মধ্যপ্রাচ্যের অভিজাতদের পানীয় থেকে কিভাবে সাধারণ ভারতীয়র এনার্জি ড্রিংক কিভাবে হয়ে উঠলো কফি, জানেন?
বাঙালির জীবনে উত্তেজক পানীয় একটা আলাদা ভূমিকা গ্রহণ করে। সকালবেলা পাড়ার চায়ের দোকানে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে গরম চায়ের কাপে দিন শুরু হলেও দিনের মাঝখানটা দখল করে নেয় কফি। কর্পোরেট সেক্টরের ব্ল্যাক কফি হোক কিংবা মধ্য কলকাতার প্রাণকেন্দ্র কলেজ স্ট্রিটের ইন্ডিয়ান কফি হাউজের ইনফিউশন কিংবা ক্যাপাচিনো, কফি যেন বাঙালির প্রত্যেকটি মুহূর্তের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে অত্যন্ত গভীরভাবে। শীতের রাত্রে কম্বল মুড়ি দিয়ে ওয়েব সিরিজ দেখার সময় হোক কিংবা বিয়ে বাড়িতে স্টার্টার হিসেবে, সবকিছুতেই বাঙালি আগে খোঁজে কফিকে। কফি আমাদের বাঙালি আদব-কায়দার সঙ্গে এতটাই গভীর ভাবে সম্পর্কিত যে বিভিন্ন বাঙালি আধুনিক যুগের গানেও এই পানীয়র অবস্থান উল্লেখযোগ্য।
তবে, পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের সঙ্গে এই কফির ইতিহাস কিন্তু বহু পুরনো। বর্তমানে, পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখতে গেলে ব্রাজিল, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, কলম্বিয়া এবং ইথিওপিয়ার পরেই বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম কফি প্রস্তুতকারী দেশ হলো ভারত। তবে ভারতের সবথেকে বেশি কফি তৈরি হয় কিন্তু দক্ষিণ ভারতে। ২০১৫ অর্থবর্ষে ভারতে প্রায় ৫.৫ মিলিয়ন ব্যাগ কফি উৎপন্ন হয়েছিল যে একটি দেশের জন্য অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য একটি সংখ্যা। তবে শুধুমাত্র উৎপন্ন নয়, রপ্তানির ক্ষেত্রে ভারত বিশ্বের সবথেকে বড় বড় দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। প্রায় প্রত্যেক বছর ভারতে উৎপন্ন কফির ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ রফতানি করা হয় বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলিতে, এবং এর মধ্যে ৩০ শতাংশ থাকে দামি আরবিকা কফি এবং বাকিটা থাকে অপেক্ষাকৃত সস্তা এবং স্ট্রং কফি রোবাস্টা। সাধারণত ভারতীয়রা একটু স্ট্রং স্বাদের কফি বেশি পছন্দ করে, তাই ভারতে রোবাস্টা ব্যবহার হয় বেশি। ব্রাজিলে যেরকম ভাবে কফির একটি বিশেষ ডোমেস্টিক মার্কেট রয়েছে, সেরকম হয়তো ভারতে খুব একটা ডোমেস্টিক মার্কেট নেই, কিন্তু ধীরে ধীরে ভারত এই সমস্ত দেশগুলির মতই একটি দেশে পরিণত হতে শুরু করেছে।
তবে ভারতে কফির আগমন নিয়ে একটা বিশাল বড়ো কাহিনী রয়েছে, যার সঙ্গে দক্ষিণ ভারত দারুন ভাবে জড়িত। বিগত সপ্তদশ শতাব্দীতে ভারতে প্রথম বার কফির আগমন ঘটেছিল বলে শোনা যায়। আগেকার দিনে কফি মূলত তৈরি হতো মধ্যপ্রাচ্যের দিকে। তারপর সেখান থেকে আস্তে আস্তে তুরস্ক, এবং মধ্যপ্রাচ্যের আশেপাশের বিভিন্ন দেশে কফির জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করলো। শোনা যায়, প্রায় পঞ্চদশ শতাব্দী নাগাদ মধ্যপ্রাচ্যের দিকের একজন মেষপালক দেখতে পান একটি বিশেষ গাছের লাল লাল রঙের ফলগুলি খেয়ে তার গবাদি পশুগুলি অদ্ভুদ ধরনের আচরণ করতে থাকে, মাঝেমধ্যে আবার উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তারপর সেই মেষপালক নিজেই ওই বিশেষ বীজ খেয়ে দেখলেন সত্যিই, ওই বীজগুলিতে অদ্ভুত ধরনের উত্তেজক ক্ষমতা রয়েছে, এবং সেখান থেকেই আগমন ঘটল বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় পানীয় কফির।
কিন্তু ভারতে কফির আগমনের কাহিনীটা একটু অন্যরকম। জানা যায়, বাবাবুদান নামের একজন মুসলিম হজ যাত্রী একবার মক্কা থেকে ফেরার সময় নিজের দাড়ির মধ্যে সাতটি কফি গাছের বীজ লুকিয়ে নিয়ে ভারতে চলে আসেন। সেটা প্রায় ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দ। সেই সময় আরব থেকে বা মধ্যপ্রাচ্য থেকে কাঁচা কফি বীজ নিয়ে আসা একটি দণ্ডনীয় অপরাধ ছিল। কিন্তু নিজের দাড়ির মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে আসায় কেউ ঠাওর করতে পারেননি, ওই ব্যক্তি আরব থেকে বীজ নিয়ে সরাসরি ভারতে চলে এসেছেন। ভারতে চলে এসে কর্নাটকের চন্দ্রগিরি পাহাড় এলাকায় সেই বীজগুলিকে তিনি মাটিতে রোপন করলেন। তখন থেকেই ভারতে শুরু হলো কফি চাষ। কিন্তু ভারতে এই কফি ছড়িয়ে পড়ার পিছনে সবথেকে বড় অবদান রয়েছে ওলন্দাজদের, যারা সপ্তদশ শতাব্দী নাগাদ ভারত দখল করেছিলেন। তারাই ভারতে সর্বপ্রথম কফির কমার্শিয়াল বিক্রি শুরু করেন।
