স বাহিনী, একটি প্ল্যান-এ এবং অন্যটি প্ল্যান-বি।
জার্মানির নিউরেমবার্গ শহরের মিউনিসিপ্যাল ওয়াটার সরবরাহের লাইনে ওই বিষ মিশিয়ে দেওয়া হবে। সেটাই ছিল নাকামদের প্ল্যান এ। সেই অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য নির্বাচন করা হয় জোসেফ হারমাটজ ওরফে মেইম মেন্ডেল নামে এক অ্যাভেঞ্জার্স সদস্যকে। কেন নিউরেমবার্গই? কারণ ওই শহরেই কড়া শাসন ছিল নাৎসি দলের। এদিকে তখনও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত মোছেনি। দেশের প্রায় সমস্ত বাড়িই বোমার আঘাতে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ফলে নাকামদের একটা ঘাঁটি তৈরির কাজটা সহজ ছিল না। অবশেষে অনেক ঘুষ-টুশ দিয়ে শহরের ওয়াটার সাপ্লাইয়ের সঙ্গে যুক্ত এক ইঞ্জিনিয়ারকে হাত করেন জোসেফ। যাঁকে দিয়ে প্রধান ওয়াটার ভালভটি নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা ছিল। তার পরেই আসল খেল। এমন ভাবে বিষপ্রয়োগ করতে হবে, যাতে সর্বোচ্চ সংখ্যক জার্মানকে খতম করা যায়। কিন্তু তীরে এসে ডুবল তরী। বিষ হাতে পেয়েও তা কাজে লাগাতে পারলেন না কোভনার। অধিকৃত জার্মানির ব্রিটিশ জোনে গ্রেফতার করা হল তাঁকে। আর বিষের থলি ফেলে দিতে হল জলে।
প্ল্যান এ ব্যার্থ হওয়ার পরে প্ল্যান বি-তে মনোযোগ দিল নাকাম বাহিনী। আবারও অস্ত্র বিষ। এবার আর্সেনিক সংগ্রহ করা শুরু করেছিল অ্যাভেঞ্জার্স-সেনা। নিউরেমবার্গের আমেরিকান জোনের যুদ্ধবন্দি জার্মানরাই ছিল এবার তাদের লক্ষ্য। কোনও ভাবে সেই বন্দিশালার বেকারিতে ঢুকে প্রায় ৩ হাজার রুটিতে বিষ মিশিয়েছিল তারা। যার ফলে ল্যাংসওয়াসার বন্দিশিবিরের প্রায় ২ হাজারেরও বেশি জার্মান যুদ্ধবন্দি অসুস্থ হয়ে পড়ে। তবে কাউকে মারতে পারেনি সেই প্রতিশোধকামী অ্যাভেঞ্জার্সরা। নাকামকে সেসময় কেউ কেউ জঙ্গিগোষ্ঠী বলে দেগেও দেয়। ২০০০ সালে ওই দলের দুই সদস্যের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা চালু হয়েছিল বটে, তবে জার্মান পাবলিক প্রসিকিউটারেরা ওই মামলা বাতিল করে দেন।
আরও পড়ুন:১০০ বছর পর এসে পৌঁছল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ‘রহস্যময়’ চিঠি, কী লেখা রয়েছে সেখানে?
শেষপর্যন্ত সফল হতে পারেনি সেদিনের অ্যাভেঞ্জার্স। তবে প্রতিশোধের এক আশ্চর্য নাটকীয় মঞ্চ তৈরি করেছিল তারা। যে প্রতিশোধের রক্ত-বিষ আজও বয়ে চলেছে যুদ্ধবাজ সমস্ত দেশের রাষ্ট্রনায়কদের শরীরে। তবে ভাবলে অবাক লাগে যে ঠিক কোন জায়গা থেকে স্ট্যান লি তাঁর সুপারহিরো বাহিনীর নাম রেখেছিলেন অ্যাভেঞ্জার্স? যারা নিজের জীবন বাজি রেখে কিনা বাঁচাবে বিশ্বকে। প্রয়োজনে পারমাণবিক বোমা কাঁধে করে পৌঁছে দিয়ে আসবে পৃথিবীর বাইরে। প্রয়োজনে নিজের শরীর পুড়িয়ে বাঁচাবে মানবতাকে। নাকি আসলে সেই প্রতিহিংসা, প্রতিশোধের মুখে এক বিপরীত বিশ্বের গল্প শোনাতে চেয়েছিলেন লি, যা পৃথিবীকে যুদ্ধমুক্তির গল্প শোনাবে। যা মানুষকে ভাবতে শেখাবে, অ্যাভেঞ্জার্স মানে প্রতিহিংসাকামী একদল খলনায়ক নয় মোটেও, 'অ্যাভেঞ্জার্স' মানে আসলে একদল সুপারহিরো, যারা আগামী পৃথিবীর অজস্র যুবক-যুবতীকে নায়ক হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখায়। যারা সব কিছুর শেষে শেষমেশ জিতে যাবেই।