তারপরে ভারতে আসেন ব্রিটিশরা। তারাও ঠিক একইভাবে ভারতে কফির বাণিজ্যিক উৎপাদন এবং ভারতে কফির ছড়িয়ে পড়াকে প্রভাবিত করেছিলেন। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ ভারতে বাণিজ্যিকভাবে কফি তৈরি ব্যাপকভাবে চালু হতে শুরু করল। তবে প্রথমে ভারতে আরবিকা কফি অর্থাৎ আরবের কফির আদি রূপ বেশি প্রচলিত ছিল। কিন্তু আরবিকা কফি অত্যন্ত বেশি দামী এবং এই কফি তৈরি করতে পরিশ্রম অনেক বেশি। এই কারণেই ধীরে ধীরে আরবিকা কফি পিছিয়ে পড়তে শুরু করল এবং সেই জায়গা দখল করল রোবাস্টা কফি। এই রোবাস্টা কফি বেশ স্ট্রং এবং ভারতীয়দের স্বাদ কোরকের জন্য এই রোবাস্টা কফি আরো বেশি সুস্বাদু হিসেবে গৃহীত হতে শুরু করল।
তারপরেই ভারতীয় কফির প্রচলন এবং জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে শুরু করলো গোটা বিশ্বে। ১৯০৭ সালে তৈরি হল দি ইন্ডিয়া কফি বোর্ড। এই বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হবার পরেই ভারতীয় কফি নিয়ে নানা ধরনের গবেষণা শুরু হলো। কিভাবে ভারতীয় কফিকে আরো উন্নত করা যায় এবং ভারতীয়দের জন্য কফি আরও সস্তা কিভাবে করা যায় সেই নিয়ে নানান ধরনের গবেষণা শুরু হলো। পরবর্তী বেশ কয়েক বছর ধরে এই কফি বোর্ড ভারতে তৈরি কফি নিয়ে নানাভাবে গবেষণা চালিয়েছে। ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে, যখন ভারতীয় কফির জনপ্রিয়তা একেবারে শীর্ষে, সেই সময় ভারতীয় কফির রপ্তানি বাজারকে দুর্দান্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করল ভারতের এই বিশেষ কফি বোর্ড। ওই বছরের পর থেকেই ভারতে জন্ম নিতে শুরু করলো একাধিক কফি ব্র্যান্ড। বিদেশের কিছু কফি ব্র্যান্ড ভারতে তৈরি কফি কিনতে ইচ্ছা প্রকাশ করল। চাষীদেরকেও সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হল তৈরি কফি যেকোনো জায়গায় বিক্রি করার।
বর্তমানে পরিসংখ্যান দেখতে গেলে, ৪ লক্ষ হেক্টর এর কাছাকাছি জমিতে ব্যাপকতার সাথে কফি তৈরি করা হচ্ছে ভারতে। এর মধ্যে বেশ কিছু ছোট ছোট ফার্ম রয়েছে যেখানে সবথেকে বেশি পরিমাণে কফি তৈরি করা হয়। এখনো ভারতের দক্ষিণ অংশে কফি চাষ সবথেকে বেশি হলেও ধীরে উত্তর-পূর্ব ভারতের দিকে কফি চাষের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কর্ণাটক, কেরালা এবং তামিলনাড়ু ছাড়াও বর্তমানে আসাম, মনিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড এবং অরুণাচল প্রদেশে কফি তৈরি হওয়া শুরু হয়েছে। কফি বর্তমানে ভারতের প্রত্যেকটি মানুষের পছন্দের পানীয়র তালিকায় একটি হয়ে উঠেছে। নিম্ন মধ্যবিত্ত সাধারণ ভারতীয়র ইনস্ট্যান্ট কফি হোক কিংবা একটু উচ্চবিত্তদের বিন্স কফি কিংবা ফিল্টার কফি, শীতের সকালে ঘুম থেকে উঠে ভারতীয়দের কফি চাইই চাই।
আর বাঙালির সঙ্গে কফির একটা আলাদাই মেলবন্ধন চোখে পড়ে। মধ্য কলকাতায় যদি সব থেকে বড় আড্ডা মারার জায়গা থাকে তাহলে সেটা হল কফি হাউস। একটা ইনফিউশন কিংবা ক্যাপাচিনো নিয়ে নিজের প্রিয় মানুষদের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেন বহু বাঙালি। কফি হাউজ মানেই একটা পুরনো নস্টালজিয়া। কফি হাউজের সঙ্গে প্রত্যেকেরই একটা-না-একটা ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে। সেই কফি হাউজের কফি নিয়েই হোক কিংবা সেখানে কাটানো সময়, কফি হাউজ এবং কফি বাঙ্গালীদের মনে একটা আলাদা জায়গায় অবস্থান করে। তাইতো প্রত্যেক দিন সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্সি কলেজের উল্টোদিকে ইন্ডিয়ান কফি হাউসে ভিড় জমে কলেজ পড়ুয়া থেকে শুরু করে প্রবীণ নাগরিকদের। কবিরাজি হোক কিংবা পেঁয়াজের পকোড়া, একটা জিনিস তাদের টেবিলে মাস্ট এবং সেটা হলো কফি।